বছর ঘুরে চলে আসে পবিত্র মাহে রমজান। রোজার রাখতে এবং রোজা ভাঙতে সেহেরি এবং ইফতারিতে থাকে হরেকরকম খাবার এবং পানীয়ের আয়োজন। রুহ আফজা ঠিক তেমনই একটি জনপ্রিয় পানীয় যা অনেকেই ইফতারের অপরিহার্য অংশ হিসেবে বেছে নিয়েছে।
সারাবছর এই পানীয় কেনার চল থাকলেও রমজান মাসে সুপার শপ, মুদি দোকান এমনকি ওষুধের দোকানেও দেখা মেলে রুহ আফজার। কারণ এই সময়ে রুহ আফজার চাহিদা থাকে তুঙ্গে। বাংলাদেশে এখনও রমজান এলেই ঘরে ঘরে রুহ আফজার একটি বোতল দেখা যায়ই। ১০০ বছরেরও পুরনো এই জনপ্রিয় পানীয়র যাত্রার ইতিহাস নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
গোড়াপত্তন
হামদর্দের প্রতিষ্ঠাতা, হাকিম হাফিজ আব্দুল মজিদের হাত ধরেই রুহ আফজার যাত্রা শুরু হয়। তাই রুহ আফজা সম্পর্কে জানতে হলে শুরুতে এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। হাকিম হাফিজ আব্দুল মজিদ ১৮৮৩ সালে ভারতের পেলিভেটে জন্মগ্রহণ করেন।
শিক্ষাজীবনে, তিনি পবিত্র কুরআন সম্পূর্ণরূপে মুখস্থ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তিনি ফারসি ভাষা শেখার দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। এরপর তিনি ইউনানি চিকিৎসায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯০৬ সালে তিনি দিল্লির জনগণকে ইউনানি চিকিৎসা প্রদানের জন্য হামদর্দ প্রতিষ্ঠা করেন।
হামদর্দ শব্দটি দুটি ফার্সি শব্দ, “হাম” এবং “দর্দ” এর সংমিশ্রণ, যার অর্থ ‘একজন অংশীদার যিনি ব্যথা উপশম করতে সহায়তা করতে পারেন।’ সেই সময় বিভিন্ন ধরনের ইউনানি ওষুধ প্রয়োগ করে রোগীদের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা দিতেন তিনি। এছাড়া তিনি বিভিন্ন রোগের জন্য বেশ কিছু ভেষজ ও ইউনানি ওষুধও তৈরি করেন।
১৯০৭ সালের কোন একদিনে ওষুধ তৈরি করার সময় হাকিম আবদুল মজিদ একটি নতুন সিরাপ তৈরি করেছিলেন যাতে বেশ কয়েকটি ভেষজ এবং ফলের মিশ্রণ ছিল।
তিনি হিট স্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন এবং ডায়রিয়ার মতো রোগের চিকিৎসার জন্য ইউনানি ওষুধ হিসাবে এই ঘন লাল রঙের সিরাপ তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন এবং এর নামকরণ করেছিলেন ‘রুহ আফজা’।
গোলাপ, কেওড়া, গাজর, পালং শাক এবং ওয়াইন-ভেজানো কিশমিশের নির্যাস দিয়ে তৈরি হতো রুহ আফজা। এই পানীয়টি ভারতে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ এটি ঠান্ডা পানি বা দুধের সাথে পান করা যেতো এবং খুব সুস্বাদুও ছিল, যা শরীরে গ্রীষ্মের দাবদাহ কমিয়ে প্রশান্তি আনতে পারে।
যাত্রা শুরু
রুহ আফজার ক্রমাগত জনপ্রিয়তা দেখে হাকিম হাফিজ আব্দুল মজিদ এটি সঠিকভাবে বাজারজাত করার উপায় খোঁজা শুরু করেন। ১৯১০ সালে রূহ আফজা-এর লোগো তৈরি করতে মির্জা নুর আহমদের সাহায্য নেন। লোগোটি ব্যবহৃত উপাদানের কথা মাথায় রেখে ডিজাইন করা হয়েছে।
যেহেতু দিল্লির ছাপাখানাগুলো সেই সময়ে উন্নত ছিল না, তাই তারা বোম্বেতে লোগোটি ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেয় যাতে লোগোর রং সঠিকভাবে ছাপানো যায়। রুহ আফজা-এর স্বাদ এবং দারুণ বিপণন কার্যক্রমের জন্য খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।
সাধারণ মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাতে পারতো রুহ আফজা। বিশেষ করে ১৯১৫ সালে, রুহ আফজা দিল্লির মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সাফল্যের ঊর্ধ্বগতি
দুর্ভাগ্যক্রমে, হাকিম হাফিজ আব্দুল মজিদ রুহ আফজার জনপ্রিয়তা বেশিদিন দেখে যেতে পারেননি। তিনি ১৯২২ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে মারা যান এবং তার স্ত্রী রাবিয়া বেগম হামদর্দের দায়িত্বে আসেন।
