প্রাচীন মিশরের জাদুবিদ্যা

556
0

রহস্যময় পিরামিড, ফেরাউনের মমি অথবা অনন্য শাসন ব্যবস্থা ছাড়াও প্রাচীন মিশর আরও একটি বিষয়ের জন্য বিখ্যাত। তা হলো বিচিত্র জাদুবিদ্যা। তাদের ধর্ম, দেবতা, দেবী থেকে শুরু করে চিকিৎসা, নিরাপত্তা অর্থাৎ প্রাত্যহিক জীবনে জড়িয়ে আছে জাদুবিদ্যা। আজ কথা হবে মিশরের জাদুবিদ্যার মন্ত্রমুগ্ধ গল্প নিয়ে। 

জাদুকর

মিশরের মিথ বা পৌরাণিক কাহিনিতে, জাদু বলতে মূলত বোঝানো হতো হেকাকে। হেকা বিশ্ব তৈরিতে সৃষ্টিকর্তার ব্যবহৃত শক্তিগুলোর একটি। সমস্ত দেবতা এবং মানুষ কিছু পরিমাণে এই শক্তির অধিকারী বলে মনে করা হতো। তবে কেন এবং কীভাবে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে সেই সম্পর্কে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল।

পুরোহিতরা ছিল ফেরাওনিক মিশরে জাদুবিদ্যার প্রধান অনুশীলনকারী। তাদের ‘ভাগ্যের আঘাত থেকে বাঁচতে’ দেবতাদের দেওয়া একটি গোপন জ্ঞানের অভিভাবক হিসাবে দেখা হতো। তারা মন্দির ও প্রাসাদের লাইব্রেরিতে রাখা জাদুর প্রাচীন বই পড়তে পারতেন। জনপ্রিয় গল্পগুলোতে তাদের মোমের প্রাণি জীবিত করার বা হ্রদের জল ফিরিয়ে আনার ক্ষমতার কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্রকৃত বক্তা পুরোহিতরা তাদের রাজাকে রক্ষা করার জন্য এবং মৃতদের পুনর্জন্মে সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন আচারবিধি সম্পাদন করতেন। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যে, তাদের ভূমিকা জাদুকররা (হেকাউ) দখল করে বলে মনে করা হয়। নিরাময় জাদু ছিল পুরোহিতদের একটি বিশেষত্ব যারা প্লেগের ভয়ঙ্কর দেবী ‘সেখমেটের’ (Sekhmet) সেবা করতো। 

কম অম্বো মন্দিরে দেবতা সেখমেটের প্রতিকৃতি Image source: https://en.wikipedia.org by I, Rémih

যারা বিষাক্ত সরীসৃপ এবং পোকামাকড় থেকে বাঁচানোর কাজ করতো, তারা নিম্ন মর্যাদার ছিল। মিডওয়াইফ এবং নার্সরাও তাদের দক্ষতার মধ্যে জাদু অন্তর্ভুক্ত করতো। আত্মা বা দেবতার দ্বারা সৃষ্ট সমস্যার জন্য ছিল বিশেষ জ্ঞানী নারীদের পরামর্শ। তাবিজ ছিল জাদু শক্তির আরেকটি উৎস, যা ‘সুরক্ষাকারীদের’ কাছ থেকে পাওয়া যেতো। 

কৌশল

ভোর ছিল জাদুবিদ্যার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। জাদুকরকে পবিত্র অবস্থায় থাকতে মন্ত্র শুরুর আগে স্নান করে নতুন বা পরিষ্কার পোশাক পরতে হবে। কেউ কেউ মেটালের তৈরি দণ্ড ব্যবহার করতো। এটি সাপের দেবী ‘গ্রেট অফ ম্যাজিকের’ প্রতিনিধিত্ব করে।

ভয়ঙ্কর দেবতা দিয়ে সজ্জিত, অর্ধবৃত্তাকার হাতির দাঁতের জাদুদণ্ড, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে ব্যবহৃত হয়েছিল। জাদুদণ্ড জাদুকরের ক্ষমতার প্রতীক ছিল, যা শক্তিশালী প্রাণিদের ডেকে এনে তার কথা মানতে বাধ্য করার জন্য ব্যবহৃত হতো।

জাদুঘরে সংরক্ষিত মিশরে ব্যবহৃত ম্যাজিক ওয়ান্ড বাঃ জাদুদণ্ড Image source: https://en.wikipedia.org

