শীত মানেই বাহারি ও রঙিন ফলের সমারোহ। প্রতিটি মৌসুমেই আমরা বিভিন্ন মৌসুমী ফলমূল পেয়ে থাকি। প্রতিটি মৌসুমে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শরীরে বাড়তি পুষ্টির প্রয়োজন হয়। আর মৌসুমী ফলগুলো সেই পুষ্টির যোগান দেয়।
ষড়ঋতুর এই দেশে বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি ঋতু হচ্ছে শীত। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর, গাছের পাতায় জমে থাকা শিশির বিন্দু, ধোঁয়া উঠা পিঠাপুলি ও হরেক রকমের শাক-সবজি ও ফলমূল নিয়ে আবির্ভূত হয় এই শীতকাল। সারাবছর আর অন্যান্য ঋতুতে হরেক রকমের ফল পাওয়া গলেও শীতকালীন ফল অন্যান্য পুষ্টিমানের সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে।
শীতকালে সবারই ঠান্ডা জ্বর একটু না একটু লেগেই থাকে আর বিভিন্ন রোগের সংক্রমণও এই ঋতুতে বেশি পরিলক্ষিত হয়। তাই এই ঋতুতে নিজেকে সুস্থ রাখতে চাই বাড়তি যত্ন। শীতকালীন ফল এই বাড়তি যত্ন রাখার ক্ষেত্রে বেশ বড় ভূমিকা পালন করে। তাই আমাদের জানা উচিত শীতকালীন এই বৈচিত্র্যময় সকল ফলমূলে কত ও কি ধরনের উপকারিতা রয়েছে।
জলপাই
জলপাই শীতকালীন এমন একটি ফল যা আমাদের সমস্ত প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে শীতের মৌসুমে। শীতকালীন ফলের মধ্যে সবচেয়ে সহজলভ্য ও পুষ্টিতে সেরা একটি ফল হচ্ছে জলপাই। জলপাইয়ে রয়েছে ভিটামিন এ, ই এবং অন্যান্য খনিজ উপাদান। জলপাই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের একটি ভালো উৎস যা আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।
এজন্যই শরত এবং শীতের মতো ঠান্ডা মৌসুমে বেশি করে জলপাই ও জলপাই তেল খাওয়ার নির্দেশ দেন চিকিৎসকরা। জলপাই যেমন অভ্যন্তরীণভাবে আমাদেরকে ভালো রাখে ঠিক তেমনই বাহ্যিকভাবেও এটি বহুল ব্যবহৃত একটি ফল যার তেল শীতকালে সারাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় ত্বকের সুরক্ষায়।
জলপাইয়ে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা ৯, যাকে অলিক এসিডও বলা হয়। এর প্রধান কাজ হলো রক্তচাপ কমানো। কার্ডিওভাসকুলারের মতো রোগ প্রতিরোধ করে রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড কমে যায় নিয়মিত জলপাই খেলে।
লেবু
শীতকালীন ফলের কথা বললে প্রথমেই যেই ফলটি মাথায় আসে সেটি হচ্ছে লেবু। আমরা সবাই জানি যে লেবু ভিটামিন সি এর এক সমৃদ্ধ উৎস। আর এই ভিটামিন সি শীতকালে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
লেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি যা আপনাকে শীতকালীন সর্দি কাশি থেকে রক্ষা করবে। ঠান্ডা বা নাক দিয়ে পানি পড়ার মতো সমস্যায় উষ্ণ লেবু পানি আপনাকে এই সমস্যা থেকে দূরে রাখবে। শীতকালে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসজনিত রোগ বেশি দেখা যায়। এর ফলে সারা শীতকালজুড়ে মানুষ নানা ধরনের সর্দি কাশিতে ভুগতেই থাকে।
লেবু পানি আপনাকে এই ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি দিবে। এছাড়া লেবু ইনসুলিন এর কার্যকলাপকে বৃদ্ধি করে ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে। শরীরের অভ্যন্তরকে ভালো রাখার পাশাপাশি লেবু আপনার ত্বককেও উজ্জ্বল করে তোলে।
আমলকি
শীতকালে ঠান্ডা সর্দির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে যে ফলটি খাওয়া হয় সেটি হচ্ছে আমলকি। আমলকি নিঃসন্দেহে পুষ্টির একটি পাওয়ার হাউস। আমলকি খুবই সুস্বাদু একটি ফল যদিও কিছুটা তিতকুটে কারো কাছে।
আমলকি ভিটামিন সি এর একটি প্রাকৃতিক উৎস এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আমলকিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বার্ধক্য রোধ করতে সাহায্য করে ও কোষের সেলুলার গঠণকে পুনর্জীবিত করে। এর ফলে ব্যক্তি দীর্ঘ সময় শারীরিকভাবে সুস্থ ও তরুণ থাকেন।
সর্দি কাশির মতো ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসজনিত রোগ প্রতিরোধ করতে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে আমলকি। আপনি আমলকির ফলের রস, পাউডার বা সম্পূর্ণ তাজা ফল হিসেবেও খেতে পারেন নিয়মিত।
