ফুড ডেলিভারির ইতিহাসটা আপনার চিন্তার থেকেও অনেক বেশি যুগান্তকারী ও তাৎপর্যপূর্ণ। প্রাচীন রোম থেকে শুরু করে আজকের উবার ইটস কিংবা ফুড পান্ডা, ফুড ডেলিভারিতে এসেছে আশ্চর্যজনক বিবর্তন। এইতো কয়েক দশক আগের কথা, কেউ কি কখনো ভেবেছে সামান্য কয়েকটি ক্লিকের মাধ্যমে কিছুক্ষণেই খাবার চলে যাবে তার দ্বারপ্রান্তে?
কিন্তু স্মার্টফোন আর ডিজিটালাইজেশন এর এই যুগে ফুড ডেলিভারি এখন বিশ্ববাসীর কাছে খুবই পরিচিত শব্দ। আর অনলাইনে নিজের পছন্দসই ফুড অর্ডার করা যেন সবচেয়ে সহজ কাজগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু যখন আপনার-আমার হাতে ছিল না কোনো স্মার্ট ডিভাইস তখন কি অবস্থায় ছিল ফুড ডেলিভারি সার্ভিস?
কিংবা তারও আগে, ঠিক ১৯’শ শতাব্দীতে, যখন মানুষ ডিজিটাল টার্মগুলোর সাথেই পরিচিতই ছিল না, তখন কিভাবে হতো ফুড ডেলিভারি? আদৌও কি খাবার পৌঁছেে দেয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল?
ধারণা করা হয়, ১৯ শতাব্দীর ইটালিয়ান রয়্যালস ইতিহাসে সর্বপ্রথম পিৎজা ডেলিভারি পায়। আর ১৩০ বছরের এই লম্বা সময়ে, যুদ্ধ, বিদ্রোহ, টেকনোলজি ও বিশ্বায়ন ফুড ডেলিভারিকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। আজকের আলোচনা হবে এই যুগান্তকারী বিবর্তনের প্রতিটি ধাপ সম্পর্কে, প্রতিটি গল্প সম্পর্কে।
ফুড ডেলিভারির ইতিহাস
ফুড ডেলিভারির চাহিদা তো শুরু হয়ে যায় সেই ১৭৮৫ সাল থেকেই যখন আমেরিকায় শিল্পায়ন শুরু হয়। আর সাধারণ জনগণ নগরায়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তবে ১৮৮৯ সাথে বিশ্বের সর্বপ্রথম ফুড ডেলিভারি সার্ভিস নথিবদ্ধ করা হয়। আর প্রাচীন সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মিথোলজির প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ রোম-যেখান থেকেই শুরু হয় ইতিহাসের প্রথম ফুড ডেলিভারি।
সাল ১৮৮৯: মার্গারিতা পিৎজা এবং প্রথম ফুড ডেলিভারি
রাফায়েল অ্যাস্পোসিতো ছিলেন একজন ইতালীয় শেফ এবং Pizzeria di Pietro e basta così (Pietro’s Pizzeria and that’s enough) নামক একটি সরাইখানার মালিক ছিলেন। যা ১৭৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অ্যাস্পোসিতোকে আধুনিক পিৎজার জনক বলে মনে করা হয়।
তৎকালীন স্যাভয় এর রাজা উমবার্তো এবং রাণি মার্গারিতার নেপোলস শহর প্রদর্শনে আসলে সম্মানস্বরূপ তাদেরকে সেরা পিৎজা আইটেম সার্ভ করা হয়েছিল। তবে মতভেদে জানা যায়, রানীর অসুস্থতার দরুন বিশেষ নির্দেশে রাফায়েল তার আইকনিক তিনটি পিৎজা রানীর জন্য পাঠায়।
ইতিহাসের সাক্ষী এই পিৎজাগুলো তৈরিও হয়েছিল বিশেষভাবে। আর তাদের মেজর ডিসটি ছিল ইতালিয়ান জাতীয় পতাকা থেকে বাছাই করা রঙ দিয়ে। রানীর পছন্দের শীর্ষে থাকায় রানীর সম্মানে রাফায়েল এই পিৎজাটির নামকরণ করেন ‘মার্গারিতা পিৎজা’।
সাল ১৮৯০: ডাব্বাওয়ালার সাথে ভারতের ফুড ডেলিভারি বিবর্তন
ডাব্বাওয়ালা-একদল লোক যারা খাবার পৌঁছে দেয়। ১৮৯০ সালে এই ছোট্ট ছোট্ট ডাব্বাওয়ালা গ্রুপগুলোই ভারতে রাতারাতি সাড়া জাগিয়ে দেয়। কারণ, তাদের কাজটি ছিল সাধারণ মানুষের কর্মস্থলে গিয়ে দুপুরের খাবার পৌঁছে দেয়া। যা নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী একটি উদ্যোগ ছিল সেই সময়।
শিল্পোন্নতি ও নগরায়িত হওয়ার উদ্দেশ্য যখন চরম কর্মব্যস্ততায় ডুবে গোটা ভারত, তখনই ব্যস্ত মানুষগুলোর কাছে বাড়ির খাবার পৌঁছে দিয়েছে ডাব্বাওয়ালা। তাই ১৮৯০ সাল থেকে ভারতের কাছে একটি আবেগ ও ফুড ডেলিভারি সার্ভিস বিপ্লবের নাম ডাব্বাওয়ালা। শুরুটা মুম্বাইয়ে হলেও ধীরে ধীরে ভারতের সবগুলো স্টেটে ছড়িয়ে পরে এই গ্রুপ ও তাদের সেবা।
