ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা

370
0
Source: History.com

ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘলদের পরাজয় করা দুস্কর এক বিষয় ছিল। আফগান, মারাঠা এবং রাজপুতসহ অনেকেই চেষ্টা করেও তাদের হঠাতে সফল হতে পারে নি। ভারতের উক্ত অঞ্চলে মুঘল সাম্রাজ্য যেন সেখানকার রাজনৈতিক এবং আর্থ সামাজিক অবস্থার প্রতীক বহন করছিল।

তবে সতের শতকে সুদূর ইউরোপ থেকে আগত ব্রিটিশরা আস্তে আস্তে মুঘলদের জায়গা দখল করে নিতে শুরু করে। দুইশত বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশকে শাসন করা ব্রিটিশরা কিন্ত সরাসরি তাদের সরকারি নীতির মাধ্যমে এই অঞ্চল দখল করেনি বরং এর পিছনে ছিল একটি বেসরকারী কোম্পানি যার নাম ‘ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’।

কিভাবে এই কোম্পানি তাদের রাজত্বকে অর্থনীতি থেকে রাজনীতিতে বিস্তার করলো? আলোচনা হবে এই বিষয়ে।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার মানচিত্র। Image Source: wikimedia.commons

ষোড়শ শতাব্দীতে কিছু ইংরেজ বণিক জয়েন্ট স্টক কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত করেন যা নাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। প্রতিষ্ঠার পরই তারা রাণী প্রথম এলিজাবেথ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়াতে ব্যবসা করার জন্য রয়াল চার্টার বা রাজকীয় সনদ প্রাপ্ত হন। মূলত তারা ২১ বছরের জন্য ভারতে একচেটিয়া ব্যবসা করার অনুমতি পান।

প্রথম দিকে কোম্পানির সদস্য ক্যাপ্টেন হউকিনস এবং থমাস রো তৎকালীন মুঘল সাম্রাজ্যের সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে ব্যবসা করার অনুমতি চান। তারা তাকে বুঝাতে চান যে ব্রিটিশদের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলে মুঘলরা অনেক উপকৃত হবে।

উল্লেখ্য, ব্রিটিশদের পূর্বে এই অঞ্চলে পর্তুগীজ, ডাচ এবং ফ্রেঞ্চরা আধিপত্য বিস্তার করেছে। তাই জানা যায়, পর্তুগীজদের আপত্তির কারণে জাহাঙ্গীর ব্রিটিশদের সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।

400 years of India and Britain: Why Sir Thomas Roe's meeting with Jahangir in India is important
স্যার থমার রো’র সাথে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আলোচনার একটি অঙ্কন Source: Scroll.in

তবে ব্রিটিশরা তাদের লক্ষ্যে অটুট ছিল। তারা ক্রমাগত জাহাঙ্গীরকে প্রস্তাব দিতে থাকে। ফলস্বরুপ, মুঘল সাম্রাজ্যের ব্যবসা এবং প্রচুর কর আদায় হওয়ার কথা চিন্তা করে জাহাঙ্গীর তাদেরকে কারখানা তৈরি করে ব্যবসার অনুমতি প্রদান করে এবং তাদেরকে বার্ষিক অর্থ প্রদানের শর্ত দেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অনুমতি পাওয়ার সাথে সাথেই তাদের কার্যক্রম শুরু করে দেয়। ভারতের সুরাট, মাদ্রাস, মুম্বাই, কোলকাতা এবং পাটনাতে তারা শিল্প কারখানা তৈরি করে।

কারখানা তৈরির দরুণ উক্ত এলাকাগুলোর চিত্র পরিবর্তন হতে শুরু করে। ফলে ভারতের অন্যান্য শহরের ব্যবসায়ীরা এসব অঞ্চলে আসতে শুরু করে। এসব পরিবর্তন দেখে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও তাদের নীতি পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হয়। ক্রমেই তাদের চাহিদা ও লক্ষ্য বৃদ্ধি পেতে থাকে।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ার সময়কার বাণিজ্য এলাকা। Image Source: pinterest.com

ব্যবসা করার লক্ষ্যে ভারতে আসলেও পরবর্তীতে তারা মনে করে যে, এই ব্যবসাকে আরো মজবুত করতে লাগবে রাজনৈতিক শক্তি। এতে করে বাণিজ্য করা আরো সহজ হয়ে পড়তে থাকে।

তাই ১৬৮৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির নিজস্ব বাহিনী অওরঙ্গজেবের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তবে এই যুদ্ধে ব্রিটিশরা খুব খারাপভাবে পরাজিত হয়।

