ইয়াহু: সাফল্যের শীর্ষ থেকে যেভাবে পতন

286
0

সংক্ষেপে বলতে গেলে, ইয়াহু ছিল মূলত একটি বহুজাতিক প্রযুক্তি সম্পর্কিত কোম্পানি যা পৃথিবীতে যেকোনো স্থানের যেকোনো গ্রাহক, প্রকাশক এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের ইন্টারনেট সেবা এবং পণ্য সরবরাহ করতো। তাদের এই প্রযুক্তিগত সেবা প্রদান সারা বিশ্বের বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের কাছে তুমুল জনপ্রিয় করে তুলেছিল স্বল্প সময়ের মাঝেই।

এছাড়া ই-মেইল সুবিধা, যেকোনো পণ্য সামগ্রীর বিজ্ঞাপন, অনলাইন ম্যাপিং, যেকোনো প্রশ্নের জবাবসহ বিভিন্ন ভিডিও সরবারাহের সেবা ইয়াহু তার গ্রাহকদের প্রদান করতো। সর্বসাধারণের কাছে এত জনপ্রিয় হওয়ার মূল কারণ ছিল যেকোনো তথ্য সবচেয়ে সহজে এবং সবচেয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে চোখের সামনে তুলে ধরার মতন তখন অন্য কোনো সার্চ ইঞ্জিন ছিল না।

ইয়াহুর ইতিহাস এবং ব্যবসায়িক কর্ম-কৌশল

খুব সাদামাটাভাবে শুরু হওয়া ইয়াহুর শুরুর দিকের যাত্রার গল্প ছিল জেরি ইয়াং এবং ডেভিড ফিলো নামক দুজন স্ট্যানফোর্ড থেকে স্নাতক শেষ করা ছাত্রকে নিয়ে। ১৯৯৪ সালে তরুণ দুই যুবকের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা পায় ইয়াহু।  

তবে প্রাথমিকভাবে তারা যে ওয়েবসাইটটি তৈরি করেছিলেন তার নাম দিয়েছিলেন ‘জেরি অ্যান্ড ডেভিডস গাইড টু দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব’। মূলত এটি ছিল অন্য ওয়েবসাইটগুলি ব্যবহারের জন্য একটি ডিরেক্টরি বা দিকনির্দেশক মাত্র।

ইয়াহুর প্রতিষ্ঠাতা জেরি এবং ডেভিড। Image Source: yahoonews.com

এছাড়াও ইয়াহু নিজে একটি সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে একদিকে যেমন সেবা প্রদান করতো তার ব্যবহারকারীদের এবং অন্যদিকে অন্যান্য ওয়েবসাইটে প্রবেশের জন্য একটি পথপ্রদর্শক হিসেবেও কাজ করতো। তবে সেই সব লোকেরাই শুধুমাত্র সেসব ওয়েবসাইটে লগ ইন করতে পারতো, যারা শুধুমাত্র ওয়েবসাইটের নির্দিষ্ট ঠিকানা জানতো। অন্যথায় ব্যবহারকারীর অনুসন্ধানকৃত ওয়েবসাইট খুঁজে বের করার অন্য কোনো উপায় ছিল না। 

তবে যারা ইয়াহু ব্যবহার করতো তাদের সুবিধার জন্য বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বা বিভাবে ওয়েবসাইটটি সাজানো ছিল। এছাড়াও ওয়েবসাইটটিতে একটি সার্চ ইঞ্জিনও ছিল যা ব্যবহারকারীদের উল্লেখিত কী-ওয়ার্ড দ্বারা সেই সম্পর্কিত ওয়েবসাইটগুলো অনুসন্ধান সাহায্য করতো।

ইয়াহুর জনপ্রিয়তা অর্জন করতে বিশেষ কোনো কসরত বা পলেসি অবলম্বন করতে হয়নি জেরি এবং ডেভিডকে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ইয়াহু যাতে প্রায় ২০০০ অন্যান্য ওয়েবসাইটের একটি তালিকা ছিল। 

আর এরপরেই হয়তো আকস্মিক খুশিতে জেরি এবং ডেভিডের নিজস্ব মেধা শিশু ব্যবসায়িক মডেল এপ্রিল, ১৯৯৪ সালে (জেরি এবং ডেভিডস গাইড টু দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব) নাম পরিবর্তন করে নাম ধারণ করে ইয়াহু।  

এখন পর্যন্ত ইয়াহুর সকল লোগো। Image Source: 1000logos.net

কিছু ভুল সিদ্ধান্ত এবং শোচনীয় পরিনতি

বলা হয়ে থাকে, রাজ্য জয় করা যত সহজ সেটা ধরে রাখা তার চেয়ে বেশি কঠিন। তেমনটাই হয়েছিল ইয়াহুর সাথে। সময়ের সাথে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন, তার সাথে নিজের করা কিছু ভুলের মাশুল দিতে হয় ইয়াহুকে।

১৯৯৮ সালে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে ইয়াহু ১-২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যে গুগল কেনার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু তারা বলেছিল যে গুগল-এর যে পেজ র‍্যাঙ্ক কেনার কোনো মানেই হয় না। ভুলের শুরুটা যেন এখান থেকেই!