আর উল্লেখযোগ্য বিবর্তনের পর এখনও সসম্মানে টিকে আছে ডাব্বাওয়ালার সার্ভিস। সাথে যুক্ত হয়েছে ওয়েবসাইট ও অ্যাপস অর্ডারের মতো আধুনিক প্রযুক্তি যা তাদের দিয়েছে এক নতুন মাত্রা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ফুড ডেলিভারি সার্ভিসের যোগসূত্র
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেন বিশ্ববাসীর জন্য চরম হতাশা ও বিভীষিকাময় একটি যুগ। এসময়ে হোম ফুড ডেলিভারি কোনো আরামপ্রিয় মানুষের চাহিদা কিংবা বিলাসিতার বহিঃপ্রকাশ ছিল না। চরম নিরাপত্তাহীণতা ও অর্থনৈতিক দূরাবস্থার শিকার বৃটিশ জনগণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকার, শেফ ও সেচ্ছাসেবী নিযুক্ত করে দেয়। যারা দেশবাসীর ঘরে ঘরে রেডি-মিল পৌঁছে দিতো।
১৯২২: আমেরিকায় চাইনিজ ফুড ডেলিভারি সার্ভিস
১৯২০ সাল, ভারত যেখানে ফুড ডেলিভারিতে অনেকটা এগিয়ে গেছে সেখানে আমেরিকাতেও বেড়েছে হোম ডেলিভারির উপর চরম আকর্ষণ। আর এই চাহিদাকে পুঁজি করেই তৎকালীন জনপ্রিয় চাইনিজ রেস্তোরাঁ Kin-Chu cafe’s ad শুরু করে ফুড ডেলিভারির ইতিহাস-এ নতুন যাত্রা।
তাদের এই সেবাকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে নিতে তারা চালু করে ফোন কলের মাধ্যমে খাবার অর্ডার সুবিধা। আর এই সেবা চলতো কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু করে রাত একটা অবধি। এই সার্ভিসের আমেরিকানরা এত বেশি সন্তুষ্ট হয়েছিল যে তৎকালীন বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হোম ডেলিভারির অর্ডার আসতো কর্মব্যস্ত এই দেশেই। এবং শতাব্দী ঘুরে আজকের এই দিনে সবচেয়ে বেশি অর্ডার করা খাবার কিন্তু চাইনিজ খাবারগুলো।
সাল ১৯৫০: রেস্টুরেন্ট ফুড ডেলিভারির যুগান্তকারী যাত্রা
টেলিভিশনের রেভ্যুলেশন কিভাবে ফুড ডেলিভারির উপরে প্রভাব ফেলে তা পরিস্কার হয় ১৯৫০ সালে৷ মানুষ তখন রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার থেকে ঘরে বসে প্রিয় টিভি শো দেখতে দেখতে ডিনার করাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। এমনকি চাহিদা এত বেশি ছিল যে কিছু রেস্তোরাঁ তো টেলিভিশন মেন্যু দেখানোর ট্রেন্ডও চালু করে দিয়েছিল!
আর ফুড ডেলিভারি নিয়ে এই ট্রেন্ড এখন পর্যন্ত হারিয়ে যায়নি। বরং আজকের এই ভার্চুয়াল ডিপেন্ডেবল যুগে সব রেস্টুরেন্টের আছে হোম ডেলিভারি সেবা।
১৯৬০: ডেলিভারি স্পিডে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন
সাল ১৯৬০, বিশ্ব যখন মোটর, ইঞ্জিন ও টেকনোলজির হুইলে ঘুরছে তখন ডেলিভারি সেবাতেও এসেছে আশ্চর্যজনক পরিবর্তন। জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ Dominos তো গ্যারান্টি দিয়ে বসে, ৩০ মিনিট বা তারও কম সময়ে খবার পৌঁছে দেয়ার। যদিও অসতর্ক ড্রাইভিং-এর আশংকা থেকে এই অফারটি তুলে নেয়া হয়। তবে আজ আমি আপনি কিন্তু সেই ত্রিশ মিনিটের কম সময়েই খাবার হাতে পেয়ে যাচ্ছি।
১৯৯৪: অনলাইন ভিত্তিক ফুড ডেলিভারির প্রথম ধাপ, পিৎজা নেট
বিশ্ববাসী যখন ধীরে ধীরে পরিচিত হচ্ছে অনলাইন নির্ভর সেবার সাথে, হোম ফুড ডেলিভারি সার্ভিস তখন চাহিদার তুঙ্গে। তাই এই সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে পিৎজা হাট চালু করে তাদের ওয়েবসাইট ভিত্তিক ফুড অর্ডার সার্ভিস ‘পিৎজানেট‘। আর বর্তমানে রেভ্যুলেশনারী অনলাইন ডেলিভারি সেবার ডিজিটাল রোল মডেলটি আসে এই পিৎজা নেট থেকে।
আর এখানে আবারও ঘটে সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। যেখানে ইতিহাসের সর্বপ্রথম ডেলিভারি করা খাবার ছিল পিৎজা, সেখানে অনলাইন অর্ডার করা প্রথম খাবারটিও কিন্তু ছিল সেই পিৎজা!