এই হারের পর তারা বুঝতে পারে যে, মুঘল সাম্রাজ্যকে সরাসরি আঘাত করলে তেমন একটা লাভ হবে না। ফলস্বরুপ তারা মানুষকে প্ররোচিত করা, ঘুষ দেওয়া, এবং ভেদ ও শাসন নীতি স্থাপন করতে শুরু করে।

Aurangzeb did the fate of the British that he could not muster the courage to confront him again.
অওরঙ্গজেব Source: NEWS NCR

যুদ্ধের পরপরই তারা অওরঙ্গজেবের কাছে মাফ চায়। অওরঙ্গজেব মূলত তার অঞ্চলের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে তাদেরকে জরিমানা করে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। আর এই ক্ষমা ইংরেজ কোম্পানিকে এক নতুন জীবন দেয়। অওরঙ্গজেবের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উপমহাদেশে ক্ষমতা নিয়ে তেমন দ্বন্দ্ব ছিল না।

তবে তার মৃত্যুর পরই অনেক অযোগ্য কিংবা ব্যর্থ সম্রাট ক্ষমতা নেয় যাদের জন্য মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হতে শুরু করে। এসব সম্রাটদের মধ্যে মুহাম্মাদ আজম শাহ, জাহান্দার শাহ, ফারুক সিয়ার অন্যতম।

অর্থাৎ দেখা যায় যে, মুঘলদের নিজ ভুলে পরিস্থিতি বেগতিক হতে শুরু করে। এতে করে অর্থনৈতিক অবস্থা ও আর্থ সামাজিক অবস্থাও বিপন্ন হতে দেখা যায়। এরই জের ধরে ফারুক সিয়ার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বিশেষ সুযোগের ঘোষণা দেয়। তিনি বলেন , একটি বার্ষিক চাঁদার বিনিময়ে ব্রিটিশদের এই কোম্পানিটি ট্যাক্স ফ্রি বাণিজ্য করতে পারবে।

The Mughal tax break that cost India its freedom | IndiaFactsIndiaFacts
ট্যাক্স ফ্রি করার পর ব্রিটিশদের শাসক হতে দেওয়ার এক অনুকল্প Source: IndiaFacts

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এর সুযোগ নেওয়া শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়াতে বাংলার নবাবরা ব্রিটিশদের এই সুযোগ দিতে আপত্তি জানায়। বেসামাল এই অবস্থার মধ্যেই পার্সিয়ান রাজা নাদির শাহ দিল্লী আক্রমণ করে বসেন। হঠাৎ এই আক্রমণের জন্য দিল্লী কখনোই প্রস্তুত ছিল না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, একে তো রাজনৈতিক সমস্যা অপরদিকে সার্বভৌমত্বের ব্যাপারটিও তখন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। জানা যায়, পার্সিয়ান আর্মি দিল্লী থেকে অনেক সম্পদ লুট করতে সক্ষম হয়। এই অবস্থায় মুঘলদের পরিচিতি সঙ্কটের মুখে পড়ে।

Remembering the Dead Delhi locals in the Hands of Nadir Shah on 22nd March, 1739 - Kreately
দিল্লীতে নাদির শাহ’র আক্রমণ Source: Kreatley

সর্ব দিক বিবেচনায় বলা যায় যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক দখলদারিত্বের লক্ষ্য পূর্ণ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল। তবে ইংরেজরা উপলব্ধি করে যে মুঘলদের রাজনৈতিক একত্বকে ভেদ করা তখনও সম্ভব নয়।

তাই তারা বাংলার দিকে নজর দেয়। নবাব সিরাজদ্দৌলাকে সরাসরি আক্রমণ করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। এজন্য সেনাপতি মীর জাফর ও জগৎশেঠকে তাদের দলে ভিড়িয়ে খুব সহজেই ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জিতে যায় এবং মীর জাফরকে তাদের পুতুল নবাব বানায়।

নবাব সিরাজউদ্দৌলা: যাঁর নির্মম হত্যার পর ভারতে ইংরেজদের একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয় - BBC News বাংলা
নবাব সিরাজউদ্দৌলা Source: BBC

আগেই বলেছি তখনকার সময়ে মুঘলদের অবস্থাও ভালো ছিল না। এরই প্রেক্ষিতে মারাঠারা সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে নিরাপত্তা দিবে বলে চুক্তি করে। তাই দিল্লীতে আক্রমণ করা মানেই ছিল মারাঠাদের উস্কানি দেওয়া।

