জিন্সের ইতিহাস: ১৮০০ থেকে বর্তমান

557
0

আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগের কথা। এক ভদ্রলোক ব্যবসায়ীর গোল্ড মাইন বা স্বর্ণের খনি উত্তোলনের ব্যবসা। তিনি পড়লেন বেজায় দুশ্চিন্তায়। ঘড়ির কাঁটা শুধু ছুটেই চলছে কিন্তু তার দুশ্চিন্তার কোন কূল-কিনারা হচ্ছে না। ভদ্রলোকের দুশ্চিন্তার কারণ হলো, তার স্বর্ণখনির শ্রমিকদের জন্য কোন টেকসই পোশাক বা ইউনিফর্ম নেই। আবার শুধু টেকসই হলেও হবে না; শ্রমিকদের জন্য আরামদায়কও হতে হবে। 

এত সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি শরনাপন্ন হলেন একজন দর্জির কাছে। দুজনের চিন্তাধারায় জন্ম নিলো এক যুগান্তকারী কাপড়। সেই কাপড় দিয়ে তৈরি হলো ইউনিফর্ম। কিন্তু কাপড়ের নাজুকতাকে আরো মজবুত করতে দর্জি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, তিনি এতে মেটাল ব্যবহার করবেন। ব্যবসায়ী ভদ্রলোক যদিও শুরুতে মেটাল ব্যবহারের বিপক্ষে ছিলেন তারপরও সম্মতি দিলেন। কিন্তু কে জানতো সেই প্রয়োজন থেকে আবিষ্কারের ফল আজকের বিশ্বে সব থেকে বেশি পরিধেয়, জনপ্রিয় একটা পোশাকের জন্ম দেবে। 

গল্পের মতো করেই জন্ম হয়েছিল ‘জিন্স’। সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক ছিলেন লেভি স্ট্রস এবং দর্জি ছিলেন জ্যাকব ডেভিস। ১৯ শতকের শেষের দিকে, জিন্স স্বর্ণখনির শ্রমিকদের পোশাক; সেখান থেকে আজ জিন্স চলে এসেছে ফ্যাশনে। যেই পোশাক অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের ট্রেন্ডের সাথে মানানসই হিসেবেই টিকে যাবে। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং পপ সংস্কৃতি সব কিছুতেই ডেনিম বা জিন্স তার বিবর্তনের ভূমিকা পালন করে এসেছে প্রায় ১৫০ বছরের ইতিহাস জুড়ে।  

লেভি স্ট্রস ও জ্যাকব ডেভিস। Image : sb-zipper.com

সকল ডেনিমই জিন্স নয় আবার সকল জিন্সই ডেনিম

শুরুতেই মনে রাখতে হবে, ‘সকল ডেনিমই জিন্স নয় আবার সকল জিন্সই ডেনিম’। এটা বলার মূল কারণ হলো, ডেনিম হলো এক ধরণের ফেব্রিক বা কাপড়ের নাম; যা ১০০% (শতভাগ) তুলো টুইল বা স্ট্রেচ টুইল থেকে তৈরি করা হয়ে থাকে। অপরদিকে জিন্স এক ধরনের পোশাক যা ডেনিম কাপড় ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। 

ডেনিম একটি ফ্যাশনেবল ফেব্রিক, যার দ্বারা বিভিন্ন ধরণের পোশাক শৈলী তৈরি করা যায়। জিন্স সেই ডেনিম ফেব্রিকের শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট শৈলীর পোশাকমাত্র। ডেনিমকে জ্যাকেট, স্কার্ট, প্যান্ট, শর্টস ইত্যাদি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। জিন্সকে বিশেষভাবে ডেনিম প্যান্ট হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। অতএব, বোঝাই যাচ্ছে ডেনিম আর জিন্সের পার্থক্য কি! আর কেনই বা বলা হচ্ছে সকল ডেনিমই জিন্স নয় আবার সকল জিন্সই ডেনিম। 

জিন থেকে জিন্স

ইতালির উপকূলীয় শহর জেনোয়া থেকে বণিক নাবিকদের পরিধানের জন্য শক্ত টুইল ট্রাউজার্সকে বর্ণনা করার জন্য জিনস শব্দটি ‘জেনোইজ’ বা ‘জিন’ শব্দের প্রবর্তনের সাথে ১৫৬৭ সালের দিকে প্রথম ‘জিন্স’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।  