মিশরের মাত্র অল্প শতাংশই সম্পূর্ণ শিক্ষিত ছিল, তাই লিখিত জাদু ছিল সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ। এইসব মন্ত্রের ব্যক্তিগত সংগ্রহ ছিল মূল্যবান সম্পত্তি। তা বংশ পরম্পরায় পরিবারের মধ্যে হস্তান্তর করা হতো। এটি কখনও প্যাপিরাসে লেখা প্রতিরক্ষামূলক বা নিরাময় মন্ত্র, যা কখনও ভাঁজ করে শরীরে পরানো হতো।

একটি মন্ত্র সাধারণত দুটি অংশ নিয়ে গঠিত-যে শব্দগুলো উচ্চারণ করতে হবে এবং যে পদক্ষেপগুলো নিতে হবে তার বর্ণনা। দেবতাদের গোপন নাম সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে হবে। শব্দগুলো একটি তাবিজ, একটি মূর্তি বা একটি ওষুধের শক্তি সক্রিয় করা হতো। এই ওষুধগুলোতে অদ্ভুত উপাদান থাকতে পারে যেমন একটি কালো কুকুরের রক্ত, বা একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেওয়া নারীর দুধ। সঙ্গীত, নৃত্য, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদিও একটি মন্ত্রের অংশ হতে পারে।

সুরক্ষা

ক্ষুব্ধ দেবতা, ঈর্ষান্বিত আত্মা, বিদেশি দানব এবং জাদুকররা অসুস্থতা, বন্ধ্যাত্ব, দুর্ঘটনা, দারিদ্র্য এবং দুর্ভাগ্যের কারণ বলে মনে করা হতো। এসবের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা প্রদান করতে বিশেষ জাদুবিদ্যার প্রচলন ছিল। প্রতিরক্ষামূলক তাবিজ ছিল সবার জন্য, যা শক্তিশালী দেবতা বা প্রাণির রূপ নিতে পারে বা রাজকীয় নাম এবং প্রতীক ব্যবহার করতে পারে।  

প্রাচীন মিশরের প্রতিরক্ষামূলক তাবিজ Image source: https://en.wikipedia.org by Neek-Theri

নিরাময়

জাদু, চিকিৎসার পরিপূরক ছিল না। সর্বশেষ প্রাপ্ত মন্ত্রগুলোতে ডাক্তার, সেখমেট পুরোহিত এবং বিষাক্ত সরীসৃপ এবং পোকামাকড় থেকে বাঁচানোর কাজ যারা করতো তাদের কথা আছে। মন্ত্রগুলো প্রায়শই অতিপ্রাকৃত প্রাণিদের জন্য করা, কেননা তাদের রোগের চূড়ান্ত কারণ বলে বিশ্বাস করা হতো। 

যেহেতু অপশক্তি নোংরা জিনিস দ্বারা আকৃষ্ট হয় বলে মনে করা হতো, তাই কখনও কখনও রোগীর শরীরে গোবর দিয়ে তাদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করা হতো। অন্য সময় মধুর মতো একটি মিষ্টি পদার্থ ব্যবহার করা হতো তাদের তাড়ানোর জন্য। ডাক্তারের আরেকটি কৌশল ছিল রোগীর ত্বকে দেবদেবীর ছবি আঁকা। রোগী তারপর সেই ছবি চেটে তাদের নিরাময় ক্ষমতা শোষণ করতো।  

অনেক সময় চিকিৎসকরা মিশরের পৌরাণিক কাহিনির চরিত্রগুলোর সাথে নিজেকে চিহ্নিত করার জন্য মন্ত্র পড়তেন। যেমন, থোথ (Thoth) বা জাদুবিদ্যার দেবতা, যিনি দেবতা হোরাসের (Horus) ক্ষতবিক্ষত চোখ নিরাময় করেছিলেন। 

দেবতা থোথ-এর প্রতিকৃতি Image source: wikipedia.org by Djehouty

জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য কখনও মূর্তি এবং পাথরের ফলকে মন্ত্রের সংগ্রহগুলো খোদাই করা হতো। যেমন, সিপাস (cippus) নামে পরিচিত শিলালিপি যাতে পানি ঢেলে, সেই পানি পান করা হতো বা ক্ষত ধোয়াতে ব্যবহার করা হতো। 

