আল মাদাম: মরুর বুকে লুকিয়ে থাকা এক ভূতুড়ে গ্রাম

351
0

২০১৮ সালের দিকে আরব আমিরাতের ফটোগ্রাফার আকরাম জাতারি মরুর বুকে লুকিয়ে থাকা এক অদ্ভুত গ্রামের সন্ধান পান। মরুভূমির বালিতে চাপা পড়ে থাকা এই পরিত্যক্ত গ্রামের পার্শ্ববর্তী এলাকার কোনো লোকই এখানে আসতে রাজি নয়। কারণ একটাই লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, গ্রামটি ভৌতিক। 

আকরাম জাতারি ২০১৯ সালে এই গ্রামটিকে নিয়েই একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন, ‘দ্য ল্যান্ডিং’। সর্বদিক হতে উন্নত আরব আমিরাতের জাঁকজমকের মাঝে লুকিয়ে থাকা এই ভৌতিক গ্রাম নিয়েই আজকের আলোচনা। 

সত্যিকার অর্থেই, দুর্দান্ত দুবাইয়ের আকাশসীমানাকে ভেদ করা বিস্তৃত পরিসরের অবকাঠামোগুলোর দিকে তাকালে কেউই হয়তো বিশ্বাস করবে না যে জাঁকজমকপূর্ণ এই দুবাই শহর হতে মাত্র ৭৪ কি.মি. দূরেই রয়েছে পরিত্যক্ত গ্রাম আল মাদাম। দুবাই শহর হতে ঘণ্টাখানেকেরও কম সময়ে গাড়ি চালিয়ে নির্জীব এই গ্রামে পৌঁছানো যায়। আল মাদাম গ্রামটি শারজার সীমান্ত প্রান্ত ঘেষে অবস্থিত।  

নিস্তব্ধ আল মাদাম Image source: CNN travels

পরিত্যক্ত ১২টি বাড়ি এবং কেন্দ্রে নির্মিত একটি মসজিদে ঘেরা আল-মাদাম গ্রামে প্রথমে পা রাখতেই জনশূন্যতার বিস্ময়কর নিরবতা এবং রহস্যময় বালির ঘ্রাণ পাওয়া যাবে। পুরো গ্রামটিকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে মরুভূমির বালি। পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর দরজা পুরোপুরি খোলা, আবার কোনো কোনো বাড়িতে দরজার অস্তিত্বই নেই। 

বাড়িগুলোর ভেতরে রাখা এলোমেলো আসবাবপত্রগুলোকেও গ্রাস করেছে বালির প্রতিটি কণা। গ্রামের এই দৃশ্য দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে, গ্রামের বাসিন্দারা আচমকা কোনো বিপদে নিজেদের জীবন রক্ষার্থে সবকিছু ছেড়ে গ্রাম হতে পালিয়েছে। আবার অনেকে এই কথাও বলে থাকে, অতিপ্রাকৃত কোনো শক্তি এই গ্রামের বাসিন্দাদের গ্রাম ছেঁড়ে পালাতে বাধ্য করেছে।  

পেছনের ইতিহাস 

আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, স্থানীয়দের কারোরই এই ভৌতিক গ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে জানা নেই। তবে কেউ যে, এই গ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেনি তা কিন্তু নয়। ২০১৮ সালে শারজাহ আর্ট ফাউন্ডেশন (SAF) গ্রামের ইতিহাস খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে জনসাধারণের মাঝে একটি জরিপ চালায়। 

দ্য ল্যান্ডিং শো’তে আকরাম জাতারি Image source: idfa institute

জনসাধারণের জরিপে কিছু স্থানীয়রা জানান, এই রহস্যময় গ্রামটি ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণ করা হয় এবং সেখানে আল কুতবি সম্প্রদায় বসবাস করতো। শারজাহ আর্ট ফাউন্ডেশন (SAF) এর চালানো জরিপের ফলাফল জনসাধারণের মাঝে সরাসরি প্রকাশ করা হয়নি। তবে ২০১৯ সালে একটি ডকুমেন্টারি দ্য ল্যান্ডিং তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল।  

একটি তত্ত্বে উঠে আসে যে, বেদুইন জনসংখ্যাকে সুনির্মিত বসতি প্রদানের উদ্দেশ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের শা’বি প্রজেক্টের একটি অংশ ছিল এই আল-মাদাম গ্রাম। তবে এই গ্রামের বর্তমান অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, সরকারের নেয়া প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি।

