রেলগাড়ি ঝমাঝম
পা পিছলে আলুর দম
মাস্টারবাবু বলে গেছেন
ইস্টিশনের মিষ্টি গুড
শখের বাগান গোলাপফুল!
এতদাঞ্চলের লোকজীবন ও সংস্কৃতির ওপর রেলগাড়ির যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে তা বহুল প্রচলিত এই লোকছড়াতেই প্রকাশ পায়। কোনো ভূখণ্ড জীবনব্যবস্থার দিক থেকে কতটুকু উন্নত সেই সূচক যেসব বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, যোগাযোগ ব্যবস্থা বোধহয় তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে কোনো নির্দিষ্ট এলাকার শিল্প-সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের পরিবেশ। অন্তত বাংলাদেশে রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার (Bangladesh Railway) ইতিহাস তেমনটাই জানান দেয়। আজকের লেখায় থাকছে বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার সূচনা থেকে বর্তমান পর্যন্ত নির্বাচিত প্রাসঙ্গিক আলোকপাত।
জগতির কথা
১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর ছিল ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। এই দিনেই প্রথমবারের মতো কলকাতার রাণাঘাট থেকে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার জগতি পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ চালু হয়। এই রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল ৫৩.১১ কিলোমিটার। এটা ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক বিরাট বিপ্লব। বিশেষত বঙ্গ জনপদে উন্নতির ছোঁয়া লাগে এর ফলে।
পরে ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারিত হয়। ধীরে ধীরে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন দক্ষিণাঞ্চল বাদে বাকি সমগ্র বাংলাদেশ রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় চলে আসে। আজকের বৃহত্তর বরিশাল রেল যোগাযোগের আওতায় আসার কথা থাকলেও অভ্যন্তরীণ জটিলতায় তখন সেটা আর হয়ে ওঠেনি। তবে যারা প্রবীণ বরিশালবাসী, তাদের যাতায়াতের উপায় ছিল কলকাতা থেকে খুলনা পর্যন্ত রেলপথে এসে সেখান থেকে পুনরায় স্টিমারযোগে নিজ নিজ গন্তব্য। এর প্রমাণ বিখ্যাত সুরকার এবং সঙ্গীতশিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বিবৃতিতে পাওয়া যায়—
একটু যখন বড়ো অইলাম, দ্যাশের জন্য মন-কেমন করলেই বরিশাল এক্সপ্রেসে চাইপ্যা খুলনা অইয়া ইস্টিমারে ঝালকাঠি দিয়া দ্যাশের বাড়ি যাইতাম।
খুলনা হয়ে বরিশাল যাবার যেই লাইনটি ছিল সেটি ১৯১৮ সালের দিকে বাগেরহাট পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। খুলনার রূপসা থেকে বাগেরহাট পর্যন্ত মোট দশটি স্টেশন ছিল। আর এই পথের দূরত্ব ছিল ৩২ কিলোমিটার। প্রায় আট দশক পরিষেবা চলার পর ১৯৯৮ সালে এই রুট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
জগতি স্টেশনের আত্মপ্রকাশের দুই দশকের মধ্যেই পদ্মার বাম তীর ঘেঁষে সারা থেকে চিলাহাটি হয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত ২৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত একটি রেললাইন স্থাপন করে ব্রিটিশ সরকার। এর নাম দেয়া হয় নর্থ বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে। কাউনিয়া-পার্বতীপুর-দিনাজপুরকে যুক্তকারী এই রেললাইনের সমসাময়িক আরেকটি রেললাইন স্থাপিত হয় ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের তত্ত্বাবধানে।
এই ব্রডগেজ রেললাইনটি পদ্মার ডান তীরের দামুকদিয়া থেকে পোড়াদহ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তখনকার সময়ে রেলওয়ে বিভাগ নিয়ন্ত্রিত রেলওয়ে ফেরি ব্যবহার করে নদীপথ পাড়ি দেওয়া হতো। একইসাথে সর্বোচ্চ তেরটা বগি নিয়ে ফেরি নদী পাড়ি দিতে সক্ষম ছিল। যমুনা বহুমুখী সেতু উদ্বোধনের পর থেকে এই সমস্ত রেলফেরির ব্যবহার কমতে থাকে।
উত্তরবঙ্গের রেলপথ