বরই
শীতকালীন আরেকটি মুখরোচক ফল হচ্ছে বরই যা নারী-পুরুষ উভয়ের কাছেই প্রিয়। বরইতে কমলার চেয়েও বেশি ভিটামিন সি রয়েছে। বরই খাওয়ার মাধ্যমে যেমন আপনি আপনার ত্বক ও শরীরকে সুস্থ রাখতে পারেন ঠিক তেমনি রূপচর্চাতেও এর জুড়ি মেলা ভার।
শীতকালীন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ও প্রতিরোধে বরই বেশ শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। বরইতে ভিটামিন এ, সি, কে, ফাইবার, ম্যাঙ্গানিজ, অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের মতো বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান রয়েছে। বরই ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে কোষকে রক্ষা করে।
ওজন কমানোর ক্ষেত্রে বরই বেশ বড় ভূমিকা রাখে। যেসব রোগীদের কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা রয়েছে তারা এই সমস্যা দূর করতে নিয়মিত বরই খেতে পারেন।
শীতকালীন এই ফলটিতে রয়েছে ফাইবার যা আপনার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাকে দ্রবীভূত করতে সাহায্য করবে। বড়ইতে থাকা পটাশিয়াম শরীরে সোডিয়ামের মাত্রা কমিয়ে রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
আপেল
পার্বত্য উত্তরাঞ্চলের ভারতীয় বংশোদ্ভূত ‘আপেল’ শীতের মৌসুমে পাওয়া অন্যতম একটি ফল। আপেলে রয়েছে ফাইবার, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান।
আপেলে রয়েছে পেকটিন যা একটি দ্রবণীয় ফাইবার এটি আপনার অন্ত্র থেকে পানি শোষণ করে হজম প্রক্রিয়াকে ধীর করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করে।
আপেলে উপস্থিত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হার্ট-অ্যাটাক, থ্রম্বোটিক স্ট্রোক ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। আপেলে থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হলো ভিটামিন সি যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
তাই শীতকালে প্রতিদিন আপেল খাওয়া হতে পারে আপনার জন্য বেশ উপকারী। যাদের অ্যালজাইমার সমস্যা রয়েছে সেই ঝুঁকিও কমিয়ে আনে সুস্বাদু এই ফল আপেল।
কমলালেবু
ভিটামিন সি তে ভরপুর একটি ফল হচ্ছে কমলালেবু। সামান্য টক, মিষ্টি ফলটিতে ভিটামিন সি, ফাইবার, পটাশিয়াম এবং থায়ামিন রয়েছে। ভিটামিন সি শীতকালে আপনাকে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে।
নিয়মিত কমলা খেলে ক্যান্সার ও কিডনি রোগের ঝুঁকি কমে। যাদের রক্তস্বল্পতার সমস্যা রয়েছে তারা নিয়মিত কমলালেবু খেলে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবেন কারণ কমলালেবুতে থাকা ফোলেট অ্যানিমিয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের সুত্রে সাইন্স ডেইলিতে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, সাইট্রাস ফল বিশেষ করে কমলালেবু খেলে স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে আসে।
পেয়ারা
পেয়ারা একটি মিষ্টি জাতীয় শীতকালীন ফল। পেয়ারাতে রয়েছে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, আয়রন, ফোলেট, পটাশিয়াম, কপার এবং ফাইবার। শীতের মৌসুমে নিয়মিত পেয়ারা খেলে এটি আপনার কোষের ক্ষতি এবং প্রদাহ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
পেয়ারাতে থাকা প্যাকটিন হজমশক্তি বাড়ায় এবং কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। শীতকালে সর্দি কাশির মতো ভাইরাল সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পেয়ারার রস খুবই উপকারী। পেয়ারা খেলে হার্ট ভালো থাকে এবং রক্তের শর্করার পরিমাণ কমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে।
Feature Image: pixabay.com References: 01. 7 Winter Fruits and Their Health Benefits. 02. Benefits of olives in fighting the cold. 03. 13 Benefits of Drinking Warm Lemon Water in the Morning (It’s Good for You). 04. 8 Impressive Health Benefits of Apples. 05. Why You Should Eat Oranges During Winter. 06. 6 Reasons For You To Have Guavas (Amrood) This Winter Season!