১৯২৬ সালের ১৬ মে রাত। মহান অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান ষষ্ঠ মেহমেদ আকস্মিকভাবে মারা যান, ইতালির রিসোর্ট শহর সান রেমোতে। নির্বাসনের চতুর্থ বছর ঋণগ্রস্ত অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে। তার ঋণ এত বেশি ছিল যে স্থানীয় হিসাব নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত, ইতালি কর্তৃপক্ষ তার কফিন আটকে রাখে।
সুলতানের আত্মীয়রা শেষ পর্যন্ত তার মৃতদেহ সিরিয়ার মধ্য দামেস্কের একটি অটোমান মসজিদের মাটিতে সমাহিত করে। মেহমেদের চূড়ান্ত যাত্রায় তার সাথে ছিলেন জামাতা ওমর ফারুক। ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি চিন্তা করছিলেন সেসব রাজ্যের কথা, যেখানে তাদের পরিবার কয়েক শতাব্দী ধরে রাজত্ব করেছিল।
কারণ, এখন শুধু তাদের সাম্রাজ্যই বিলুপ্ত হয়নি, অটোমান নামটিও ছিল হারিয়ে যাওয়ার পথে। শক্তিশালী এই সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাসের পথ ধরে আজ আমাদের যাত্রা।
অটোমানদের উদ্ভব
মঙ্গোলদের দ্বারা বিতারিত হয়ে, যাযাবর তুর্কি উপজাতিরা অষ্টম এবং নবম শতাব্দীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। দশম শতাব্দীর মধ্যে, তুর্কি উপজাতিদের মধ্যে ‘সেলজুকরা’ (Seljuk) মুসলিম বিশ্বে একটি উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত হয়।
অন্যান্য অনেক তুর্কি গোষ্ঠী যাযাবর থেকে যায় এবং ‘গাজী ঐতিহ্য’ অনুসরণ করে ইসলামের জন্য ভূমি জয় এবং নিজেদের জন্য যুদ্ধের সামগ্রী অর্জনের চেষ্টা করছিল। দুই সম্প্রদায়ের সংঘাত শান্ত করতে, সেলজুকরা তাদের আনাতোলিয়ায় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পূর্ব দিকে পরিচালিত করে।
১০৭১ সালের পর উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়ায় স্থাপিত ছোট এমিরেটগুলোর একটি থেকে অটোমান গোত্রের উদ্ভব হয়। এই রাজবংশের নামকরণ করা হয়েছিল ওসমান গাজীর (১২৫৯-১৩২৬) নামে। উসমানীয় রাজবংশ বা উসমানীয় সাম্রাজ্য। তবে ইংরেজি বিকৃত বা পরিবর্তিত রূপ হয়ে উসমানীয় হয়ে যা অটোমান সাম্রাজ্য। পরবর্তীতে তিনি রাজধানী স্থানান্তরিত করে এশিয়া মাইনরে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে তার রাজ্য বিস্তার করতে শুরু করেন।
রাজ্য বিস্তার
তাদের সাম্রাজ্য বর্তমান তুরস্কে কেন্দ্রীভূত ছিল এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তুর্কিরা পরবর্তীতে আনাতোলিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে, যা বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
সুলতান মেহমেদ শহরের নাম ইস্তাম্বুল করেন এবং এটিকে অটোমান সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানী করেন। ইস্তাম্বুল বাণিজ্য ও সংস্কৃতির একটি প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
সাম্রাজ্যের উত্থান
১৫১৭ সালের মধ্যে বায়েজিদের পুত্র প্রথম সেলিম সিরিয়া, আরব, প্যালেস্টাইন এবং মিশরকে অটোমানদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। অটোমান সাম্রাজ্য ১৫২০-১৫৫৬ সালের মধ্যে সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের শাসনামলে শীর্ষে পৌঁছায়। এই সময় মহান শক্তি, স্থিতিশীলতা এবং সম্পদ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
অটোমান সাম্রাজ্যের পতন
১৬০০ এর দশক থেকে শুরু করে, অটোমেন সাম্রাজ্য ইউরোপের উপর তার অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য হারাতে শুরু করে। ১৮৭৮ সালে বার্লিনের কংগ্রেস; রোমানিয়া, সার্বিয়া এবং বুলগেরিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
১৯১২-১৩ সালে বলকান যুদ্ধের সময়, অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপের প্রায় সমস্ত অঞ্চল হারিয়ে ফেলে। ১৬৮৩ সালে, ভিয়েনার যুদ্ধে অটোমানরা পরাজিত হয়। পরের শত বছরে, তারা মূল অঞ্চলগুলো হারাতে শুরু করে। একটি বিদ্রোহের পর, গ্রিসও স্বাধীনতা লাভ করে