সাল ১৯৯৫: ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েটার এর সাথে বিশ্বের সর্বপ্রথম ফুড ডেলিভারি নেটওয়ার্ক
১৯৯৫ সালে, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েটার নামক এই প্লাটফর্মটি ৬০টিরও বেশি রেস্টুরেন্টে নিয়ে শুরু করে ফুড নেটওয়ার্ক। ক্রেতারা চাইলেই তাদের পছন্দসই রেস্টুরেন্টে থেকে এই প্লাটফর্ম এর মাধ্যমে খাবার অর্ডার করতে পারবে। শুধুমাত্র স্যান ফ্রান্সিসকোতে চালু হওয়া এই সেবা এখন ছড়িয়ে গেছে পুরে বিশ্ব। বেশিদূর যেতে হবে না, আপনার-আমার খুব পরিচিত ফুড পান্ডাই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ!
ফুড ডেলিভারির ইতিহাসে ২১ শতকের ফুড ডেলিভারি বিপ্লব
একুশ শতক, স্মার্ট ফোনে ডুবে থাকা মানুষের হাতের মুঠোয় পুরো বিশ্ব। এমন সময় ধীরে ধীরে লঞ্চ হতে থাকে রেস্টুরেন্টগুলোর নিজস্ব ডেলিভারি সার্ভিস, অনলাইন ওয়েবসাইট, অ্যাপস কিংবা ফোন কলে অর্ডারের মতো সুবিধা। আর ব্যস্ততম কিংবা আরামপ্রিয় সর্বস্তরের মানুষ লুফে নেয় এই সেবাটি।
২০১০ সাল থেকে শুরু হয় আরো এক নতুন ট্রেন্ড, তা হলো হোমমেড ফুড! আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, কিংবা যত ব্যস্তই হোন না কেন, ঘরোয়া স্বাদের খাবার মুহুর্তেই পৌঁছে যাবে আপনার কাছে। আর এই ট্রেন্ড যেন ফুড ডেলিভারিকে নিয়ে গেছে এক অন্য মাত্রায়।
এখন কোন অবস্থানে আছে চাহিদার শীর্ষে থাকা ফুড ডেলিভারি সার্ভিস ?
বিশেষ নির্দেশে চালু হওয়া রয়্যাল ফুড ডেলিভারির যাত্রা এখন পৌঁছে গেছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর পর্যায়ে। ২০২০ সালের করোনা মহামারীর সময় থেকেই ফুড ডেলিভারিতে ব্যবহৃত হচ্ছে সর্বোচ্চ প্রযুক্তি।
ডমিনোস ইতোমধ্যে ড্রোন-এর মাধ্যমে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে খুব স্বল্প সময়ে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়-ইয়ানডেক্স সেন্ট্রাল মস্কোতে রোবটের মাধ্যমে খাবার ডেলিভারি করা শুরু করেছে।
গ্লোবাল ফুড সার্ভিস অ্যানালিস্টদের মতে, ২০২৫ নাগাদ ফুড ডেলিভারি সার্ভিসে খাতের আয় ১৯২.১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারকেও ছাড়িয়ে যাবে।
বিশ্বায়নের এই যুগে মানুষ সবকিছুকে আরো সহজভাবে পেতে চায়। যেখানো পুরো বিশ্বকে রাখতে চায় হাতের মুঠোয়, সেখানে ঘরে বসে ফুড ডেলিভারির চাহিদা নেহাৎই সাধারণ বিষয়। ফুড ডেলিভারির ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলেই আমরা দেখতে পাই এই সেবার চাহিদা এতটাই প্রকট যে দিন দিন শুধু এর পরিধি বেড়েই চলছে।
প্রাচীন রোমে শুরু হওয়া সেবাটি এখন চলে গেছে সর্বোচ্চ টেকনোলজি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পর্যায়ে। সর্বোপরি, ফুড ডেলিভারির ইতিহাস সকল খাতেই ইতিবাচক পরিবর্তনের নিয়ে এগিয়ে যাক মানবসভ্যতা।
Feature Image: deliverect.com 01. The History of Food Delivery. 02. The History of Food Delivery. 03. History of Food Delivery and How it Changed.