অ্যাডাম রেইনার: বামন থেকে দৈত্যাকৃতির মানবে পরিণত হবার করুণ গল্প

825
0

মানবদেহ অত্যন্ত অদ্ভুত আর বেশ রহস্যময় এক সৃষ্টি। কতটা পরিপূর্ণ, নিখুঁত আর সুগঠিতভাবে বিন্যস্ত দেহের কাঠামো আর প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। এমনকি প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও এই শৃঙ্খলিত গঠনেও মাঝে মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যেটার বাংলা ব্যাধি হলেও ডাক্তারি পরিভাষায় ডিজঅর্ডার বলা হয়ে থাকে। এই ডিজঅর্ডারগুলো নানান কারণে হতে পারে। এমনকি বংশগত কারণেও হতে পারে। এই ডিজঅর্ডারগুলো দেখা দিলে শরীরে নানান রকম সমস্যা দেখা দেয়। যার ফলে দৈহিক কাঠামোতে আসতে পারে অভাবনীয় পরিবর্তন। স্বাভাবিক উচ্চতার একজন এমন ডিজঅর্ডারের কারণে হয়ে যেতে পারে বামনাকৃতি; আবার হয়ে যেতে পারে দৈত্যাকৃতি। 

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। তবে সবকিছুতেই একটা যেমন ব্যতিক্রম থাকে। ঠিক তেমনি অসংখ্য ঘটনার ভিড়ে একটি ব্যতিক্রম কেস হচ্ছে অ্যাডাম রেইনার। অস্ট্রিয়ান এই নাগরিক জন্মেছিলেন বামন আকৃতির খেতাব ধারণ করে। কিন্তু যৌবন আর পরিণত বয়স যত দ্রুতই এগিয়ে এসেছিল তার জীবনে ততই দৈত্যাকৃতির হয়ে উঠেছিলেন রেইনার। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সতিই। খুব সম্ভবত অ্যাডাম রেইনারই পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যিনি একইসঙ্গে একজন বামন এবং একজন দৈত্যাকার মানব হিসেবে পরিচিত। আজকের আয়োজনটা এই অদ্ভুত মানবের রহস্যময় জীবনের করুণ পরিণতিকে ঘিরেই। 

১৮৯৯ সালে অস্ট্রিয়ার গ্রাজ শহরে জন্মগ্রহণ করেন অ্যাডাম রেইনার। তার পিতামাতা উভয়ই স্বাভাবিক গড় উচ্চতাসম্পন্ন ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সেনাবাহিনীতে ঢুকার জন্য চেষ্টা করেন। তখন রেইনার উচ্চতায় মাত্র ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি ছিলেন। সেবার বাদ পড়ে যান রেইনার। ডাক্তাররা তার উপর কয়েকটি পরীক্ষা চালায়। একজন কর্মঠ ও উদ্যম সৈন্য হবার পক্ষে তাকে ছোট এবং দুর্বল বলে বাদ দেয়া হয়। 

অ্যাডাম রেইনারের ছোটবেলার ছবি। Image Source: mysteriousuniversity.com

পরের বছর আবারও চেষ্টা করেন সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্ত হবার। আগের বারের চাইতে এবার দুই ইঞ্চি বৃদ্ধি পেয়েছিল লম্বায় তিনি। কিন্তু এবারও তাকে বাদ দেয়া হয়। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ডাক্তাররা তাকে বামন গোত্রীয় বলে বিবেচিত করে। ১৯ বছর বয়সে ৪ ফুট ৮ ইঞ্চির উচ্চতা নিয়েও রেইনার বামন উপাধি পায়। তবে ডাক্তারদের কাছে সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয় ছিল, তার শরীরের উচ্চতার পরিমাপে তার হাত এবং পা অস্বাভাবিক রকমের বড় ছিল। 