পূর্বের মতো ঠিক একইভাবে পার্সিয়ান সম্রাট আবদাই মুঘলদের আক্রমণ করে। একে পানিপথের যুদ্ধও বলা হয় যেখানে মারাঠারা হেরে যায়।

The Third Battle of Panipat changed the power equation in India: Here's how - India Today
পানিপথের যুদ্ধ যা ভারতকে পরিবর্তন করে দেয় Source: India Today

তবে দিল্লীকে সম্পূর্ণভাবে শাসন করার ক্ষমতা আবদাইয়েরও ছিল না। তাই এই অঞ্চলের শাসক কে হবে তা বলাই যাচ্ছিল না। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই শূন্যস্থানের সুযোগ নেয়।

তারা ১৭৬৪ তে মীর কাশেম ও দ্বিতীয় শাহ আলমের সমন্বিত বাহিনীকে পরাজিত করে দেয়। এই যুদ্ধের মাধ্যমে আলাহাবাদ চুক্তির মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিহার, উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে।

August 12, 1765: The Treaty of Allahabad is signed | Knappily
আলাহাবাদ চুক্তি Source; Knappily

আস্তে আস্তে শুরু হয় বেসরকারী এই প্রতিষ্ঠানের বিস্তার লাভ হওয়া। পানিপথের যুদ্ধের পর মারাঠারা ব্রিটিশদের আক্রমণের চেষ্টা করে। তবে এবারও তারা ব্যর্থ হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মারাঠাদের মধ্যেও ভেদ নীতি প্রয়োগ করে।

তারা এই অঞ্চলের শাসকদের মধ্যে দ্বিমত সৃষ্টি করতে শুরু করে। ফলস্বরুপ, সিন্দিয়া ও ভোসলে ইস্ট ইন্ডিয়ার অন্যতম পরিচালক লর্ড ওয়েলেসের জোটভুক্ত হয়। এছাড়াও হায়াদ্রাবাদের নিজাম আলি খানকেও ঘুষ দিয়ে দমন করা হয়।

বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মূলত একটি ত্রি-পক্ষীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করতো।

তারা ভারতের মূল্যবান সম্পদের সাথে মেটালের বিনিময় করে উক্ত পণ্যকে ইস্ট ইন্দিজ অঞ্চলে মসলার বিনিময়ে বিক্রি করতো।

তারপর ঐ মসলাগুলোকে লন্ডনে পাঠানো হতো। এছাড়াও লবণ, চা আর চীনের আফিমও লন্ডনে পরিবহন করতো। পরিবহনকারী জাহাজগুলো অস্ত্র দ্বারা সজ্জিত থাকতো। এছাড়াও ব্রিটিশ রয়েল নেভিও তাদেরকে সুরক্ষা দিতো।

East India Company Fort, Bombay
ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির দুর্গ Source: worldhistory

প্রশ্ন উঠে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিভাবে উক্ত কাজ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করতে সক্ষম হলো?

এর উত্তরে অনেকে বলেন যে, ওয়ারেন হেস্টিংস এর অরিয়েন্টিয়ালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি এবং তারা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রচলিত কিছু ব্যবস্থার পরিবর্তন করেন।

কৃষকদের অনেক অত্যাচার করলেও তারা রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে কৃষক শ্রেণির একটি পরিচিতি স্থাপন করেন। এছাড়াও বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং তার আইনও ছিল অন্যরকম। অর্থাৎ এটাকে “A state within a state” বলা যেতে পারে।

Government of India Act 1858: An Act for the Better Government of India
রানীর রয়েল ফরমানের মাধ্যমে ইন্ডিয়ান এক্ট ঘোষণা Source: Justicemirror.com

১৮৫৭ সালে মুঘলদের অস্তিত্ব পুরোপুরী বিলীন হওয়ার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবসান ঘটে এবং ব্রিটিশ সরকার উপমহাদেশে গভমেন্ট অফ ইন্ডিয়ান এক্টের মাধ্যমে তাদের শাসন শুরু করে।

বলা যেতে পারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মূল উৎসই ছিল গুটি কয়েক বণিকের হাতে তৈরি সেই কোম্পানি যা ইংরেজদের নৃশংসতার পাশাপাশি তৎকালীন ভারতীয় শাসকদের স্বার্থপরতা ও বিচক্ষণহীনতার কথা মনে করিয়ে দেয়। অপরপক্ষে ১৯ শতকের রাজনীতিতে ভেদ ও শাসন নীতিরও প্রচলন ঘটে।

 

Feature Image: History.com
References: 

01. East India Company. 
02. english-east-india-company.  
03. How the East India Company Became the World's Most Powerful Monopoly.  
04. The East India Company.