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে সারাবিশ্বে পাটের চাহিদা যায় বেড়ে। কলকাতায়, ঢাকা ও ময়মনসিংহের পাট সরবরাহের স্বার্থে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়ে। এজন্য ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ১৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মিটারগেজ ঢাকা স্টেট রেলওয়ে স্থাপন করা হয়। পরবর্তীকালে এই লাইন বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
১৮৮৭ সালের দিকে এই সমগ্র অঞ্চলের রেলযোগাযোগে আরেকটা বড়ো ধরণের বিপ্লব সাধিত হয়, যখন ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে, নর্থ বেঙ্গল রেলওয়ে এবং ঢাকা স্টেট রেলওয়ে একীভূত করে ফেলা হয়। এতে ঢাকা এবং রাজশাহী বিভাগের রেল যোগাযোগে বিপুল উন্নতি সাধিত হয়।
কিছুদিন পর পদ্মার ওপর দিয়ে কুষ্টিয়া এবং পাবনাকে যুক্ত করে বাংলাদেশের দীর্ঘতম রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। নামকরণ হয় তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের নামে। আলেকজান্ডার মেয়াডোজ রেন্ডেলের নকশা অনুসারে বানানো ১.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই ব্রিজের ওপরে রয়েছে দুটো ব্রডগেজ রেললাইন।
ব্রিজটির নির্মাণকাজ ১৯০৯ সালে শুরু হয়ে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত চলে। একই বছরেরই ৪ মার্চ এটি জনসাধারণের চলাচলের জন্য চালু করে দেয়া হয়। শতবর্ষ পার করে ফেলা এই রেলসেতুর সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিও জড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ট্যাংক, গোলাবারুদ ইত্যাদি এই সেতুর ওপর দিয়ে পারাপার করতো পাকবাহিনি। সেজন্য তখন মিত্রবাহিনির যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেলা হয় সেতুটির ওপরে। পরে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় পুনর্নির্মাণ করা হয় সেতুটির। পরের বছর থেকে পুনরায় চালু হয় ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।
আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে
উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চায়ের চাহিদা বেড়ে যায়। তখন এসব দেশে চা রপ্তানি করতো চীন। ১৮৩০ সালে চীন থেকে চা রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলে এই অঞ্চলের আসাম-সিলেটসহ সংলগ্ন এলাকায় চা বাগান স্থাপনের কাজ করে ব্রিটিশরাই। এজন্য যে সকল কোম্পানি বেশি অর্থলগ্নি করে তাদের দাবির প্রেক্ষিতে ১৮৯২ সালে স্থাপিত হয় আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে।
অনেক ঘটনাপরিক্রমা পেরিয়ে ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের সাথে একীভূত হয় আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে। নতুন নাম হয় বেঙ্গল-আসাম রেলওয়ে। পরে ভারত বিভক্তির পর আবার ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে’ নাম ফিরে পায়, সেই সাথে ২৬০৬.৫৯ কিলোমিটার রেললাইনও বর্ধিত হয়। আরও পরে, বাংলাদেশ যখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন উত্তরাধিকারসূত্রে ২৮৫৮.৭৩ কিলোমিটার রেলপথ এবং ৪৬৬টি রেলস্টেশন বাংলাদেশের সম্পদ হিসেবে নাম লেখায়।
ফুলবাড়িয়া: মুছে যাওয়া ইতিহাস
ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন। ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যভিত্তিক প্রায় সব বইয়েই ঘুরেফিরে এসেছে এই স্টেশনের কথা। নাম ফুলবাড়িয়া হলেও স্টেশনের নামফলকে লেখা ছিল ‘ঢাকা’। ১৯০৪ সালে ফটোগ্রাফার ফ্রিজ ক্যাপ সেই স্টেশনের একটি ছবি তুলেছিলেন। উপলক্ষ ছিল সেই সময় লর্ড কার্জনের সস্ত্রীক ঢাকায় আগমন।