প্রথমবার সেনাবাহিনীতে যখন রেইনার পরীক্ষা দেয় সেবার তার জুতোর মাপ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিসেবে ১০ এবং ইউরোপের হিসেবে ৪৩ সাইজের। কিন্তু তিন বছরের ব্যবধানে তার পায়ের মাপ হয়ে দাঁড়ায় দ্বিগুণ। ২০ এবং ৫৩ সাইজের জুতোর দরকার হয় তার তিন বছরের পার্থক্যে। অবশ্য সেই সময়টাতে তার উচ্চতা তুলনামূলকভাবে স্থিরই ছিল বলা চলে। কিন্তু ২১ বছর বয়স থেকেই সবকিছু বদলে যেতে শুরু করে।  

এক বছর পর, রেইনার আরো দুই ইঞ্চি বৃদ্ধি পায় লম্বায়। ব্যাপারটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়; বরং আশাব্যঞ্জক বলা চলে। ১৯২০ সালেও রেইনার লম্বায় মোটামুটি খাটোই ছিলেন এবং শারীরিকভাবে ছিলেন দুর্বল, ক্ষীণ আর দেখতেও কৃশকায় বা হাড্ডিসার। সাধারণত ২১ থেকে ২৫ বছর বয়স পর্যন্তই একজন সাধারণ মানুষের উচ্চতা বাড়ার শেষ সময়কাল বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। কিন্তু, ব্যাপারটা রেইনারের ক্ষেত্রে তার বাকি জীবনের সমতুল্য ছিল। 

একটি শিশুর পাশে অ্যাডাম রেইনার। Image Source: businessinsider.com

বিপত্তি ঠিক তখনই ঘটা শুরু করে যখন রেইনার স্বাভাবিক হিসাবে দুই ইঞ্চি না বেড়ে অনেক বেশি পরিমাণে বাড়তে শুরু করে। তার এই অনবরত বাড়ন্তের বিষয়টা এতটাই দ্রুতগতির আর চলমান ছিল, ডাক্তাররা ব্যাপারটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। এরকমভাবে চলমান জীবনে অ্যাডাম রেইনার এক দশক পরে প্রায় দুই ফিট বেড়ে যায় উচ্চতায়। তার উচ্চতা তখন গিয়ে ঠেকে সাত ফিট এক ইঞ্চিতে। চিকিৎকরা একদম হতভম্ব হয়ে যায়। এটা কি করে সম্ভব? এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণটা কি? 

১৯৩০ এবং ৩১ সাল পুরোটা জুড়ে দুজন ডাক্তার, এ. ম্যান্ডল এবং এফ. উইন্ডহোলজ রেইনারকে পরীক্ষা করা শুরু করলেন। শুরুতে তারা যা সন্দেহ করলেন তাই মূলত শেষমেষ ফলাফল হিসেবে বেরিয়ে আসলো। অ্যাডাম রেইনার এমন একটা ব্যধিতে ভুগছেন যেটা অ্যাক্রোম্যাগেলি নামে পরিচিত। অ্যাক্রোম্যাগেলি এমন একটি রোগ যা শরীরের বাড়ন্ত হরমোনের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে হয়ে থাকে। ফলে হাত-পা এমনকি দৈহিক গড়ন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায় বয়সের তুলনায়। অ্যাক্রোম্যাগেলি মূলত একটি বিরল রোগ। 

রেইনারের ক্ষেত্রে, তার পিটুইটারি গ্রন্থিতে একটি টিউমার হবার কারণে এমনটা হচ্ছিল। টিউমারটার জন্য তার শরীরের বাড়ন্ত হরমোন পরিমাণের চাইতে বেশি উৎপাদন করছিল। রেইনারের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ ছিল এটাই। এই বিরল রোগের ক্ষেত্রে যেটা হয় যে, রোগীর হাত-পা অস্বাভাবিক হারে বড় হয়ে যায়। তবে রেইনারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা শুধু হাত আর পা এবং দৈহিক গড়নেই সীমাবদ্ধ ছিল না। 

স্বাভাবিক গড় উচ্চতার একজন মানুষের পাশে অ্যাডাম রেইনার। Image Source: allthatinteresting.com