এই গ্রামে বসবাসরত জনগণ হঠাৎ কেন তাদের সবকিছু ছেড়ে এই স্থান ত্যাগ করেছিল তা আজও একটা রহস্য হয়েই আছে। গ্রামের অবকাঠামোগত অবস্থা, প্রতিকূল পরিবেশ এবং মরুঝড়কে এর প্রধান কারণ বলে মনে করেন অনেক স্থানীয়রা।  

মরুঝড় Image source: Vox

তবে গ্রামটি পরিত্যক্ত হওয়ার পিছনে স্থানীয়দের মাঝে একটি বহুল প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে। তা হলো, এই গ্রামটি মূলত জ্বিনদের বাসস্থান। অনেকে বলে থাকেন, এই স্থানে “উম্মে আল দুওয়াইস” নামের একজন মহিলা জ্বিন বাস করে, যার চোখ বিড়ালের মতো এবং হাতে সর্বদা ধারালো অস্ত্র থাকে। 

উম্ম আল দুওয়াইস চরিত্রটি মূলত আরব সম্প্রদায়ের মাঝে বহু প্রজন্ম ধরে প্রচলিত। এই নারী জ্বিনকে মূলত রাতে দেখতে পাওয়া যায়। যেসকল পুরুষ খারাপ উদ্দেশ্যে রাতের বেলা নারীদের খোঁজ করতে থাকে, তাদের সামনে অতি সুন্দরী এক নারীর বেশে হাজির হয় উম্ম আল দুওয়াইস। এই নারী জ্বিনের শরীর হতে বেশ মিষ্টি এক ঘ্রাণের উদ্রেক হয় যা অসাধু পুরুষদের তার প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলে। 

উম্ম আল দুওয়াইস পথ হারিয়ে ফেলা তরুণ ভ্রমণকারী হিসেবে অসাধু পুরুষদের সামনে হাজির হয় এবং এক পর্যায়ে, তাদের কাছে টেনে তাদের মাথা শরীর হতে আলাদা করে ফেলে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই নারী জ্বিন রাতের বেলা এভাবেই অসাধু পুরুষদের শিকার করে থাকে, যার মূল বাসস্থান আল মাদাম গ্রাম।  

উম্ম আল দুওয়াইস। Image source: A LITTLE BIT HUMAN

স্থানীয়দের মতে, এখানে বসবাসরত স্থানীয়রা নানারকম অতিপ্রাকৃত ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল। এই জায়গার বালিগুলোতেও রহস্যজনক এমন কিছু আছে যার কারণে এটি বাড়িগুলোকে আক্রমণ করে গ্রামের লোকজনকে এই স্থান হতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।  

বর্তমানে এই গ্রামের ইতিহাস জানানোর মতো একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেকোনো পর্যটনকারী এই স্থানে গেলেই দেখতে পাবে, বাড়িগুলোর সুন্দর মোজাইক, আসবাবপত্রের অর্ধেকই বালির নিচে চাপা পড়ে আছে। এখানে নির্মিত মসজিদটিও বালির হাত থেকে রেহায় পায়নি। 

বালির নিচে পুরো গ্রামের অর্ধেকই চাপা পড়ে থাকায় এই গ্রামটিকে সমাধিস্থ গ্রাম বলা হয়। আল মাদাম গ্রামের আশেপাশে বসবাসরত অনেক পুরোনো স্থানীয়রা জানান, একসময় এই গ্রামে এমন এক রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল যার কারণে তারা এই গ্রামের কাছে আসারও সাহস পেতেন না। 

মরুভূমির বালিতে আচ্ছন্ন আসবাবপত্র Image source: monkonwheels

সন্ধ্যায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আল মাদাম 

জনশূন্য, নির্জীব আল মাদাম গ্রামের অতিপ্রাকৃত ঘটনার চেয়েও বিস্ময়কর রহস্য হচ্ছে, গ্রামটি সন্ধ্যায় অদৃশ্য হয়ে যায় এবং ভোরের আলোর সাথে সাথেই আবার দেখা মিলে। সত্যিকার অর্থেই এমনটা ঘটে থাকে বলে জনসাধারণের মাঝে গ্রামটি ভৌতিক গ্রাম হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। 

অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পেছনে বিজ্ঞানীরা কিছু ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। এর মাঝে একটি ব্যাখ্যা হলো, গ্রামটি রাতে মরুভূমির বালিতে তলিয়ে যায়। কেননা, এই গ্রামে রাতে ক্রমাগত হাওয়া চলতে থাকে যার ফলে হাওয়ায় উড়তে থাকা বালির আস্তরণে ঢাকা পড়ে যায় গ্রামটি। 

তবে এই ব্যাখ্যায় প্রশ্ন উঠিয়েছেন বিজ্ঞানীদের একাংশ। তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, যদি রাতের বেলা বালির আস্তরণে গ্রামটি ঢাকা পড়েই যায়, তাহলে দিনের আলোতে দ্রুত বালি সরে যেয়ে গ্রামটি দৃশ্যমান হয় কীভাবে? 