১৮০০ সাল: জিন্সের জন্মলগ্ন

যদিও জন্মলগ্নের গল্প পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে; তারপরও বাকি আছে কিছুটা। ব্যবসায়ী লেভি স্ট্রসের এবং দর্জি জ্যাকব ডেভিসের চিন্তাধারা এবং বাস্তবায়নের ফলাফল হচ্ছে এই জিন্স। নীল জিন্স মেটাল রিভেটগুলিকে ডেনিম ট্রাউজার্সের সাথে একত্রিত করে একটি টেকসই ইউনিফর্ম তৈরি করে; যা স্বর্ণখনির শ্রমিকরা তাদের কাজের জন্য পরিধান করতো। 

জিন্স পরিধান করা স্বর্ণ উত্তোলনের শ্রমিক। Image Source : Vogue France

লেভি স্ট্রস ১৮৫১ সালে জার্মানি থেকে নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন তার বড় ভাইয়ের সাথে তাদের শুকনো পণ্যের ব্যবসায় যোগ দিতে। ১৮৫৩ সালে তিনি পশ্চিম আমেরিকায় গোল্ড রাশ বা স্বর্ণের খনি সম্পর্কে শুনেছিলেন তাই পশ্চিমে পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠার জন্য সান ফ্রান্সিসকোতে চলে যান। 

সেখানে তিনি অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি সুতি কাপড় বিক্রি কররতন। তার একজন গ্রাহক ছিলেন জ্যাকব ডব্লিউ ডেভিস, একজন দর্জি। ডেভিস তাঁবু, ঘোড়ার কম্বল এবং ওয়াগন কভারের মতো পণ্য তৈরি করতেন। 

একদিন, তার গ্রাহক কঠোর পরিশ্রম সহ্য করতে পারে এমন এক জোড়া শক্ত প্যান্টের অর্ডার দিয়েছিলেন। তিনি সেগুলি ডেনিম থেকে তৈরি করেছিলেন; যা তিনি লেভি স্ট্রস-এর কাছ থেকে কিনেছিলেন এবং প্যান্টগুলির নাজুকতা কমাতে এমন জায়গায় তামার রিভেট স্থাপন করে সেগুলিকে শক্তিশালী করেন৷ যার মাধ্যমে জন্ম নেয় জিন্সের। 

জ্যাকব ডেভিস পরবর্তীতে নিজের নামে এবং লেভি স্ট্রসকে অংশীদার হিসেবে পেটেন্ট করেন জিন্সের। দুজনে মিলে একটি বড় কারখানা খুলেছিলেন এবং এভাবেই জিন্সের জন্ম হয়েছিল। 

লেভি স্ট্রস এ্যান্ড কোং এর সামনে প্রতিষ্ঠাকালীন ছবি। Image Source : Vogue France

১৯২০ থেকে ১৯৩০: গড়ে ওঠা

১৯২০ এবং ১৯৩০ সালের দিকে শ্রমিকদের পোশাক হিসেবেই জিন্স ব্যবহৃত হতো। বিশেষ করে পশ্চিম আমেরিকায় খনির শ্রমিক এবং কাউবয়দের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু তখনও সাধারণ মানুষের পরিচ্ছদে জিন্স তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।

যতদিন না হলিউড তাদের চলচ্চিত্রে জিন্সের ব্যবহার শুরু করে। ঠিক তারপরই মূলধারার ফ্যাশনে জিন্সের ব্যবহার শুরু হয়।  এরপর ফ্যাশন ফ্রন্টে, Levi’s® সর্বপ্রথম তার ডিজাইনার লেবেল ব্যবহার করে।  

১৯৫০: কুল ব্লু

১৯৫০ দশকের দিকে জিন্সকে ‘কুলনেস’ এর প্রতীক বলা হতো। জেমস ডিন এবং মারলন ব্র্যান্ডোর মতো পপ সংস্কৃতির ছেলেরা তাদের চলচ্চিত্রে পরিধানের মাধ্যসে ডেনিমের কাফড, বক্সিকে (পোশাক) জনপ্রিয় করে তুলেছিল। 