এরও আগে একটি স্টেশনঘরের সামনে তিনটি রেললাইনের একটি ছবি পাওয়া যায়। সেটি আঠারো শতকের শেষ দিকে তোলা বলে জানা যায়। ব্যবহৃত ছবিটি সেই সময়কার ফুলবাড়িয়া স্টেশনেরই ছবি। ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ফুলবাড়িয়াতেই ছিল ঢাকার রেলস্টেশন। এরপর ওই এলাকায় জনবসতি বাড়তে থাকায় স্টেশন সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়।
একই বছরই কমলাপুরে রেলস্টেশন নির্মাণ শুরু হয়। স্টেশন নির্মাণ ও রেললাইন বসানোর কাজ শেষ হয় ১৯৬৮ সালে। অর্থাৎ উক্ত বছরের মে মাস থেকে রেললাইন চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন চালু ছিল। জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সান্ধ্য-আড্ডার কেন্দ্রস্থল ছিল ফুলবাড়িয়া স্টেশন। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের পুরনো সাইকেলের চেনাশোনা গতিপথ ছিল এই স্টেশনকেই জড়িয়ে ধরে হেঁটে চলা রাস্তা। সেই সময় শহীদ কাদরী, মাহমুদুল হকসহ আরও অনেকেই স্টেশনের ক্যান্টিনের শিল্প-সংস্কৃতির আড্ডায় জড়ো হতেন।
এরপর ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে ফুলবাড়িয়ার আবেদন। ১৯৮৩ সাল থেকে বাসস্ট্যান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে স্মৃতিময় ফুলবাড়িয়া। সেই সাথে মুছে যেতে থাকে ফুলবাড়িয়া থেকে ঢাকেশ্বরী, পলাশী, নীলক্ষেত হয়ে হাতিরপুল দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া রেলপথটির ইতিহাস।
কমলাপুর: এখন যেখানে কেন্দ্র
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন ঢাকার কমলাপুরে অবস্থিত। অনন্য স্থাপত্যশৈলীর এই স্টেশনের নির্মাণযজ্ঞ প্রায় দুই দশক ধরে চলে। মার্কিন স্থাপত্যবিদ রবার্ট বাউগির নকশা অনুসারে তৈরি হওয়া এই বিশাল স্থাপনা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আর কোথাও দেখা যায়নি।
ফুলবাড়িয়া থেকে কমলাপুরে রেলস্টেশন সরিয়ে নেওয়ার ভাবনা আসে ঢাকায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপের প্রভাবে। ১৯৪৭ সালের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল দেশভাগ। মূলত এই কারণেই ঢাকায় উদ্ভূত হয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিস্থিতি। সেদিক দিয়ে কমলাপুর স্টেশনের প্রতিষ্ঠা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের সাথে জড়িত ঘটনাই বটে। স্টেশনটি ১৫৬ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত। ফুলবাড়িয়া স্টেশনের তুলনায় দশগুণ বড় এই স্থাপনা বাংলাদেশের বিংশ শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থাপনার মধ্যে একটি।
সারাদেশ থেকে রাজধানী ঢাকায় প্রবেশের অন্যতম দরজা হিসেবে কমলাপুর রেলস্টেশন পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে সেবা দিয়ে চলেছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ লাখ বিশ হাজারেরও বেশি মানুষ রেল পরিষেবা গ্রহণ করছে কমলাপুর রেলস্টেশনে। শুধু তাই নয়, স্টেশনকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানও হচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছে পত্রিকার হকার, মুচি, ঝাড়ুদার, ফেরিওয়ালা ইত্যাদি প্রান্তীয় পেশাজীবী মানুষেরা। কু ঝিকঝিক শব্দ তুলে অন্ধকারে বীরের বেশ ছুটে যায় রাতের ট্রেন, আর পেছনে রেখে যায় এমনই কতশত ইতিহাস।
Feature Image: daily-bangladesh.com References: 01. ঢাকা পুরাণ-মীজানুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন (জানুয়ারি ২০১১) 02. উপন্যাস সমগ্র-জহির রায়হান, অনুপম প্রকাশনী (জুলাই ২০০৯) 03. Railway 04. দেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন জগতির অবস্থা নাজুক 05. আর কতটা ইতিহাস ধারণ করলে কমলাপুর ঐতিহাসিক হয়ে উঠবে 06. দক্ষিণে রেল যোগাযোগ ও বিস্মৃত এক রেললাইনের গল্প 07. ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক হার্ডিঞ্জ ব্রিজ