আল জানুব স্টেডিয়াম: কাতার বিশ্বকাপে শিল্পের ছোঁয়া

574
0

শিল্প এমন এক বিষয় যার কোন সুস্পষ্ট বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য প্রদান করা সম্ভব নয়। এই শিল্প বা সৌন্দর্যের উৎস কি তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কেউ বলে পরম সৌন্দর্যই মুখ্য আবার কেউ কেউ মানসিক অভিজ্ঞতাকেই শিল্পের ধারক ও বাহক হিসেবে দাবি করেন।

দার্শনিক হেগেলকে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে তিনি শিল্পকে কয়েকটি উপাদানে বিভক্ত করেছেন। তার মধ্যে স্থাপত্যকে প্রতীকী শিল্পের অন্তর্গত বলেছেন। আবার যদি কার্ল মার্ক্সের দিকে চোখ দেই, তাহলে দেখা যায় যে তিনি মানুষের সৃজনশীলতাকেই শিল্প হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

স্থাপত্যকলা শিল্প কি শিল্প না সে নিয়ে বিতর্ক আছে এবং থাকবে। তবে যা মানুষকে আনন্দ দেয়, যা সাধারণ চিন্তার বাইরে গিয়ে মানুষের মনে আবেগ অনুভূতির সৃষ্টি করে তাকে নান্দনিকতার বাইরে রাখা দুস্কর। সৌন্দর্য কেন্দ্রিক আলোচনা বা সৌন্দর্য উপভোগের মাধ্যম রয়েছে দুটি। একটি প্রাকৃতিক এবং অপরটি মানবসৃষ্ট শিল্প। প্রকৃতির কাজ যেখানে সৌন্দর্যের আধার হওয়া ঠিক তেমনি শিল্পের কাজও সৌন্দর্য সৃষ্টি করা।

এই সৌন্দর্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্নতায় আমরা যুগ যুগ ধরে স্থাপত্য শিল্পে পরিবর্তন দেখে আসছি। মিশরীয় সভ্যতা থেকে বর্তমান যুগ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর বিচরণ লক্ষণীয়। আর এই বিচরণ শুধুমাত্র মানুষের মধ্যে ধারণামূলক সৌন্দর্য সৃষ্টিতে নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও হয়ে থাকে। আর আজকে আলোচনা হবে সেই অর্থনৈতিক কেন্দ্রিক সৌন্দর্যের এক স্থাপনা নিয়ে। যার নাম কাতারের আল জানুব স্টেডিয়াম।

২০১৯ সালে উদ্বোধনের চিত্র Source: thepeninsulaqatar.com

কাতার বিশ্বকাপের অন্যতম ভেন্যু আল জানুব স্টেডিয়ামটি প্যারামেট্রিক স্থাপত্যশিল্পের অনন্য এক উদাহরণ। রাজধানী দোহা থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত স্টেডিয়ামটি আল ওয়াকরাহ নামক উপকূলবর্তী শহরে অবস্থিত।

২০১৯ সালে উদ্বোধন হওয়া স্টেডিয়ামটির ধারণ ক্ষমতা চল্লিশ হাজারের মতো যার অর্ধেক পরিমাণ সিট কাতার বিশ্বকাপের পর সরিয়ে নেওয়া হবে। বিখ্যাত জাহা হাদিদ আর্কিটেক্ট এবং এইকম (Aecom) এর যৌথ কর্মে এর নকশা করা হয়। এটি দেখতে কাতারের ঐতিহ্যবাহী ‘ধো’ নামক নৌকার মতো। এই নৌকার মাধ্যমে এক সময়ে পারস্য সাগরে কাতারের জেলেরা শিকারে যেত।

দৃষ্টিনন্দন এই স্টেডিয়ামটি বক্র আকারের। কোন স্থাপত্যশৈলির বহুমাত্রিকতা একটি স্থাপত্যকে অন্য স্থাপত্য থেকে ব্যতিক্রম করে তোলে। অর্থাৎ শুধুমাত্র আধুনিকতাই নয় তার সাথে সাথে স্থানীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে পারলে সেটির গ্রহণযোগ্যতা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

El estadio del Mundial 2022 por Zaha Hadid es inaugurado en Qatar | Architectural Digest
স্টেডিয়ামটির বক্রাকার রূপ। Source: Architectural Digest