সন্ধ্যা হলেই গ্রামটি অদৃশ্য হয়ে বালির আস্তরণে, ফিরে আসে দিনের আলো ফুটার মধ্য দিয়ে। Image Source: atlasobcura.com

এই ঘটনার পেছনে আরেকটি ব্যাখ্যা রয়েছে যা কিছুটা যুক্তিসঙ্গত। ব্যাখ্যাটি হচ্ছে, দুবাই শহরের মরুভূমি আর সমুদ্র প্রায় কাছাকাছি অবস্থিত। তাই মরুভূমির কারণে ভূ-পৃষ্ঠের বাতাস দ্রুত গরম হয় আর উপরের দিকের বাতাস সমুদ্রের কারণে ঠান্ডা থাকে। ফলে নিচের দিকে যখন আলোর প্রতিসরণ ঘটে, তখন মনে হয় গ্রামটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। তবে প্রাকৃতিকভাবে ঘটা এই ঘটনার পিছনে কোনো মজবুত ব্যাখা আজও দাঁড় করাতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। 

যেভাবে বিশ্বের নজরে আসে 

২০১৮ সালের দিকে একজন ইউরোপীয় ইউটিউবার এসে আল মাদাম গ্রামের একটি ভিডিও ফুটেজ তৈরি করেন এবং তিনি ভিডিওতে জায়গাটিকে ভূতুড়ে বলে দাবি করার পর থেকেই এখানে ধীরে ধীরে বহু পর্যটন আসা শুরু করে। বর্তমানেও প্রতিদিন বহু পর্যটনের দেখা মিলে আল মাদাম গ্রামে। 

এই গ্রামের রহস্যময় ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা না থাকায় জায়গাটিকে পর্যটনদের কাছে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। দুবাইয়ের শিল্পায়নের আগে এই গ্রামের রাস্তার কাছে আসার অনুমতি না থাকলেও, বর্তমানে সকল পর্যটনই দিনের বেলা নির্জন এই গ্রামে ঘুরে বেড়াতে পারবে, অনুসন্ধান করতে পারবে বালির নিচে চাপা পড়ে থাকা গ্রামবাসীর পরিত্যক্ত বাড়িগুলোতে। 

বালির নিচে চাপা পড়ে থাকা আল মাদামের বাড়ি Image source: anique-ahmed

আরব আমিরাতের সরকারও বর্তমানে আল মাদামের খোঁজে আসা পর্যটনদের সাহায্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। অনেক পর্যটনের মতে, নির্জন এই গ্রামটি জনবহুল হলে এর আসল ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলবে। অবশ্য এই দেশের সরকারেরও আল মাদাম গ্রাম নিয়ে ভবিষ্যতে কিছু করার পরিকল্পনা নেই।

পরিত্যক্ত নির্জন এই গ্রামের আসল রহস্য কখনোই চূড়ান্তভাবে সমাধান করা সম্ভব হবে না। তবে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক অভিযাত্রীরা নিজেদের মনের আত্মতৃপ্তির জন্য এই গ্রামের রহস্যের টানে ছুঁটে আসেন। এই গ্রামে প্রবেশের পর থেকেই  সামগ্রিক শূন্যতা আর অশুভ নীরবতা যেকোনো অভিযাত্রীর সঙ্গী হয়ে তাকে ভাবতে বাধ্য করে, এখানে কি সে সত্যিই একা? নাকি স্নায়ু আর ইন্দ্রিয়ের সম্মিলিত ভ্রম সৃষ্টি হচ্ছে এখানে?  

 

 

 

Feature Image: localguidesconnect.com 
References: 

01. Explore the mysteries of the abandoned Al Madam ghost village near Dubai. 
02. Mysterious abandoned village becomes a lure for intrepid travellers. 
03. Haunting Photos of Al Madam, a Ghost Town Reclaimed by the Desert.