ইন্টেল কর্পোরেশন: কম্পিউটার প্রসেসরে রাজত্ব যাদের

370
0

ইন্টেল, কথাটি বললেই কারো মাথায় প্রথমেই আসে কম্পিউটার প্রসেসরের কথা, কারো মাথায় আসবে মেমোরি ও স্টোরেজের কথা; আবার হয়তো কারো মনে পড়বে চিপসেটের কথা। যাইহোক, কোম্পানির পুরো নাম ইন্টেল কর্পোরেশন। ইন্টেল শব্দটির আধিভানিক রূপ হচ্ছে ইন্টিগ্রেটেড ইলেকট্রনিকস। 

ইন্টেল কর্পোরেশন একটি আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ও প্রযুক্তিগত কোম্পানি। গোটা বিশ্বে কম্পিউটার সেমিকন্ডাক্টার সার্কিট তৈরির মাধ্যমে রাজত্ব করে ইন্টেল কর্পোরেশন। সহজ কথায় বলতে গেলে, ইন্টেল কর্পোরেশন কম্পিউটারের বিভিন্ন উপাদান ও এই সম্পর্কীয় বিভিন্ন প্রোডাক্ট তৈরি, ডিজাইন, ম্যানুফ্যাকচার ও বিক্রি করার একটি জনপ্রিয় কোম্পানি।

এই কোম্পানির এত জনপ্রিয়তার অন্যতম কারন হলো ইন্টেল সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি মানসম্মত হিসেবে পরিচিত। তাদের প্রসেসর বিভিন্ন ল্যাপটপ ব্র্যান্ডে ব্যবহারযোগ্য। আজকে আমরা জানবো ইন্টেল কর্পোরেশন কোম্পানি সম্পর্কে।

ইতিহাস 

গল্পটা শুরু হয় ১৯৬৮ সালের ১৮ জুলাই। ফেয়ারচাইল্ড সেমিকন্ডাকটারের একদল সেমিকন্ডাক্টার ইঞ্জিনিয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা সবাই মিলে একটি কম্পিউটার সেমিকন্ডাক্টার কোম্পানি চালু করবে। দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রবার্ট নয়েস ও গর্ডন মুর। নয়েস ও মুর সিলিকন ভ্যালির নামকরা দুই উদ্ভাবক ছিলেন।  

Intel.Image source: lemp.io

১৯৫৭ সালে ফেয়ারচাইল্ড সেমিকন্ডাকটার নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইন্টিগ্রেটেড ইলেকট্রনিকস কে ছোট করে কোম্পানির নাম ঠিক করা হয় ইন্টেল কর্পোরেশন। ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন ভিউয়ে এই কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়। 

ইন্টেলের শুরুর দিকের প্রোডাক্ট হলো স্ট্যাটিক র‍্যানডম একসেস মেমোরি ও ডাইনামিক র‍্যানডম একসেস মেমোরি চিপস। ১৯৭১ সালে এটি তাদের প্রথম প্রসেসর বাজারে ছাড়ে। আজকেও এই কোম্পানি এত জনপ্রিয় হওয়ার কারন তাদের এই প্রসেসর। 

১৯৬৮-১৯৬৯

প্রাথমিক সেমিকন্ডাকটর চিপ তৈরি: 

সাশ্রয়ী ও বাস্তবিক সেমিকন্ডাকটর তৈরির মাধ্যমে এই কোম্পানি তার যাত্রা শুরু করে। উদ্যোগী পুঁজিবাদীদের সাহায্য এই কোম্পনি প্রথম দুইদিনের মধ্যে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করে। ১৯৬৯ সালে ইন্টেল দুনিয়ার প্রথম মাইক্রোপ্রসেসর তৈরি করে। জাপানিজ এক কোম্পানি বুসিকম নামের এক কোম্পানিকে প্রসেসর সরবরাহ করা তাদের অনেক বড় সাফল্যসমূহের একটি ছিলো। 

১৯৯০-১৯৯৭

প্রত্যক ঘরে ঘরে ইন্টেলের নাম ছড়িয়ে পড়লো: 

