সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবি। আরব আমিরাতের সাতটি আমিরাত বা রাজ্যের মধ্যে বৃহত্তম এই রাজ্যটি দখল করে আছে পুরো সংযুক্ত আরব আমিরাতের শতকরা ৮৭ ভাগ। দেশটির মোট উৎপাদিত তেলের ৯৭ শতাংশ আসে আবুধাবি থেকে।
আরব আমিরাতের ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতির দুই তৃতীয়াংশই আবুধাবির অবদান। এই শহরে রয়েছে আকাশচুম্বী অট্টালিকা, দৃষ্টিনন্দন পার্ক এবং বাগান। বিলাসবহুল শপিংমল এবং হোটেলের স্বর্গরাজ্য আবুধাবি।
‘আবু’ এবং ‘ধাবি’ শব্দ দুটি আলাদা করে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘গেজেলের পিতা’। গেজেল এক জাতের হরিণ। বহু বছর আগে এই জাতের হরিণের আনাগোনা অঞ্চলটিতে ব্যাপক হারে ছিল বিধায় সেখান থেকে শহরটির নাম করা হয় আবুধাবি।
এমন অদ্ভুত নামের এই শহরটি বর্তমানে শিল্প, সংস্কৃতি, স্থাপত্যকলার দিক থেকে পৃথিবীর প্রথম সারির একটি শহর। বলা হয়ে থাকে, বিত্তশালীদের কাছে এটি পৃথিবীর মাটিতে স্বর্গস্বরূপ।
কথিত আছে, ১৭৬১ সালের দিকে একদল বেদুইন হরিণ তাড়া করতে গিয়ে পৌঁছায় অজ্ঞাতনামা এক মরুদ্যানে যা কিনা আজকের আধুনিক আবুধাবি। ক্রমেই এখানে গড়ে উঠলো বসতি, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে জেলে পাড়ার উদ্ভব ঘটে এই জায়গাটিকে কেন্দ্র করে।
১৯৬০ সালে বিশাল তেলের খনির সন্ধান পাওয়ার আগে আবুধাবি ছিল নিছকই একটি সমুদ্র তীরবর্তী ছোট্ট শহর। সমুদ্র থেকে মুক্তা সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন এখানকার স্থানীয়রা। সেই সময় অগভীর আরব্য উপসাগর ছিল ঝিনুক হতে মুক্তা সংগ্রহের উপযোগী।
অথচ আজ থেকে একশ বছর আগে আবুধাবি ছিল নিছকই গরিব এক অঞ্চল। এখানকার অধিবাসীদের নূন্যতম মৌলিক চাহিদাটুকুই পূরণ হতো অতি কষ্টে। কিন্তু শেষ ১০০ বছরে আবুধাবিতে আসে অবিস্মরণীয় পরিবর্তন যা তখনকার দিনে কেউ হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি।
সেই সময় প্রায় হাজারের উপর নৌকা এক টানা ১২০ দিনের জন্য সাগরে ভেসে বেড়াতো। উদ্দেশ্য, মুক্তা সংগ্রহ। গ্রীষ্মের শুরুতে নৌকা ভাসানো হতো। তারপর নৌকাগুলো মুক্তাসমেত ফিরে আসতো সেপ্টেম্বরে।
কিন্তু আবুধাবি মুক্তা সংগ্রহ শিল্পের ছন্দপতন ঘটলো জাপানিদের কারণে। তখন জাপানে আবিষ্কৃত হলো কৃত্রিম মুক্তা তৈরির প্রক্রিয়া। ফলে এই এই অঞ্চলে এই শিল্পের পরিসমাপ্তি ঘটে।
ভাগ্যক্রমে ১৯৫৮ সালের দিকে আবিষ্কৃত তেলের খনি এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য খুলে দেয়। সেই তখন থেকে আধুনিক আবৃুধাবির পথচলা শুরু এবং এই আধুনিক আবুধাবির জনক ছিলেন তৎকালীন আমির জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান।
১৯৭১ সালে ৭টি রাজ্য মিলিত হয়ে গঠিত হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়ে মসনদে বসেন শেখ জায়েদ বিন সুলতান।
বর্তমানে পৃথিবীর মোট মজুদকৃত তেলের শতকরা ৯ ভাগ এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের শতকরা ৫ ভাগ রয়েছে আবুধাবির দখলে। পৃথিবী শীর্ষস্থানীয় তেল কোম্পানির মধ্যে অন্যতম ‘অ্যাডনক’ বা আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি।
শুধুমাত্র তেলের উপর নির্ভর করে আবুধাবী টিকে আছে এমনটি ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। শহরটিতে রয়েছে পাইপ রোলিং প্ল্যান্ট, সিমেন্ট প্ল্যান্ট এবং বাড়ি নির্মাণে ব্যবহৃত সামগ্রীর বিশাল শিল্প কারখানা।
বর্তমানে আবুধাবীর মোট জনসংখ্যা ১৫ লক্ষ ৬৭ হাজার। তবে এর অধিকাংশই বিদেশী। এখানে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত দক্ষ জনশক্তির একটি বিরাট অংশ আমেরিকা এবং ইউরোপীয় দেশের নাগরিক।
তবে অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত যারা, যেমন ট্যাক্সি ড্রাইভার তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ উগান্ডা, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান থেকে আসে।