বরং কপাল এবং চোয়ালের বাড়ন্ত হাড়ের কারণে তার মুখমন্ডলও ব্যাপক প্রসারিত হয়ে গিয়েছিল। তার ঠোঁট পুরু হয়ে গিয়েছিল এবং দাঁত থেকে দাঁতের দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল দ্বিগুণ। বাড়ন্ত হাড়ের কারণে তার মেরুদণ্ডজনিত সমস্যাও প্রকটরূপে দেখা দিয়েছিল। তার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির কারণে মেরুদণ্ড বাড়তে বাড়তে একসময় তা বাঁকাতে শুরু করে জায়গা সংকুলান না হওয়াতে। 

টিউমারটি অপারেশন করে বের করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আদতে কাজটা ছিল অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এবং অপারেশন সফল হবার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ধারণা করা হয়, টিউমারটি প্রায় দশ বছর সময় ধরে বেড়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষমেষ টিউমারটি অপসারণ করতে সক্ষম হয় ডাক্তারেরা। অস্ত্রোপাচার সফল হয়। 

অস্ত্রোপাচারের কয়েক মাস পরের কথা। রেইনার চিকিৎকদের কাছে পুনরায় গেলেন চেকআপ করাতে। এই কয়েক মাসে যে তার উচ্চতা এক বিন্দুও বাড়েনি তাতে বেশ খুশীই হলেন ডাক্তার দুজন। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। তার মেরুদণ্ড যে বাড়ন্ত হাড়ের কারণে বাঁকিয়ে গিয়েছিল সেই ন্যুব্জতা এখন বেশ বিপাকে ফেলে দিয়েছে রেইনারকে। ব্যাপারটা মোটেও খুশীর সংবাদ নয়। এর মানে হচ্ছে বাহ্যিক বাড়ন্ত ভাবটা না আসলেও ভেতরে ভেতরে ঠিক বেড়েই চলেছে অ্যাডাম রেইনার; যদিও তা খুবই ধীর গতিতে।  

অ্যাডাম রেইনারের বিবর্ধন। Image Source: businessinsider.com

এরপর ধীরে ধীরে রেইনারের শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হতে শুরু করলো। প্রথমে তিনি তার শ্রবণশক্তি হারালেন। তারপর দৃষ্টিশক্তি হারালেন, তবে সেটা কেবল একটা চোখের। আর এসবের মধ্যে তার মেরুদণ্ডের ন্যুব্জতা আরো এত বাঁকিয়ে গেল যে হাঁটাচলা কিংবা বসে থাকাও তার জন্য পীড়াদায়ক ছিল। তাই শুয়ে থাকা ব্যতীত দ্বিতীয় আর কোনো উপায় রইলো না অ্যাডাম রেইনারের কাছে। 

৫১ বছর বয়সে অ্যাডাম রেইনার যখন মারা যান তখন তার উচ্চতা ছিল ৭ ফুট ৮ ইঞ্চি। যদিও কিছু পত্রিকায় লেখা হয়েছিল এবং এখনো হয় যে, মৃত্যুর সময় রেইনারের উচ্চতা ছিল ৭ ফুট ১০ ইঞ্চি। বামন থেকে দৈত্যাকৃতি হবার এমন অদ্ভুত ঘটনা অ্যাডাম রেইনারকে জনপ্রিয়তা দিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তার করুণ পরিণতি মানুষকে কাঁদিয়েছিলও বটে। জীবদ্দশায় একজন বামন অভিহিত হওয়া মানুষই আবার দৈত্যাকৃতি উপাধি পাবার ঘটনা হয়তো এইটা ইতিহাসে প্রথম। অ্যাডাম রেইনার – মানবদেহের বিস্ময়ের প্রমাণ দেয়া এক ব্যক্তির নাম। 

Feature Image: sciencefacts.org
তথ্যসূত্রসমূহ:

01.The Insane Story Of A Man Who Was Born A Dwarf And Died A Giant.
02. Adam Rainer – The Only Man On Earth Who Was Dwarf And Giant In The Same Life.
03. Both a Dwarf and a Giant: The Curious Case of Adam Rainer.
04. From Dwarf To Giant — The Tragic Story Of Adam Rainer.