আশ্চর্যজনকভাবে, বিদ্রোহী কিশোররা স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে এই ফ্যাশনেবল প্রতীকটিকে ধরেছিল। এরপরে স্কুল বোর্ডের নির্দেশ আসে, ছাত্রদের জিন্স পরা নিষিদ্ধ ছিল।  

কুল ব্লু ভিন্টেজ জিন্স। Image Source : Vintage Everyday

১৯৬০: ফ্লাওয়ার পাওয়ার

১৯৬০-এর দশকে বেলবটমস, সংস্কৃতির একটি প্রতীক হয়ে ওঠে। তারুণ্যের, মুক্ত-প্রেম আন্দোলনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় ব্লু বা নীল জিন্স। যা সুগঠিত পোশাক থেকে স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্ব করে এবং সৃজনশীল আত্ম-প্রকাশের একটি ধারা হিসাবেও কাজ করে। 

ডাবল ডেনিম এবং জিন্স জ্যাকেটগুলিও এই সময়ে একটি ফ্যাশন হিসেবে তাদের প্রথম উপস্থিতি প্রমাণ করেছিল। সূচিকর্ম এবং ফ্লাওয়ার প্যাচ (একধরণের প্যাটার্ন)-এর জিন্স খুব জনপ্রিয় ছিল। যেগুলোকে ফ্লোরাল জিন্স বলা হতো। 

ফ্লোরাল জিন্স । Image Source : byrdie.com

১৯৭০: আমেরিকানা

৬০-এর দশকের ঐতিহ্যের চেতনা ৭০-এর দশকে চলে গিয়েছিল, সেই দশকটি একটি সর্ব-আমেরিকান প্রতীক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল।

‘চার্লি’স অ্যাঞ্জেলস’ এর অভিনেত্রী ফারাহ ফাউসেট এবং মডেল লরেন হাটনের মতো তৎকালীন সময়ের ‘কুল-গার্ল’রা পরিধান করতো জিন্স।

সিলুয়েটগুলি দেখতে ছোট হতে শুরু করে, স্লিম-ফিটিং, স্ট্রেটার লেগ জিন্স এবং ডেনিম স্কার্ট এবং ভেস্টগুলি জনপ্রিয় ফ্যাশন আইটেম হয়ে উঠেছিল তখন। 

জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘দ্য ডিউকস অফ হ্যাজার্ড’-এ ক্যাথরিন বাখের চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, কাট-অফ শর্টস দশকের, শেষে এবং পরবর্তী সময়ে একটি ফ্যাশন ট্রেন্ড হয়ে ওঠে।

১৯৮০: ডিজাইনার ডেনিম

১৯৮০ এর দশকের কথা। তখন ডিজাইনার ডেনিমের জন্ম হয়েছিল। একজন ১৫ বছর বয়সী ব্রুক শিল্ডস, ক্যালভিন ক্লেইনের একটি বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেছিলেন, সেই বিজ্ঞাপনের কপি ছিল- ‘আমার এবং আমার ক্যালভিনদের মধ্যে কিছুই আসে না।’ 

ডিজাইনার জিন্স পপ সংস্কৃতিতে একটি সত্যিকারের স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে দাঁড়ায় তখন, এবং ক্যালভিন ক্লেইন, জর্ডাচে এবং গ্লোরিয়া ভ্যান্ডারবিল্টসহ ব্র্যান্ডগুলি কুল-বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে লোভনীয় ছিল। স্টোনওয়াশ, অ্যাসিড ওয়াশ, রিপড-জিন্স (Ripped Jeans) এবং গোড়ালিতে টেপারড লেগ কাটগুলি ছিলো বেশ জনপ্রিয়। 

১৯৯০: বড় এবং ব্যাগি

৯০-এর দশকে ডেনিমের ফ্যাশন আবার পরিবর্তিত হয়েছিল, এই পরিবর্তনের জন্য গ্রঞ্জ (grunge) এবং হিপ-হপকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়। স্ট্রেট লেগ জিন্স, কখনও কখনও ছিঁড়ে-ফাটা জিন্স, এগুলো ছিল নিত্য জীবনের পোশাকের একটা অংশ। উচ্চ বা চওড়া কোমরের জিন্স উদ্ভাবিত হয় যাকে বলা হতো ‘মম জিন্স’ (Mom Jeans)। 