আল জানুব স্টেডিয়ামটি সেই বহুমাত্রিকতারই পরিচয় দেয়। এটিকে পোস্ট মডার্নিজম এবং নিও মডার্নিস্ট নকশার একটি সমন্বয় হিসেবে বলা যেতে পারে। স্টেডিয়ামটিতে কাতারের ঐতিহ্য এবং আধুনিক বিশ্বের সব ব্যবস্থার সংমিশ্রণ হয়েছে।

কাতারের মসজিদগুলোর মতো স্টেডিয়ামটিও বহু গম্বুজ্ দ্বারা তৈরি বলে মনে হয়। ‘ধো’ নৌকাটিকে এর মূল থিম বলা হলেও এর নকশাটি অন্যান্য মাত্রার ইঙ্গিত দেয়। এছাড়াও এই নৌকার আদলে তৈরি করার মূল কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে আকৃষ্ট করা। কেননা ধো নৌকাটি এখন আর ব্যবহার হয় না।

স্টেডিয়ামটির ছাদের ওজন ৩৭৮ টন এবং এটি ৯২ মিটার উচ্চতার যার সম্পূর্ণটা স্টিল দ্বারা তৈরি। একে ওকুইলাম বিম নামেও ডাকা হয়। ছাদটি খেলার মাঠ থেকে ৫০ মিটার উপরে। বলে রাখা ভালো যে এই ছাদটি পরিচালনযোগ্য অর্থাৎ এটির মাধ্যমে দর্শক গ্যালারি ও মাঠের অংশ ছায়াবদ্ধ করা যাবে ও কুলিং সিস্টেম বজায় থাকবে।

ILoveQatar.net | Qatar Tourism announces refurbishment of 25 dhow boats in Qatar
ধো নৌকা Source: iloveQatar.net

পরিচালন করা এই অংশটি প্রতিসম আকারের। এটি মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যেই স্টেডিয়ামটিকে ক্লোজেট এরিয়াতে পরিণত করতে সক্ষম। এই অসাধারণ বিষয়টি রেডিয়াল মুভমেন্ট তথা ছাদের অংশটিকে ভাজ করা এবং কেন্দ্রিয় গার্ডারের ঝিল্লিকে মেকানিকালি কাজ করাতে পারে। এটি মূলত মেকানিকাল প্রিটোশিওনিং টেকনোলজির মাধ্যমে হয়েছে।

অপরদিকে, স্টেডিয়ামটির সম্মুখভাগের নকশাটি টেন্সাইল ফ্যাব্রিক দ্বারা সাজানো যা একে আলাদাভাবে সুন্দর করেছে। এছাড়াও আল জানুবের ছাদের ভিতরের কাঠামোগত নকশাটি গ্লাস এবং ব্রোঞ্জ দ্বারা তৈরি যেটি বাইরের সাদা অংশের সাথে খাপ খায়।

স্টেডিয়ামের মাঠ অর্থাৎ খেলার পিচটি সম্পূর্ণরুপে কাতারেই নির্মিত এবং অবাক করা বিষয় হচ্ছে যে এই টার্ফ বসাতে মাত্র ৯ ঘন্টা ১৫ মিনিট লেগেছে।

Al Janoub Stadium - sbp
পরিচালনযোগ্য ছাদ Source: SBP

কুলিং টেকনোলজি

কাতারের মতো গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়ার দেশে স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিশেষ করে বিশ্বকাপ চলাকালীন অবস্থায় ইউরোপীয়ান দেশগুলোর জন্য এখানে খাপ খাওয়ানোটা মুখ্য বিষয়। এরই প্রেক্ষিতে, আল জানুব স্টেডিয়ামটিতে কুলিং সিস্টেম টেকনোলজির ব্যবস্থা রয়েছে।

কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঘানি এবং তার বিশেষজ্ঞ দলটি হিটিং ভেন্টিলেশন এবং এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম এর ব্যবস্থা করেছেন। এর মাধ্যমে দর্শক সারিতে থাকা সবাই ঠান্ডা আবহাওয়া অনুভব করবে। এখানে ১০০ এর বেশি ভেন্টিলেশন ইউনিট থাকবে যা স্টেডিয়ামের নিচের এবং উপরের অংশকে ঠান্ডা রাখবে। বলা হচ্ছে এই ঠান্ডা বাতাসের প্রবাহ সর্বোচ্চ ১মি/সে।