পতনের সময়
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে, অটোমান সাম্রাজ্য পতনের মধ্যে ছিল। অটোমান সেনাবাহিনী ১৯১৪ সালে কেন্দ্রীয় শক্তির (জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সহ) পক্ষে যুদ্ধ করে এবং ১৯১৮ সালের অক্টোবরে পরাজিত হয়। অটোমান সাম্রাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯২২ সালে শেষ হয়, যখন অটোমান সুলতানের উপাধি বাদ দেওয়া হয়।
সেনা কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক (১৮৮১-১৯৩৮) স্বাধীন তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তুরস্ককে ২৯ অক্টোবর, ১৯২৩-এ প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৯২৩-৩৮ সাল) তুরস্কের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
পতনের কারণ
আঞ্চলিক সম্প্রসারণ এবং সামরিক সাফল্য সত্ত্বেও, অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে সাংগঠনিক সমস্যা রয়ে গিয়েছিল। ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ হারানো, রেনেসাঁ এবং শিল্প বিপ্লবের সাথে পাল্লা দিতে না পারা, দুর্বল নেতৃত্ব এবং আমেরিকা ও ভারতের বাণিজ্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদি কারণে সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে।
প্রশাসনিক জটিলতা
দ্বিতীয় মুরাদ, বিশ্বস্ত প্রাক্তন ক্রীতদাস ও জনসাধারণকে প্রশাসনিক পদে উন্নীত করে অভিজাত ও গাজীদের প্রভাব সীমিত করার চেষ্টা করেছিলেন। ফলস্বরূপ, দ্বিতীয় মুরাদ এবং পরবর্তী সুলতানরা একটি দলকে অন্য দলের বিরুদ্ধে ব্যবহারে সক্ষম হয়েছিল।জেনেসারি অর্থাৎ তাদের বিশেষ সৈন্যদের ক্ষমতা প্রায়ই একজন দুর্বল সুলতানকে ছাড়িয়ে যেত। ফলে, রাজ্য পরিচালনা এবং সুলতানের শাসনে এর প্রভাব পড়তো।
উত্তরাধিকারজনিত জটিলতা
আরেকটি দুর্বলতা ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে। একজন মৃত সুলতানের কাছ থেকে তার পুত্রের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক হতো। যদি একজন সুলতান একজন পুরুষ উত্তরাধিকারী ছাড়াই মারা যান বা যদি তিনি বেশ কয়েকটি পুত্র রেখে যান, তবে নির্মমভাবে তাদের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো।
প্রারম্ভিক সময়ে, চলমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা রোধ করার জন্য, নতুন মুকুটধারী সুলতানের সমস্ত পুরুষ আত্মীয়কে হত্যা করা হয়েছিল। পরে অবশ্য সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিছক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন যে কারাবাসের এই নীতি অটোমান সাম্রাজ্যের পতনে অবদান রেখেছিল। কারণ মানসিকভাবে অস্থির এবং রাজনৈতিকভাবে অনভিজ্ঞ সুলতানদের কারাগার থেকে উদ্ধার করে সিংহাসনে বসানো হয়েছিল।
কৃষিপ্রধান অর্থনীতি
১৭০০ এবং ১৮০০ এর দশকে যখন ইউরোপে শিল্প বিপ্লব হয়, তখনও অটোমান অর্থনীতি কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য সাম্রাজ্যে কারখানা ও মিলের অভাব ছিল। এটি যে কৃষি উদ্বৃত্ত তৈরি করেছিল তা ইউরোপের ঋণ পরিশোধ করতে চলে গিয়েছিল। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করার সময়, অটোমান সাম্রাজ্যের প্রয়োজনীয় রেলপথ, অস্ত্র, এবং লোহা ও ইস্পাত তৈরি করার মতো শিল্প শক্তি ছিল না।
সমন্বয়ের অভাব
বুলগেরিয়া, মিশর, গ্রিস, হাঙ্গেরি, জর্ডান, লেবানন, ইসরাইল, ফিলিস্তিনি, মেসিডোনিয়া, রোমানিয়া, সিরিয়া, আরবের কিছু অংশ এবং আফ্রিকার উত্তর উপকূল অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর বৈচিত্র্যময় জাতিসত্তা, ভাষা, অর্থনীতি এবং ভূগোলের মাঝে সমন্বয় এবং সঠিক নেতৃত্বের অভাব তাদের মাঝে বিদ্রোহ তৈরি করে।
রাশিয়ার সাথে ধ্বংসাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বিতা