অভিশাপ

যদিও জাদু প্রধানত রক্ষা বা নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত হতো, মিশরে ক্ষতি করার উদ্দেশ্যেও জাদু ব্যবহৃত হতো। বিদেশি শত্রু বা বিশ্বাসঘাতকদের নাম মাটির পাত্র, মূর্তিতে খোদাই করে পোড়ানো হতো, অথবা ভেঙে বা কবরস্থানে দাফন করা হতো এই বিশ্বাসে যে এটি শত্রুকে দুর্বল বা ধ্বংস করবে। 

প্রধান মন্দিরগুলোতে, পুরোহিতরা ঐশ্বরিক আদেশের শত্রুদের অভিশাপ দেওয়ার জন্য একটি অনুষ্ঠান করতো। যেমন অ্যাপোফিস, যে সূর্য দেবতার সাথে চিরকাল যুদ্ধে ছিল। অ্যাপোফিসের চিত্রগুলো প্যাপিরাসে এঁকে বা মোম দিয়ে তৈরি করে তাতে থুতু দিয়ে, পদদলিত করে, ছুরিকাঘাত শেষে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

সূর্য দেবতা ও অ্যাপোফিসের যুদ্ধ Image source: commons.wikimedia.org by Soutekh67

যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা প্রস্রাবের বালতিতে দ্রবীভূত হয়েছিল। মিশরের প্যান্থিয়নের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দেব-দেবীদেরকে ডাকা হয়েছিল অ্যাপোফিসকে যুদ্ধে ধ্বংস করার জন্য। অনেক সময় শত্রুর চুল, নখ বা শরীরের কোনো তরল পদার্থ যুক্ত করে এই মূর্তিগুলো আরও কার্যকর করা হতো বলে মনে করা হয়।

রাজা ৩য় রামেসিসের বিরুদ্ধে এই ধরনের জাদু করা হয়েছিল। কিন্তু চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করা হয়। ষড়যন্ত্রকারীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

জাদুবিদ্যায় মৃতদের ভূমিকা

সমস্ত মিশরের মানুষ পরবর্তী জীবনে তাদের দেহ এবং আত্মা সংরক্ষণের জন্য হেকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতো। যারা সমাধিতে মৃতদেহ থেকে চুরি করতো, তাদের জন্য বিপজ্জনক প্রাণি পাঠানোর হুমকির অভিশাপ কখনও কখনও সমাধির দেয়ালে খোদাই করা হয়েছিল। 

মমিকৃত দেহ তাবিজ দ্বারা সুরক্ষিত থাকতো। অভিজাত ব্যক্তিদের সমাধিতে গুপ্ত জাদু জ্ঞান প্রদানের জন্য, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মন্ত্রের সংগ্রহ-যেমন ‘কফিন টেক্সটস’ এবং ‘বুক অফ দ্য ডেড’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। 

‘বুক অফ দ্য ডেড’-এ বর্ণিত মৃতদেহের শেষকৃত্যের যাত্রা Image source: wikipedia.org

মৃত ব্যক্তির আত্মাকে জাদুর মাধ্যমে দানব বা খারাপ শক্তিকে পরাস্ত করতে হবে। মৃতদের পরবর্তী জীবনের বিয়াল্লিশ জন বিচারকের মূল্যায়নে সাহায্য করার জন্য মন্ত্রও ছিল। একজন নির্দোষ মৃত ব্যক্তি ‘আখ’ (akh) বা ‘পরিবর্তিত’ আত্মায় পরিণত হয়। যাতে তাদের জীবিত আত্মীয়দের পক্ষে ব্যবহার করা যেতে পারে।

দেবতা হেকা (Heka) 

হেকা ছিল প্রাচীন মিশরে জাদু ও ওষুধের দেবতা। হেকা বা hk3w নামটি আসলে জাদুর জন্য মিশরের পুরানো শব্দ। তারা বিশ্বাস করতো যে এটি অতিপ্রাকৃত শক্তিকে বর্ণনা করে এবং মহাবিশ্বের সৃষ্টি করেছে।  হেকা বলতে ‘কা-এর ব্যবহার’ বোঝানো হয়। প্রাচীন মিশরে, কা বলতে ঐশ্বরিক আত্মাকে বোঝায় যা একজন ব্যক্তিকে রক্ষা করে। 