আশির দশকের শেষের আগে পর্যন্ত ব্যাক্তিগত কম্পিউটারের মার্কেট অনেক ছোট ছিলো। কিন্তু ৯০ দশকের শুরু থেকেই গেমিং বা অনান্য কাজের জন্য পিসি কেনাবেচা বাড়তে থাকে। মার্কেট আস্তে আস্তে অনেক বড় হয়ে যায়। সুযোগ বুঝে ইন্টেল কোম্পানি শুরু করে “ইন্টেল ইনসাইড” নামের এক অভিযান। ফলে নতুন কম্পিউটারের প্রসেসর মানেই ইন্টেল প্রসেসর। এভাবে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে ইন্টেলের নাম-ডাক। 

ইন্টেল ইনসাইডের লোগো। Image Source: 1000logos.net

২০০৫-বর্তমান

ইন্টেল কম্পিউটার প্রসেসরের বাজারের রাজত্ব করতে থাকে এবং শাখা-প্রশাখা বৃদ্ধি করে:

৯০-এর দশকেই ইন্টেল প্রসেসরের পাশাপাশি মাদারবোর্ড (গ্রাফিক্স কার্ড ও চিপস) বানানো শুরু করেছিল। তখন থেকেই কম্পিউটারে অ্যাপলের পাশাপাশি ইন্টেল ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ২০০৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অ্যাপেলও ইন্টেল প্রসেসর ব্যবহার চালিয়ে যায়। ২০০৬ সালে ইন্টেলের আই-কোর সিরিজের প্রসেসর বাজারে আসে যা উচ্চ কর্মক্ষমতা ও গেমিং পিসির দরজা খুলে দেয়। এর পাশাপাশি ২০১৭ সাল থেকে কোম্পানিটি স্বয়ংক্রিয় গাড়ি নির্মাণ শুরু করে। 

ইন্টেলের উল্লেখযোগ্য কিছু সাল ও অর্জনসমূহ: 

  • ১৯৬৮— রবার্ট নয়েস ও গর্ডন মুরের হাত ধরে কোম্পানির যাত্রা শুরু;
  • ১৯৬৯— প্রথম প্রোডাক্ট(৩১০১ স্কটকি র‍্যানডম একসেস মেমোরি) তৈরি ও প্রথম বিক্রি;
  • ১৯৭১— বিশ্বের প্রথম ইলেকট্রনিক মাইক্রোপ্রসেসর(ইন্টেল ৪০০৪) তৈরি;
  • ১৯৭৪— এক ক্লাসিক চালু: দ্যা ৮০৮০;
  • ১৯৭৮— এক দশক পূর্তি উপলক্ষে ৮০৮৬ প্রসেসর বাজারে ছাড়া;
  • ১৯৮৫— ডাইনামিক র‍্যাম ব্যবসা থেকে সরে আসা;
  • ১৯৮৬— প্রথমবারের মতো ‘কর্পোরেট ইনোভেটিভ রেকগনিশন’ অ্যাওয়ার্ড অর্জন;
  • ১৯৮৮— ২০ বছর পূর্তি;
  • ১৯৮৯— তিনটি প্রসেসর (৮৬০, ৪৮৬ ও ৯৬০) চালু করার মাধ্যমে একটি রেকর্ড ভাঙার বছর;
  • ২০০১— ইতিহাসের সবচেয়ে ছোট ট্রানজিস্টার তৈরি;
  • ২০০২— সহ-প্রতিষ্ঠতা গর্ডন মুর ‘দ্য প্রেসেন্ডিসিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ সম্মান অর্জন;
  • ২০০৫— অ্যাপেল ইন্টেলের প্রসেসর ব্যবহার শুরু করে;
  • ২০০৬— কোর-আই প্রসেসর সিরিজ চালু;
  • ২০১৮— সফলতার সাথে ইন্টেলের ৫০ বছরের পথচলা সম্পন্ন;

