শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ৫ ব্যায়াম

369
0

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যায়াম হলো সবচেয়ে কার্যকর কৌশলগুলির মধ্যে একটি। যা শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমাতে সাহায্য করে। এটি উল্লেখযোগ্য হারে ক্যালোরি ক্ষয় করে এবং ওজন কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ওজন কমাতে সাহায্য করার পাশাপাশি, ব্যায়ামের আরও অনেক উপকারিতা রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- নিয়ন্ত্রিত মেজাজ, মজবুত হাড়, এবং অনেক দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি হ্রাস। 

আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য ব্যায়াম অপরিহার্য। ভালো স্বাস্থ্য এবং ওজন হ্রাস পরস্পর সম্পর্কিত একটা বিষয়। যদি একজন ব্যক্তির শরীরে চর্বির পরিমাণ বেশি থাকে, তবে তার উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল এবং হৃৎপিন্ডের নানান সমস্যার সাথে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি থাকে। এই অবস্থার কার্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যায়াম করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

মানুষ যদি সারাদিন বসে থাকে এবং প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘণ্টার জন্য ব্যায়াম করে তাহলেও তা ধীর প্রক্রিয়ায় শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমাতে সাহায্য করবে। তাই, আপনার শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমাতে সাহায্য করার জন্য ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিদিনের ঘন্টাগুলিতে আপনার কী করা উচিত? আজকের আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় তা। কার্যকর ফলাফল দেখার জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ ৫টি ব্যায়াম অবশ্যই করতে হবে।  

১. হাঁটা 

হাঁটাকে ওজন কমানোর সেরা ব্যায়াম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দ্রুত গতিতে হাঁটা ক্যালোরি ক্ষয় করার জন্য একটি দুর্দান্ত ব্যায়াম। কোন সরঞ্জাম কেনার প্রয়োজন ছাড়াই ব্যায়াম শুরু করার এটি একটি সুবিধাজনক এবং সহজ উপায়। এছাড়াও, এটি অল্প পরিশ্রমে করার মতো একটি ব্যায়াম; যার অর্থ এটি আপনার জয়েন্টগুলিতে অতিরিক্ত চাপ দেয় না। 

এটি অল্প পরিশ্রমে করার মতো একটি ব্যায়াম। Image source: Daniel Reche/Pixabay

বিশেষজ্ঞদের গবেষণা অনুসারে, একজন ব্যক্তি প্রতি সপ্তাহে ৩ বার ৫০-৭০ মিনিট হাঁটার মাধ্যমে তাদের শরীরের চর্বি গড়ে ১.৫% এবং কোমরের পরিধি ২.৮ সেন্টিমিটার কমাতে পারে। হার্ভার্ড হেলথের মতে, একজন ১৫৫ পাউন্ড (৭০ কেজি) ওজনের ব্যক্তি প্রতিদিন ৪ মাইল (৬.৪ কিমি/ঘন্টা) মাঝারি গতিতে হাঁটার ফলে প্রতি ৩০ মিনিটে প্রায় ১৭৫ ক্যালোরি পোড়ায়। আপনার দৈনন্দিন রুটিনে হাঁটাকে অন্তর্ভুক্ত করা সহজ। 

আপনার প্রতিটি দিনকে আরও কার্যক্ষম করতে, আপনার মধ্যাহ্নভোজের বিরতির সময় হাঁটার চেষ্টা করুন। কর্মক্ষেত্রে লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি ব্যবহার করুন বা দ্রুতগতিতে হাঁটার জন্য আপনার পোষা প্রাণিকে সঙ্গে নিয়ে যান। শুরুর দিকে, সপ্তাহে ৩-৪ বার ৩০ মিনিট হাঁটার প্রতি লক্ষ্য রাখুন। আপনি ধীরে ধীরে আরও অভ্যস্ত বা উপযোগী হওয়ার পর আপনার হাঁটার সময়কাল বাড়াতে পারেন।

