সময় অসময়

4317
0

“শিহাব অফিসে যাবে তাড়াতাড়ি করে রান্না বসালাম।

মসলা কসাচ্ছি এমন সময় আমার মনে হলো তীব্র আঁশটে একটা গন্ধ নাকে লাগছে আর নাড়িভুঁড়ি উল্টিয়ে বমি চলে আসলো। দৌড়ে বেসিনে গিয়ে বমি করলাম। ”

“সেদিন থেকে শুরু। পাক্কা নয় মাস এই গন্ধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। খাবার খেতে গেলে গন্ধ পাই। রান্না করা তো প্রায় ছেড়ে ই দিয়েছি। শিহাব সব সামলে নিয়েছে। ”

“যা খেতাম বমি করে সব ফেলে দিতাম। এক হাত দিয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে অন্য হাত দিয়ে বমি পরিষ্কার করতো শিহাব।
আমাদের দুজনের এত কষ্ট শুধু মাত্র আমার পেটের ছোট্ট প্রাণ টার জন্য। ”

“ছোট ছোট কাঁথা বানিয়ে সারি সারি করে সাজানো রয়েছে ছোট্টু টার জন্য। ”

“ছোট্টু টা একদিন ফুটবলের মতন এক লাথি মারলো পেটে। ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলাম আমি।
সাথে সাথে শিহাব কে ঢেকে শোনালাম দুষ্টু টার লাথির শব্দ। প্রথম ছোট্টুর অস্তিত্বের অনুভব অদ্ভুত ছিলো।”

“নয়মাস বারোদিনের মাথায় তীব্র ব্যাথা পেরিয়ে জন্ম নিলো পিচ্চিটা। এইটুকু একটা বাচ্চা। গোলাপি রঙ, ছোট্ট দুইটা হাত পা। পিট পিট করে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি ভুলে গেছি এত্তক্ষন কত তীব্র একটা ব্যথা আমাকে সইতে হয়েছে। অদ্ভুত এক সুখে মনটা ভরে গিয়েছে। ”

“পিচ্চিটার নাম রেখেছি স্বপ্ন। কারণ সে আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তার জন্য সারা রাত জেগে বসে থাকি । জেগে থেকে স্বপ্ন কে আগলে রাখি আমি। ”

“স্বপ্ন বড় হচ্ছে। আধো আধো বোলে মা ডাকে। আমার ইচ্ছে হয়ে কাজ কর্ম সব ফেলে সারা দিন স্বপ্নের এই ডাক শুনি।
তাই ত বাঁ কোলে স্বপ্নকে রেখে ডান হাতে দুনিয়া সামলাই আমি।
আর স্বপ্নের মা ডাক শুনে দিন কে দিন নিজের লোভী মন টাকে আরো লোভাতুর করে তুলি আমি। ”

“স্বপ্ন বাচ্চা টা আমার স্কুলে যাবে। আমি ভয়ে মরি একা একা বাচ্চা টা আমার থাকতে পারবে তো?
তাই ঘরের কাজ বাদ দিয়ে সারাটাক্ষণ ঘাপটি মেরে পড়ে থাকি ছেলের স্কুলে। ”

“স্বপ্ন কে আজ মেরেছি। পাশের বাসার ছেলেটার সাথে মারামারি করে এসেছে তাই। ছেলেটা আমার অনেক কেঁদেছে। ওকে মেরে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে আমি ও অনেকক্ষণ কেঁদেছি। এত কষ্ট হচ্ছে ছেলের গায়ে হাত তুলে। কিন্তু মা দের একটু কঠিন হতে হয় ছেলেপুলে মানুষ করতে হলে।”

“দিন কত দ্রুত যায়। স্বপ্নের কলেজ ও শেষ। ভার্সিটি তে পড়ে স্বপ্ন এখন। আমার বাচ্চা ছেলেটা কবে যে এত বড় হয়ে গেলো টের ই পেলাম না। স্বপ্ন এখন ব্যস্ত তার জগতে। তার পড়াশুনা বন্ধুবান্ধব। অন্য এক জগত। মনে হয় একটা মেয়ে কে ও পটিয়েছে। আমি তো টের পাই। কিছু বলি না। এই যুগের ছেলে প্রেম ত করবেই।”

“দেখতে দেখতে স্বপ্নের বউ ও ঘরে এলো। আমার ও বয়স হয়েছে। কোনো কিছু ভালো করে মনে রাখতে পারি না। কোনো কাজ করতে পারি না। রোগশোকে কাতর হয়ে পড়ছি।
ছেলেটা ও আমার কেমন যেনো হয়ে গেছে। অথর্ব মায়ের উপর বিরক্ত। মায়ের রোগে জর্জরিত। ছেলেটা দূরে সরে যাচ্ছে। খুব ইচ্ছে করে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে একটু আদর করতে। ছোট্ট বেলার মতন ঘুম পাড়িয়ে দিতে। ”

ডায়েরী টা বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠে স্বপ্ন।

মায়ের এই এক অভ্যাস ছিলো ডায়েরী লেখা। কিন্তু সেই ডায়েরী টা কাও কে দেখতে দিত না।

সাত দিন হলো মা মারা গিয়েছে। মায়ের রুম থেকে মায়ের জিনিস পত্র সরিয়ে নতুন ভাবে সব সাজাতে গিয়ে আজ স্বপ্নের হাতে পড়লো এই ডায়েরী।

চিৎকার করে স্বপ্ন কেঁদে উঠে বললো,

“মা তোমার এই অধম ছেলেটাকে একটু বুকে জড়িয়ে আদর করে দাও না গো।”

কিন্তু বুকে জড়িয়ে নেয়ার জন্য আজ কেউ রইলো না। লেখাঃ সুমাইয়া আফরোজ।