সদর দপ্তর

ইন্টেল কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করা হয় আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন ভিউয়ে। তবে সময়ের সাথে কোম্পানির প্রসার ও অগ্রগতি ঘটতে থাকে। ফলে প্রয়োজন পড়ে আরো উন্নত ও বড় সদর দপ্তরের। ২০১৭ সালে ইন্টেলের সদর দপ্তর হয় ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা ক্লারাতে। পরিষ্কার-পরিছন্নতা, কর্মচারীদের কাজের পরিবেশের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয় ইন্টেল সদর দপ্তর। কোম্পানিটির সদর দপ্তরকে ইন্টেল সিটি নামে ডাকা হয়। 

ইন্টেল কর্পোরেশনের কর্পোরেট হেডকোয়ার্টার্স। Image Source: corporateheadquarters.com

সদর দপ্তর তৈরি করার জন্য ১৯৭০ সালে ২৬ একরের এ জায়গাটি কিনে নেয় ইন্টেল। প্রায় ১৩,৫০০ কর্মী এই সদর দপ্তরে কাজ করে। সদর দপ্তরের ভেতরে কাজ করার জন্য আছে কর্মীদের ডেস্ক, চিপস তৈরির ফ্যাক্টরি, ক্যান্টিন, দাবা খেলার বোর্ড এবং ইন্টেলের বিভিন্ন প্রোডাক্ট ও তথ্য দিয়ে সাজানো একটি প্রযুক্তি জাদুঘর। একটি মজার তথ্য হলো ইন্টেল সিটির গেটের বাইরে ইন্টেলের লোগোর সামনে ক্যামেরার চিহ্ন এর মাধ্যমে ছবি তোলার স্থান নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। 

লোগো

ইন্টেলের জীবনকালে তিনটি লোগো ব্যবহৃত হয়েছে। 

১৯৬৮-২০০৫— ‘ড্রপড-ই’ লোগো

ড্রপড-ই লোগো। Image Source: 1000logos.net

প্রথম লোগো তৈরি করেন কোম্পানির দুই সহ-প্রতিষ্ঠতা রবার্ট নয়েস ও গর্ডন মুর। ১৯৬৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই লোগো ব্যবহৃত হতো। এই লোগোর নাম ছিল ‘ড্রপড-ই’। এমনটি ডাকার কারN ইন্টেল শব্দের ‘e’ অক্ষরটি ‘l’ ও ‘t’ এর থেকে নিচে লেখা ছিল। 

লোগোটিতে নীল রঙের সাধারন ‘sans-serif’ ফন্ট ব্যবহার করা হয়েছিল। এছাড়া ৯০ এর দশকে ইন্টেল ইনসাইড লোগো তৈরি করা হয়েছিল যা ছিল একটি মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি।

২০০৫-২০২০— ‘swoosh’ লোগো

Swoosh logo. Image source: 1000logos.net

২০০৫ সালে পুরাতন লোগো বদলে ফেলে ইন্টেল নতুন লোগো তৈরি করে। লোগোটিতে ‘e’ অক্ষরটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। এই লোগোটি কোম্পানির নতুন স্লোগান ‘Leap Ahead(এগিয়ে যান) কে তুলে ধরে। ‘intel’ শব্দের চারপাশে একটি ‘swoosh’ (বাতাসের শ শ আওয়াজ) ব্যবহার করা হয়।

২০২০-বর্তমান— নতুন সাধারন লোগো 

২০২০ সালে ইন্টেল একদম সরল ও সাধারন লোগো ব্যবহার শুরু করে। ‘i’ ও ‘l’ অক্ষরের কোনাকার আকৃতি সরিয়ে দেওয়া হয় এবং ‘n’ ও ‘e’ কে সোজা করে লিখা হয়। এই নতুন লোগো ‘ঐতিহ্যগত এবং নির্ভরযোগ্যতা’ প্রকাশ করে। 