২. জগিং বা দৌড়ানো 

জগিং এবং দৌড় আপনার ওজন কমাতে সাহায্য করার জন্য দুর্দান্ত ব্যায়াম। জগিং এবং দৌড়কে ওজন কমানোর ব্যায়ামের রাজা বলে মনে করা হয়। এই ব্যায়ামটি সম্পূর্ণ শরীরের সমন্বিত ব্যায়াম। এটি আপনার পা মজবুত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। দৌড়ানো এবং জগিংয়ের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো গতি। একটি জগিং-এর গতি সাধারণত ৪-৬ মাইল (৬.৪-৯.৭ কিমি/ঘণ্টা) এর মধ্যে হয়, যখন দৌড়ের গতি ৬ মাইল (৯.৭ কিমি/ঘন্টা) এর চেয়ে দ্রুত হয়।  

একজন ১৫৫ পাউন্ড (৭০ কেজি) ওজনের ব্যক্তি প্রতি ৩০ মিনিটে ৫ মাইল (৮ কিমি/ঘন্টা) গতিতে জগিংয়ে প্রায় ২৮৮ ক্যালোরি বা ৬ মাইল (৯.৭ কিমি/ঘণ্টা) গতিতে ৩০ মিনিটে ৩৬০ ক্যালোরি পোড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, জগিং বা দৌঁড়ানো পেটের চর্বি পোড়াতে সাহায্য করে। এই ধরনের চর্বি আপনার অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলির চারপাশে আবৃত করে থাকে। ফলে এটি হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের মতো বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

জগিং এবং দৌড় আপনার ওজন কমাতে সাহায্য করার জন্য দুর্দান্ত ব্যায়াম। Image source: Maciej Cieslak/Pixabay

জগিং এবং দৌড় উভয়ই দুর্দান্ত ব্যায়াম যা যেকোনো জায়গায় করা যেতে পারে। শুরুতে, প্রতি সপ্তাহে ৩-৪ বার ২০-৩০ মিনিট জগিং করুন। দৌড়ানো এবং জগিং এর ফলে যথাক্রমে প্রতি ৩০ মিনিটে ৩৭২ ক্যালোরি এবং ২৯৮ ক্যালোরি পুড়ে বা ক্ষয় হয়।

নিয়ম

আপনার দৈনন্দিন সময় থেকে ১ ঘন্টা আলাদা করুন। তারপর, হাঁটা এবং জগিং-এর মতো ব্যায়ামগুলিকে আপনার রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করুন।

  • ১৫ মিনিটের জন্য হাঁটার ব্যায়াম দিয়ে শুরু করুন।
  • আপনার গতি বাড়ান এবং পরবর্তী ১৫ মিনিটের জন্য জগিং শুরু করুন।
  • গতি ক্রমাগত বৃদ্ধির সাথে, আরও ১৫ মিনিটের জন্য দৌঁড়ান।
  • আপনার গতি কম করুন এবং ১০ মিনিটের জন্য জগিংয়ে ফিরে আসুন।
  • আপনার শরীরকে শিথিল করুন এবং আপনার গতি কমিয়ে দিন এবং ৫ মিনিট হাঁটুন।

৩. সাইকেল চালানো 

সাইকেল চালানো একটি জনপ্রিয় ব্যায়াম যা আপনার শরীরের গঠন উন্নত করে এবং আপনাকে ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে। অনেক জিম এবং ফিটনেস সেন্টারে স্থির বাইক রয়েছে যা আপনাকে বাড়ির ভিতরে থাকার সময় সাইকেল চালানোর অনুমতি দেয়।

হার্ভার্ড হেলথ এর মতে, একজন ১৫৫ পাউন্ড (৭০ কেজি) ওজনের ব্যক্তি মাঝারি গতিতে একটি স্থির বাইকে প্রতি ৩০ মিনিটে প্রায় ২৫২ ক্যালোরি বা সাইকেলে প্রতি ৩০ মিনিটে ২৮৮ ক্যালোরি ক্ষয় করে।