পৃথিবীর বিখ্যাত রন্ধনশিল্পের অনন্য নিদর্শনের দেখা মেলে আবুধাবিতে। এখানকার বিলাসবহুল হোটেলগুলো গ্রাহকদের চাহিদামতো পরিবেশন করে থাকে হরেক রকমের সুস্বাদু খাবার।
তবে স্থানীয় খাবারগুলোর মধ্যে ভাত এবং ভেড়ার মাংসের নানারকম মুখরোচক ডিস চোখে পড়ে বেশি। সাথে পরিবেশন করা হয় হোমোস, সালাদ এবং নানা রকমের রুটি। তবে মুসলিম প্রধান দেশ বিধায় হোটেল ছাড়া যেখানে সেখানে পর্ক বা শূকরের মাংস এবং মদ বিক্রি নিষিদ্ধ।
সারা পৃথিবী থেকে অসংখ্য পর্যটক আবুধাবিতে আসেন কেনাকাটা করতে। এখানে রয়েছে স্থানীয় কিছু আরবীয় বাজার এবং দৃষ্টিনন্দন শপিংমল। এখানকার বিমান বন্দরে পাওয়া যায় ডিউটি-ফ্রি পণ্য।
স্থানীয় আরবীয় বাজারগুলোতে রয়েছে অ্যান্টিক গহনা, দারুন সব কার্পেট, সোনার জিনিসপত্র এবং স্যুভিনিয়র। এছাড়া, সুন্দর পোশাক পরিচ্ছদ, বিভিন্ন জাতের মশলা, বেদুইনদের গহনা, প্রসাধনী ইত্যাদিও বেশ ভালো দামে বিক্রি হয়।
তবে বাইরের দেশের ভ্রমনকারীদের কাছে শপিংমলগুলোর আবেদনই আলাদা। সকাল দশটা থেকে শুরু হয়ে মাঝরাত অবধি এখানে বেচাকেনা চলে। উল্লেখযোগ্য দুটো শপিংমল হলো মেরিনা এবং আবুধাবি মল।
প্রতি বছর এখানে অনুষ্ঠিত হয় ‘আবুধাবি কেনাকাটা উৎসব’। এই উৎসবে ইচ্ছামতো দামদর করার সুযোগ ছাড়াও আরো রয়েছে আকর্ষণীয় পুরস্কার জেতার সুযোগ।
বিত্তবানদের কাছে আবুধাবি আনন্দ আর উল্লাসের শহর। রাতের ঝলমলে আলোয় আবুধাবি যেন এক অন্যরূপ ধারণ করে। ব্রিটিশ থিমে গড়া পাব এবং বারগুলোতে প্রতি বুধ এবং শুক্রবারে দারুণ ভিড় হয়। দুজনের জন্য সর্বোচ্চ বারো হাজার বাংলাদেশি টাকায় স্টেক এবং ককটেলের স্বাদ নিতে পারে যে কেউ।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ হাতের কাজ করা কার্পেটের অবস্থান এই আবুধাবিতে। আবুধাবির আকর্ষণীয় এবং চোখ ধাঁধানো স্থাপনার একটি হলো শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ। এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের সর্ববৃহৎ মসজিদ। এখানেই বিছানো হয়েছে ৫ হাজার বর্গমিটারের এই বিরাট কার্পেট যেখানে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা।
শেখ জায়েদ একটি বিরাট একটি প্রাসাদসম মসজিদ। একসাথে চল্লিশ হাজার মানুষ এখানে নামাজ আদায় করতে পারেন। বারো বছর সময় ব্যয় করে নির্মাণ করা হয়েছে এই মসজিদটি।
প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত আবুধাবির অ্যামিরেটস হোটেল। এই হোটেলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে যা কিছুই ঝলমল করে তাই সোনার তৈরি। এমনকি এখানে সোনা দিয়ে দেয়া হয় বিশেষ ফেস ম্যাসেজ সেবা।
আবুধাবি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে সরকার কর্তৃক গৃহিত অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-কে সামনে রেখে। এই প্রকল্পের অন্য অনেক উৎসগুলোর একটি হলো আবুধাবিতে টেকসই অর্থনীতি গড়ে তোলা।
এছাড়া, কার্বন নিরপেক্ষ অঞ্চল নির্মাণের লক্ষ্যে নির্মান করা হয়েছে বিশাল বড় বড় সোলার প্যানেল যা হাজার হাজার ঘর বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম।
আবুধাবি বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে তাদের নির্মিত ‘ইয়াস দ্বীপ’ এর মাধ্যমে। এখানে রয়েছে বিলাস যাপনের নানা সামগ্রী, হোটেল, থিম, পার্ক এবং রেস্টুরেন্ট। বিশ্বের তাবৎ ধনকুবের তাদের দামি ইয়ট বা প্রমোদতরী নিয়ে অবকাশ যাপনে এখানে এসে থাকেন। এখানে আরো রয়েছে ফর্মুলা ওয়ান রেসিং কারের জন্য বিশাল এবং বিলাসবহুল রেসকোর্স।
Feature Image: timeoutabudhabi.com References: 01. Abu Dhabi: Oil-Rich Capital of the UAE. 02. Yas Island Abu Dhabi Emirate of Abu Dhabi Vacations. 03. Lifestyle Abu Dhabi. 04. Nightlife in Abu Dhabi. 05. 7500 Years of Abu Dhabi.