পরবর্তীতে, ২০০২ সালে আবার গুগল কিনে নেওয়ার সুযোগ ইয়াহুর কাছে আসে। এবার অবশ্য মূল্য হাকা হয় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এবারো সুযোগ হাতছাড়া করে ইয়াহু। না কেনার কারণ ছিল, ইয়াহুর কাছে মনে হয় অতিরিক্ত মূল্য ছিল এটি। তাঁদের ধারণা ছিল, যেখানে নিজেরাই এত জনপ্রিয় সেখানে বাড়তি খরচ কেনো করবে তারা। 

এরপরে, ২০০৮ সালে মাইক্রোসফট ইয়াহুকে কিনে নিতে চায়, ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। কিন্তু ইয়াহুর কাছে তখনও মনে হয়, এই মূল্যটি একেবারেই কম। মাইক্রোসফট তাদের সঠিকভাবে মূল্যায়নই করতে পারছে না। 

সময়ের সাথে ইয়াহুর পরিবর্তনের সমীকরণ। Image source: visualcapitalist.com

অথচ, পরবর্তীতে ইয়াহু বিক্রি করা হয় মাত্র ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে ভেরিজন এর কাছে। অন্যদিকে গুগলের আজ মূল্য ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইয়াহুর এই বিশাল দরপতন সত্যিই দুঃখজনক। শুধুমাত্র অর্থ মূল্যেই নয়, ইয়াহুর যে জনপ্রিয়তা ছিল সেই তুলনায় এই মূল্য আসলে কিছুই না।  

তবে ২০০০ সালের মধ্যদিকে ইয়াহুর বাজার মূল্য বেশ কিছুটা বেড়েছিল। ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে এই মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৪০-৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এর মূলে ছিল আলিবাবা নামক একটি চীন দেশীয় কোম্পানিটির ৪০% শেয়ার কিনে নেওয়া। সেজন্য অবশ্য ইয়াহুকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করতে হয়।

সাফল্যের শীর্ষ চূড়া থেকে পতনের কারণ

ইয়াহুর পতনের সুর যেন বাজতে শুরু করে মারিসা মায়ার ২০১২ সালে সিইও হিসেবে ইয়াহুর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে। পরের কয়েক বছরে, তিনি ৫০ এর বেশি বিশেষ বিশেষ খাতে ২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেন ইয়াহুর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিসহ কোম্পানিটির বাণিজ্যিকভাবে লাভবানের স্বার্থে। তবে তা ইয়াহুর আয়কে প্রত্যাশিতভাবে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেনি।

২০১৫ সালের শুরুর দিকে, ইয়াহুর বাজার মূল্যের যা অবশিষ্ট ছিল তা মূলত সম্পূর্ণরূপে আলিবাবার শেয়ারে আবদ্ধ ছিল। অন্যদিকে সার্চ, ডিসপ্লে এবং মোবাইল বিজ্ঞাপনের মূল ব্যবসা তাদের প্রতিযোগী গুগল এবং ফেসবুক যে হারে এগিয়ে যাচ্ছিল ইয়াহু যেন সে হারেই পিছিয়ে পড়ছিল।

মারিসা মায়ার। Image Source: businessinsider.com

প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা ছিল ইয়াহুর পতনের অন্যতম বড় কারণ। যখন প্রতিযোগী গুগল তার নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন যেমন- ইউনিভার্সাল সার্চ, ভয়েস সার্চ, নলেজ গ্রাফ, ইনফো জাস্ট ফর ইউ, গুগল গ্লাস ইত্যাদির মাধ্যমে ক্রমাগত বাজার কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।

তখন ইয়াহু ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মের চারপাশে প্রযুক্তি উদ্ভাবন ব্যবস্থাপনার উপর তেমন ফোকাস করেনি। ব্যবসার মূল্য যায়গা ডেটা অ্যানালিটিকস, ডেটা সায়েন্সের মতো নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তিগুলিকে ইয়াহুর নির্বাহী দলের উদ্ভাবন লেন্সের মাধ্যমে দেখা হয়নি৷ 

শুধুমাত্র তাই নয়, ইয়াহু সমসাময়িক ব্যবসার বাজারে উন্নতির জন্য নতুন কোনো কৌশলও প্রনয়ণ করেনি। কোন খাতে, কিভাবে, কত লাভ করা যায় এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে যেন ইয়াহুর কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। 

অথচ তাদের মূল আয়ই ছিল বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে অর্থ আয় করা। যেখানে ইয়াহুর কাজের মূল্য অংশটাই ছিল সরাসরি ক্রেতা বা ভোক্তাদের চাহিদা পূরন সেখানে এসকল দিকেও সমন্বয় করতে ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানটি।

দ্রুত পরিবর্তনশীল টেক দুনিয়ায় ইয়াহুর পরিবর্তন ছিল ধীরগতির। Image source: techcrunch.com

অন্যদিকে গুগল ক্রমশ এই ব্যাপার গুলোতে এগিয়ে যাচ্ছিল। অতিদ্রুত আর সহজেই গ্রাহকদের সেবা প্রদান করতে  গুগুল তাদের ওয়েব পেজের শুরুতেই বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরি সাজিয়ে রেখেছিলো। সেই অনুযায়ী ছিলো ক্রেতার পছন্দের তালিকাও। আর নিত্যনতুন এই বিষয় গুলোর পার্থক্যই ইয়াহু আর গুগুলের জনপ্রিয়তার ব্যবধান গড়ে তোলে ব্যাপক হারে।

ইয়াহু প্রযুক্তি এবং ব্যবহারকারীর চাহিদা অথবা ব্যবসায়িক লাভ কোনো কিছুতেই যেনো যুগোপযোগী পরিকল্পনা সাজাতে পারেনি। সর্বোপরি সময়ের বহমান স্রোতে শক্ত হাতে হাল ধরে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার ব্যার্থতার খেসারত দিতে হয়েছে ইয়াহুর মতন রাজত্ব করা প্রতিষ্ঠানকেও!

 

Feature Image: pinterest.com 
References: 

01. Failure of Yahoo. 
02. Why Yahoo Failed Woefully. 
03. Why Yahoo Faced an Unimaginable Downfall. 
04. Yahoo Collapse Century Biggest Business Failure.