এবার আসা যাক খেলার মাঠের কুলিং সিস্টেমের দিকে। বলা হচ্ছে এখানে ৮টি এয়ার হ্যান্ডিলিং ইউনিট থাকবে। এর চারটি পূর্ব দিকে এবং বাকি চারটি থাকবে মাঠের পশ্চিম দিকে। এর গতি হবে ১০ মি/সে। মূলত ঠান্ডা বুদবুদ সমৃদ্ধ অবস্থার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া ঘটানো হবে যেখানে বাতাস স্টেডিয়ামটির এক জায়গা থেকে আরেকজায়গায় আসা যাওয়া করতে থাকবে। এতে স্টেডিয়ামটির ছাদের ভূমিকা রয়েছে। কেননা ছাদটি সংকোচন করলেই এটি সম্ভব।

Qatar 'Dr Cool' keeps World Cup stadiums chilly with solar-powered AC
দর্শক সারিতে কুলিং সিস্টেম Source: Arynews.com

যদিও প্রশ্ন উঠতে পারে যে সম্পূর্ণ ছাদ বন্ধ না করেও কিভাবে স্টেডিয়ামটির আবহাওয়া স্থিতিশীল থাকবে? এর পেছনে রয়েছে এক্টিভেটিভ কুলিং কম্পোনেন্ট সিস্টেম। এর মাধ্যমে স্টেডিয়ামের তাপমাত্রা বৃদ্ধি হওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে।

পরিবহন ব্যবস্থা 

দোহা থেকে মাত্র ২৩ কিলোমিটার দূরে স্টেডিয়ামটি মূলত নব নির্মিত মেট্রো রেলের দ্বারা সংযোগ হয়েছে। আল ওয়াকরাহ স্টেশন থেকে এটি মাত্র সাড়ে চার কিলোমিটার দূরে এবং খেলা চলাকালীন দিনে শাটল বাসের ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া কাতারের উন্নত এক্সপ্রেসওয়ে তো আছেই।

এছাড়াও স্টেডিয়ামটি পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে দেখা যায় যে, এর পূর্ব পাশটি সর্বোচ্চ সংখ্যক দর্শক প্রবেশ -প্রস্থানের জন্য ব্যবহার হবে। স্টেডিয়ামটির বাইরে উত্তর পূর্ব পাশে একটি কমিউনিটি মার্কেট রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই মার্কেটটি মূলত খেলা না হওয়া দিনসমূহতে চালু থাকবে। এবং দক্ষিণ দিকে একটি এক্টিভিটি পার্ক থাকবে।

পশ্চিম অংশটি সম্পূর্ণরুপে খেলোয়াড় আসা যাওয়া এবং যানবাহনের জন্য। স্টেডিয়ামটি তেমন একটা ব্যবহার না হলেও ইতিমধ্যে সাস্টেনেবিলিটির জন্য কয়েকটি সনদ লাভ করেছে। তার মধ্যে জিএসএএস অন্যতম।

Al Janoub and Al Ersal parks reopen for sporting activities | The Peninsula Qatar
এক্টিভিটি পার্ক Source: ThepeninsulaQatar

জ্যামিতিকে অসাধারণভাবে ব্যবহার করে তৈরি এই স্টেডিয়ামটি কাতারের খেলাধুলার ইতিহাসে অন্যতম এক প্রজেক্ট। কয়েকটি গ্রুপ স্টেজের ম্যাচ এবং কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের আয়োজনের মাধ্যমে স্টেডিয়ামটি জাহা হাদিদের আরেকটি স্থাপত্যশৈলিকে তুলে ধরবে।

সম্পূর্ণ বিষয়টি অর্থনৈতিক হলেও এই অর্থনৈতিক চরিত্র হাসিলের জন্য আজকাল যে নান্দনিকতার সাহায্য নেওয়া হচ্ছে তা আসলেই অনন্য। স্থাপত্য শিল্প হোক বা না হোক, এটি যে মানুষের মধ্যে রুচিবোধ তৈরি করতে পারে তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

 

Feature Image: Besoccer.com 
References: 

01. FIFA Arenas: Al Janoub Stadium by Zaha Hadid. 
02. An architectural gem paying tribute to Zaha Hadid. 
03. Al Janoub Stadium in Al Wakrah. 
04. Al Janoub.