প্রতিবেশী রাশিয়া, যার বিস্তৃত রাজ্যে মুসলমানরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল, ক্রমবর্ধমান তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল অটোমানদের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও তারা বিপরীত পক্ষ নিয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভুল দিক বেছে নেওয়া
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পাশে থাকা অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ বলে মনে করা হয়। পরবর্তীতে ১৯১৫ এবং ১৯১৬ সালে মিত্রবাহিনীর আক্রমণ থেকে ইস্তাম্বুলকে রক্ষা করার জন্য তারা গ্যালিপোলি উপদ্বীপে একটি নৃশংস, রক্তাক্ত অভিযান পরিচালনা করে। এতে প্রায় অর্ধ মিলিয়ন সৈন্যকে তারা হারায়, যাদের অধিকাংশই রোগে আক্রান্ত হয়। ১৯১৮ সালের অক্টোবরে, তারা গ্রেট ব্রিটেনের সাথে একটি যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর করে।
‘তরুণ তুর্কিদের’ উত্থান
১৯ শতকের শেষের দিকে, একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র এবং একটি নির্বাচিত সংসদ নিয়ে অটোমানরা পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করে। ১৮৭৮ সালে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ভেঙে ৩০ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের সূচনার মধ্য দিয়ে এটি শেষ হয়।
এর বিরোধী দল ‘কমিটি অফ ইউনিয়ন অ্যান্ড প্রোগ্রেস পার্টি (সিইউপি)’, যা ‘তরুণ তুর্কি’ নামেও পরিচিত। তারা সংবিধান পুনরুদ্ধার, রাজতন্ত্র সীমিত এবং সাম্রাজ্যের মহিমা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
১৯০৮ সালের বিপ্লবে তাদের বিজয় স্বাধীনতা, সাম্য এবং অটোমান ভ্রাতৃত্বের বিজয় হিসাবে ব্যাপকভাবে উদযাপন করা হয়।
কিন্তু দলগুলো বিভক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে বিপ্লব দ্রুত ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় এবং প্রবল জাতীয়তাবাদীরা একত্র হয়ে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনে পরিণত হয়।
এই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সাথে মিলে যায় ১৯১২ সালের প্রথম বলকান যুদ্ধ, যেখানে অটোমানরা আলবেনিয়া এবং মেসিডোনিয়ায় তাদের অবশিষ্ট ইউরোপের অঞ্চল হারিয়েছিল। এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, সামরিকভাবে দুর্বল অটোমানরা জার্মানির সাথে যোগ দেয় তিক্ত শত্রু রাশিয়া থেকে নিজেদের রক্ষার আশায়।
আর্মেনিয়ান গণহত্যা
আর্মেনিয়ান গণহত্যা সম্ভবত অটোমানদের জন্য সবচেয়ে বিতর্কিত এবং জঘন্য ঘটনা ছিল। ২৪ এপ্রিল, ১৯১৫ সালে গুরুত্বপূর্ণ আর্মেনিয়ান রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার করা হয়। এই দিনটি ‘রেড সানডে’ নামে পরিচিত।
বেশিরভাগ গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে, প্রায় ১.৫ মিলিয়ন আর্মেনিয়ান নিহত হয় এই সময়। বছরের পর বছর ধরে তুর্কি সরকার গণহত্যার দায় অস্বীকার করে আসছে। এমনকি তুরস্কে আর্মেনিয়ান গণহত্যা সম্পর্কে কথা বলা আজও বেআইনি।
৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শাসন করার পর, অটোমান তুর্কিরা প্রায়শই তাদের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, জাতিগত বৈচিত্র্য, শিল্প, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং স্থাপত্যের বিস্ময়ের জন্য স্মরণ করা হয়। বর্তমান তুর্কি প্রজাতন্ত্রে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের প্রভাব এখনও অনেক বেশি।
আধুনিক এবং অনেকাংশে ধর্মনিরপেক্ষ এই জাতিকে অনেক পণ্ডিত অটোমান সাম্রাজ্যের ধারাবাহিকতা বলে মনে করেন। কিন্তু, কিছু ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত, এবং ক্ষমতার লোভে করা প্রতিনিয়ত অন্যায় একসময়ের বিশাল সাম্রাজ্যের পতনের ঘটিয়েছে।
Feature Photo: www.sporcle.com Reference: 01. Fall End Ottoman Empire. 02. Ottoman. 03. Ottoman Empire. 04. Ottoman Empire Fall. 05. Ottoman Empire.