দায়িত্ব নেওয়ার পর, রাবিয়া বেগম হামদর্দকে ইসলামিক চ্যারিটেবল ট্রাস্ট বা ওয়াকফ হিসাবে ঘোষণা করেন, যেখানে হামদর্দের সম্পূর্ণ লাভ জনকল্যাণে ব্যবহার করা হবে।
শুরুতে, একটি ছোট রান্নাঘরে রুহ আফজাহ প্রস্তুত এবং বোতলজাত করা হতো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এর জনপ্রিয়তা ও চাহিদা বাড়তে থাকায় ১৯৪০ সালে পুরানো দিল্লির দরিয়াগঞ্জে একটি কারখানা স্থাপিত হয়।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগ রুহ আফজাকে সাফল্যের শীর্ষ ছুঁতে সাহায্য করে। কারণ দেশভাগের পর হাকিম সাহেবের বড় ছেলে হাকিম আবদুল হামিদ ভারতে থেকে যান। কিন্তু ছোট হাকিম মোহাম্মদ পাকিস্তানে চলে যান।
তিনি ইস্টার্ন মেডিসিনে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেছিলেন। করাচিতে এসে একটি ছোট ভাড়া বাড়িতে একটি পৃথক হামদর্দ কোম্পানি খোলেন। যা ‘তিব্ব-ই-ইউনানি’ নামে একটি ক্লিনিক এবং বর্তমানে হামদর্দ পাকিস্তান।
পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে একই সাফল্যের পর পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) একটি শাখা চালু করেন। তবে পাকিস্তানে রুহ আফজা তৈরি করতে গিয়ে উপাদান সংগ্রহ করতে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
যেমন রুহ আফজার একটি উপাদান কেওড়া। এটি পাকিস্তানে পাওয়া যায় না। তাই মুহাম্মদ সাঈদ কেওড়ার পরিবর্তে খুব অল্প পরিমাণে বসন্ত গোলাপ বা গুল-ই-বাহার ব্যবহার করেছিলেন। আরেকটি উপাদান হলো তুরাং বা সিট্রন ফুল, যেটি পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে মাত্র এক মাসের জন্য ফোটে।
যা তিনি ডিস্টিল্ড বা পাতন হিসাবেও ব্যবহার করতেন। তবে উপাদানগুলোতে কিছু ছোটখাটো পরিবর্তন সত্ত্বেও, হামদর্দ, পাকিস্তানে তৈরি রুহ আফজা এবং ভারতের হামদর্দের মধ্যে সামান্য পার্থক্য ছিল।
বাংলাদেশে যাত্রা
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের একটি সূত্রের মতে, হামদর্দের ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কার্যক্রম স্বাধীনভাবে চলে। তবে তিন দেশে হামদর্দের রুহ আফজার স্বাদ, আবহাওয়া এবং পরিবেশের উপর নির্ভর করে কিছুটা ভিন্ন হয়ে থাকে। ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, মোহাম্মদ সাঈদ ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বন্ধ না করে বাংলাদেশী ব্যবস্থাপনার কাছে হস্তান্তর করেন।
বাংলাদেশি এই ব্যবসায়ী হামদর্দ নামে একই ব্যবসা চালিয়ে যান। এভাবে বাংলাদেশেও স্থান করে নেয় রুহ আফজা। বর্তমানে, হামদর্দ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান, যেখানে দাতব্য হাসপাতালের পাশাপাশি স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
যেহেতু হামদর্দ একটি ওয়াকফ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, তাই রুহ আফজার জন্য কোনো বিক্রয় বা আর্থিক তথ্য পাওয়া যায় না। রুহ আফজার জনপ্রিয়তা এত বেশি যে শুধুমাত্র ভারতেই প্রতি বছর প্রায় ৪৫ মিলিয়ন ডলারের সমমূল্যে রূহ আফজা বিক্রি হচ্ছে এবং প্রাপ্ত লাভ একটি ট্রাস্টে যায় যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলিতে অর্থায়ন করে।
Feature Photo: unanicart.com Sources: 01. About- Rooh Afza. 02. Rooh Afza. 03. History of Rooh Afza and how it became a household name in 3 countries. 04. The Success History of Rooh Afza and Hamdard. 05. The Success Story of a 113 years old drink: Rooh Afza.