এগুলো ছিল অন্যান্য জিন্সের তুলনায় আরো আরামদায়ক, ফিট ও খুব ফ্যাশনেবল—এবং সম্প্রতি সময়ে তা পুনরায় ফিরে এসেছে৷ তখন ব্যাগি জিন্সের আরো কিছু ধরণ দেখা যেতো, যেমন- বড় এবং ব্যাগিয়ার। কার্পেন্টার জিন্স যা ছিল একাধিক পকেট এবং ট্যাবসহ এবং হেড-টু-টো (Head to toe) জিন্স; যা তৎকালীন সময়ে অনেক জনপ্রিয় ছিল। 

বড় এবং ব্যাগি জিন্স। Image Source : Hypebae.com

২০০০: গেট লো (Get Low)

প্রথম দিকে, ডেসটিনি’স চাইল্ড, ব্রিটনি স্পিয়ার্স এবং ক্রিস্টিনা আগুইলেরা অতি লো-রাইজ (Low Rise) জিন্সকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। ফ্লেয়ার (Flare) এবং বুটকাট স্টাইলগুলিও লো-রাইজের পাশাপাশি জনপ্রিয় ছিল। যখন রেট্রো ক্যাপ্রি (Retro Capri) নামক জিন্স ২০০০ দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে পুনরুত্থান করেছিল। 

২১ শতকের শুরুতে প্রিমিয়াম ডেনিমের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়, ব্যাগির (Baggy) এর মতো জিন্স এবং হাডসন জিন্সগুলি তখন হঠাৎ করেই সাধারণ মানুষের কাছে প্রধান একটি পোশাক হয়ে ওঠে৷ 

২০১০:  স্কিনি জিন্স (Skinny Jeans)

২০১০ সালের দিকে, কনসার্ট বা মিউজিক ফেস্টিভ্যালগুলো খুব জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। যেটি একসময় পপ মিউজিক উৎসাহীদের জন্য একটি গন্তব্য ছিল। পপ সংস্কৃতির এই পরিবর্তন একটা নতুন কিছুর জন্ম দেয় যা ছিল ফেস্টিভ্যাল অ্যাটায়ার (Festival Attire) বা উৎসবের পোশাক। 

ভিনটেজ-অনুপ্রাণিত জিন্সগুলো তখন নতুন ফ্যাশন আইটেম উপহার দেয় যা ছিল স্কিনি জিনস (Skinny Jeans)। জিন্স স্ট্রেচ টেকনোলজি উদ্ভাবনের ফলে, স্কিনি জিন্স কর্মজীবন থেকে শুরু করে ডেট নাইটে পরিধানের নতুন স্টাইল হয়ে ওঠে।

ব্লু জিন্সের বিবর্তন। Image Source : Inviya Fibre

বর্তমান সময় 

যখন জিন্স ফ্যাশন বৈচিত্র্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন স্কিনি জিন্সগুলো সর্বদা রাজত্ব করছে কারণ তাদের সাজসজ্জার বহুমুখিতার জন্য। তবুও, একটি ঢিলেঢালা ফিটের দিকে একটি এখনও কিছু মানুষ বা জাতির আর্কষণ রয়েছে। স্ট্রেট বা বুট কাট সহ মাঝারি থেকে চওড়া কোমরওয়ালা জিন্সগুলির প্রতিও আর্কষণ রয়েছে।  

জিন্স সময়ের সাথে সাথে নিজের পরিচয় ঠিক রেখে ধারণ করেছে নানারূপ তারপরও এখনও মানুষের পোশাকের তালিকায় প্রথম পছন্দ জিন্স। যা শুরু হয়েছিল একজন ব্যবসায়ী ও দর্জির হাত ধরে শ্রমিকদের জন্য তৈরি পোশাক। কে জানতো এটাই ভবিষ্যতে, বর্তমান বিশ্বের ফ্যাশন ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়াবে। হয়তো সামনের পথে এই জিন্সের রূপ বদল হতে পারে। 

 

 

Feature Image: marksvallye.com
References:

01. History of Jeans and Denim. 
02. Vogue encyclopaedia: The history of denim jeans. 
03. The History of Jeans: A Detailed Look at Denim Over the Decades.