নতুন লোগো। Image Source: 1000logos.net

স্লোগান

ইন্টেলের কিছু জনপ্রিয় স্লোগান

  • Go off and do something wonderful. অর্থাৎ, বেরিয়ে পড়ো আর চমৎকার কিছু করে দেখাও।
  • Reimagining Intel in the world. অর্থাৎ, বিশ্বে ইন্টেলকে নতুন করে কল্পনা করুন।
  • Do something that honors the past to forge the future. অর্থাৎ, এমন কিছু করুন যা ভবিষ্যত গঠনের জন্য অতীতকে সম্মান করে।
  • Do something small that leads to something big. অর্থাৎ, ছোট কিছু করুন যা বড় কিছুর দিকে নিয়ে যায়।
  • Do something that connects us all. অর্থাৎ, এমন কিছু করুন যা আমাদের সবাইকে সংযুক্ত করে।

জনপ্রিয় কিছু প্রোডাক্ট

ইন্টেল ৪০০৪

Intel-4004. Image Source: www.intel.com

ইন্টেল ৪০০৪ ছিল কোম্পানিটির তৈরি করা প্রথম মাইক্রোপ্রসেসর। এই মাইক্রোপ্রসেসরটি ভবিষ্যত মাইক্রোপ্রসেসর মডেলের অগ্রদূত হিসেবে কাজ করে। যা আধুনিক কম্পিউটারের মেরুদন্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। 

পেন্টিয়াম প্রসেসর

আশির দশকে প্রায় প্রতিটা কম্পিউটারেই পেন্টিয়াম প্রসেসর ব্যবহার করা হতো। অনেক ইউজার কম্পিউটার থেকে সরে ল্যাপটপ ব্যবহার শুরু করে কিন্তু তখনও এই প্রসেসর জনপ্রিয় ছিল। জিপিইউসহ বিভিন্ন নতুন ভার্সন এর ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছে। 

কোর প্রসেসর

ডেস্কটপ এবং ল্যাপটপ কম্পিউটারের জন্য ইন্টেলের শীর্ষ পণ্য হল এর CPU লাইন। প্রাথমিক পণ্যসমূহ কোর ব্র্যান্ড নামে বিক্রি করা হয়, সর্বাধুনিক কোর i9 প্রসেসরের নতুন প্রজন্মের ১২ কোর পর্যন্ত থাকে। নিম্নমানের প্রসেসর সেলেরন এবং পেন্টিয়াম ব্র্যান্ড নামে বিক্রি হয়, কিছু সেলেরনের একক- এবং ডুয়াল-কোর সংস্করণ রয়েছে। 

সাপোর্টিং পিসি চিপসেট

২০০৭ সালে, ইন্টেল দূরবর্তী আইটি ব্যবস্থাপনা এবং সহায়তার জন্য তার vPro ব্র্যান্ড চালু করে। এটি ল্যাপটপ এবং ডেস্কটপ কম্পিউটারের জন্য প্রতিটি ইন্টেল মাদারবোর্ডে পাওয়া যায়। 

vPro বিজনেস টেকনোলজি আইটি সমস্যায় থাকা বিভাগগুলোতে শারীরিকভাবে হার্ডওয়্যারে না গিয়ে একাধিক পিসি নিরীক্ষণ, আপডেট এবং সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম করে। আইটি পেশাদাররা দূরবর্তী স্থান অন্য অফিসের একটি ল্যাপটপের সমস্যা সমাধান করতে পারে। 

জেনন প্রসেসর 

জেনন প্রসেসর অনেকটা কোর প্রসেসরের মতোই কিন্তু এটি আরো বেশি নির্ভরযোগ্যতা, মাপযোগ্যতা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে। ইন্টেলের ৪ ধরনের জেনন প্রসেসর আছে।

  • জেনন-ডি: ছোট সিস্টেমের জন্য। যার ক্ষমতা ও জায়গা অনেক।
  • জেনন-ই: ব্যবসায়িক কাজের জন্য।
  • জেনন-ডব্লিউ: সৃজনশীল পেশাদারদের জন্য।
  • জেনন-স্কেলেবল: বড় সিস্টেমের জন্য।

ইন্টেল বর্তমান কম্পিউটার প্রসেসর দুনিয়ার এক রাজা। ইন্টেলের প্রোডাক্ট ছাড়া একটা কম্পিউটার কল্পনা করা অসম্ভব। 

 

Feature Image: intel corporation 
References: 

01. Intel History. 
02. Intel. 
03. Intel.