হেকা Image source: worldhistory.org

মিশরের পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, দেবতা হেকা দুটি সাপকে যুদ্ধে পরাস্ত করেছিলেন। সাপ দুইটি হেকার প্রতীকের অংশ হয়ে ওঠে।

শক্তি হিসাবে, হেকা মিশরের দেবতাদের পাশাপাশি পুরোহিত, জাদুকর এবং সাধারণ মানুষের কাছে উপলব্ধ ছিল এবং ভাল ও খারাপ উভয় ক্ষেত্রেই এটিকে আহ্বান করা যেতো। 

শেড (Shed) বা ত্রাণকর্তা

শেড সাধারণত একজন প্রতিরক্ষামূলক দেবতা ছিলেন যিনি অন্যদের অসুস্থতা এবং বিপদ থেকে রক্ষা করতেন।

তাকে প্রায়শই একজন রাজপুত্র বা শিশু হিসাবে চিত্রিত করা হয় যিনি প্রাচীন মিশরে সাপ, কুমির, বিচ্ছু এবং সিংহসহ অন্যান্য প্রাণি এবং কালো জাদু থেকে মানুষকে রক্ষা করেন। 

টুটু (Tutu)

টুটু ৬৬৪-৩৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ সময়ের একজন প্রতিরক্ষামূলক দেবতা। তাকে মুকুটযুক্ত স্ফিংক্স, কখনও ফ্যালকন, লেজের জন্য কোবরা এবং মানুষ বা কুমিরের মাথাসহ চিত্রিত করা হয়।  

দেবতা টুটু Image source: .wikipedia.org

স্ফিংস রাজত্ব এবং সূর্য দেবতার সাথে যুক্ত। এটি ট্যারোটের দশম কার্ড, যা জ্ঞান এবং আবেগময় জীবনের প্রতিনিধি হিসাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

টুটুর প্রাথমিক ভূমিকা ছিল রাতের বেলা মানুষকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করা।  

 

ওয়াডজেট (Wadjet) 

তিনি ছিলেন একজন বিদ্রোহী কোবরা দেবী যিনি সাপ এবং অন্যান্য বিপদ থেকে রক্ষা করতেন। তিনি তাপ এবং আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

তাকে প্রসবের সময় নারীদের রক্ষাকর্তা এবং শিশু দেবতা হোরাসের সেবিকা এবং রক্ষক হিসেবে দেখা হয়। ‘ওয়াডজেট-আই’ হোরাসের চোখ বা রা-এর চোখ নামেও পরিচিত। এটি সাধারণত তাবিজে ব্যবহার করা হত। 

ওয়াডজেট-আই’ হোরাসের চোখ Image source: https://en.wikipedia.org by Jeff Dahl

আইসিস (Isis)

আইসিস ছিল মিশরের প্রথম দিকের প্রধান এবং সবচেয়ে বিশিষ্ট দেবতাদের একজন। তার কর্তব্যের মধ্যে মৃতদের সাথে পরজীবনে যাওয়া এবং সাপের কামড় এবং বিচ্ছুর হুল থেকে রক্ষা করা অন্তর্ভুক্ত। 

বেস (Bes)

বেস এবং তার নারী প্রতিরূপ বেসেটের (Beset) জুটিবদ্ধ ভাবে রক্ষক দেবতা ছিলেন যারা পরিবারের জন্য সৌভাগ্য নিয়ে আসে। তাদের মা, শিশু এবং প্রসবের সুরক্ষার জন্যও বিশ্বাস করা হতো। তার প্রতীক হল উটপাখির পালক।  

দেবতা বেস-এর তাবিজ Image source: https://en.wikipedia.org

প্রাচীন মিশরের ইতিহাস এবং জীবনযাত্রার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে জাদুবিদ্যা। বর্তমান সময়ে তা অবিশ্বাস্য বা অযৌক্তিক লাগতে পারে।

কিন্তু, প্রতিটি জাতি এবং সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব বিশ্বাস ও আচারবিধি। প্রাচীন মিশর সম্পর্কে জানার উপাদানও এসব জাদুবিদ্যা এবং দেবতাদের গল্পেই লুকিয়ে আছে।

 

 

Feature Image: brewminate.com 
Reference: 

01. Ancient/Egyptians/Magic. 
02. Magic-Ancient-World-Egyptian-Deities.