সাইকেল চালানো একটি জনপ্রিয় ব্যায়াম। Image source: Mabel Amber/Pixabay

সাইকেল চালানো শুধুমাত্র ওজন কমানোর জন্যই দুর্দান্ত ব্যায়াম নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত সাইকেল চালায় তাদের সামগ্রিক সুস্থতা, ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি এবং হৃদরোগ, ক্যান্সার এবং মৃত্যুর ঝুঁকি কম, যারা নিয়মিত সাইকেল চালায় না তাদের তুলনায়। এটি সমস্ত স্তরের মানুষের জন্যই কার্যকর ব্যায়াম, নতুন থেকে ক্রীড়াবিদ পর্যন্ত। 

সাইকেল চালানোর ফলে আপনার শরীরের যাবতীয় জয়েন্টগুলিতে খুব বেশি চাপ পড়বে না। আপনি যদি দৌঁড়াতে পছন্দ না করেন তবে এটি হলো জগিং-এর একটি বিকল্প যা আপনার হৃদস্পন্দনের গতি বাড়িয়ে দেবে। তবে সাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে গতির চেয়ে প্যাডেল ঠেলে দেওয়ার দিকে বেশি মনোনিবেশ করতে হবে। এক্ষেত্রে আপনি প্যাডেলে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে সাইকেলের গতি কম-বেশি করে মোট ৩০-৩৭ মিনিটের একটি ব্যায়াম করতে পারেন।

৪. সাঁতার কাটা 

সাঁতার এমন একটি কার্যকর ব্যায়াম যা আপনাকে দক্ষতার সাথে পানিতে চলাফেরা করতে এবং অক্সিজেনকে সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে সাহায্য করে। আপনার ব্যায়াম করার জন্য কেবল ৭৮ ডিগ্রির কাছাকাছি তাপমাত্রার পানিতে সাঁতার কাটার ফলে স্থলভাগের চেয়ে আরও বেশি ক্যালোরি পোড়াতে সক্ষম হবেন। কারণ আপনার শরীরের প্রাকৃতিক তাপমাত্রা ৯৮.৬ ডিগ্রি। এটি ক্যালোরি এবং চর্বি পুড়িয়ে পানিতে নিজেকে উষ্ণ রাখতে সহায়তা করে। 

এছাড়াও আপনি আপনার হাত, পাসহ সমস্ত শরীরকে ব্যবহার করছেন আপনাকে ভাসতে সাহায্য করার জন্য এবং এটিই সাঁতারকে একটি দুর্দান্ত শারীরিক ব্যায়াম করে তোলে। হার্ভার্ড হেলথ এর মতে, একজন ১৫৫ পাউন্ড (৭০ কেজি) ওজনের ব্যক্তি প্রতি আধা ঘন্টা সাঁতারে প্রায় ২১৬ ক্যালোরি পোড়ায়।  

সাঁতার একটি দুর্দান্ত শারীরিক ব্যায়াম। Image source: StockSnap/pixabay

আপনি কীভাবে সাঁতার কাটছেন তার উপর নির্ভর করে আপনি কত ক্যালোরি ক্ষয় করছেন। প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারুদের উপর একটি গবেষণা করে দেখা গেছে যে তারাই সাঁতারের সময় সর্বাধিক ক্যালোরি হারান অন্যান্য স্বাভাবিক সাঁতারুদের তুলনায়।

একটি ১২ সপ্তাহের সমীক্ষায় ২৪ জন মধ্যবয়সী মহিলাদের মধ্যে দেখা গেছে যে প্রতি সপ্তাহে ৩ বার ৬০ মিনিট করে সাঁতার কাটার ফলে তাদের শরীরের চর্বি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। সাঁতার দেহের নমনীয়তা উন্নত করে এবং উচ্চ কোলেস্টেরল এবং রক্তের ট্রাইগ্লিসারাই সহ বেশ কয়েকটি হৃদরোগের ঝুঁকির কারণগুলি হ্রাস করে। সাঁতারের আরেকটি সুবিধা হল এটি এমন ব্যক্তিদের জন্য একটি দুর্দান্ত বিকল্প ব্যায়াম যাদের আঘাত বা জয়েন্টে ব্যথা রয়েছে।

৫. যোগব্যায়াম 

যোগব্যায়াম হলো ৫০০০ বছরের পুরনো শারীরিক ক্রিয়াকলাপ যা ওজন কমানোর কার্যকর থেরাপি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এটি ঋষি এবং ব্রাহ্মণদের দ্বারা উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করা হয়। যোগব্যায়ামের ৫টি মৌলিক নীতি রয়েছে: ব্যায়াম, খাদ্য, শ্বাস, শিথিলতা এবং ধ্যান। যোগব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর খাবারের সংমিশ্রণ উপকারী প্রমাণিত হয়েছে কারণ এটি আপনার শরীর ও মনকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি ওজন কমাতে সাহায্য করে। এটি আপনার মননশীলতা এবং আপনার শরীরের সাথে সম্পর্ক উন্নত করে।

ওজন কমানোর পাশাপাশি যোগব্যায়ামের আরও সুবিধা রয়েছে। যেমন:

  • উন্নত কার্ডিও স্বাস্থ্য
  • পেশীর স্বর বৃদ্ধি
  • সুষম বিপাক
  • উন্নত শ্বসন
  • বর্ধিত নমনীয়তা
  • মানসিক চাপ মুক্তি 
যোগব্যায়াম হলো ৫০০০ বছরের পুরনো শারীরিক ক্রিয়াকলাপ। Image source: Okan Caliskan/Pixabay

যোগব্যায়াম ভঙ্গি ওজন কমানোর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যোগব্যায়াম ওজন কমানোর জন্য একটি আদর্শ ব্যায়াম। গবেষণায় দেখা যায় যে, যোগব্যায়াম মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে। আপনি যদি ওজন কমানোর লক্ষ্যে থাকেন, যোগব্যায়াম এর নিয়মিত অনুশীলন আপনাকে শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমাতে সাহায্য করবে। এটি সঠিক মাত্রায় ক্যালোরি পোড়ায় এবং অনেক স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করে যা ওজন কমাতে পারে। হার্ভার্ড হেলথ অনুযায়ী, একজন ১৫৫ পাউন্ড (৭০ কেজি) ওজনের ব্যক্তি প্রতি ৩০ মিনিটে যোগব্যায়াম অনুশীলনে প্রায় ১৪৪ ক্যালোরি পোড়ায়। 

স্থূলতায় আক্রান্ত ৬০ জন মহিলার ১২ সপ্তাহের সমীক্ষায় দেখা গেছে যে যারা প্রতি সপ্তাহে দুটি ৯০ মিনিট এর যোগব্যায়াম সেশনে অংশ নিয়েছিল তাদের অংশ না নেয়া গ্রুপের তুলনায় কোমরের পরিধি বেশি হ্রাস পেয়েছে-গড়ে ১.৫ ইঞ্চি (৩.৮ সেমি)। উপরন্তু, যোগব্যায়াম গ্রুপ মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতার উন্নতি অনুভব করেছে। বেশিরভাগ জিম যোগব্যায়াম ক্লাস অন্তর্ভুক্ত করে থাকে। তবে আপনি আপনার নিজের বাড়ি থেকে শুরু করে যেকোন জায়গায় যোগব্যায়াম অনুশীলন করতে পারেন। আপনি ঘরে বসে অনলাইনে যোগব্যায়াম ক্লাস করতে পারেন এবং প্রচুর টিউটোরিয়াল দেখতে পারেন। 

ব্যায়ামের মাধ্যমে আপনি বাস্তবিক কতটা ওজন কমানোর আশা করতে পারেন তা অনেকগুলি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞরা প্রতি সপ্তাহে ১-৩ পাউন্ড করে ওজন কমানোর পরামর্শ দেন। কেননা, খুব দ্রুত ওজন হ্রাসের ফলে স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এর ফলে পেশীর ক্ষয়, পানিশূন্যতা, ক্লান্তি, অপুষ্টি, মাথাব্যথা, বিরক্তি, কোষ্ঠকাঠিন্য, এবং চুল পড়ার মতো অবস্থার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। 

 

 

Feature Image: Mabel Amber/Pixabay 
References: 

01. The 8 Best Exercises for Weight Loss. 
02. 13 Best Exercises for Weight Loss, According to Experts and Research. 
03. 7 Best Exercises To Lose Weight At Home. 
04. 4 Effective Workout Strategies for Reducing Body Fat.