ফিজি একটি চমৎকার সাজানো-গোছানো দেশ। এটি মূলত একটি দ্বীপ রাষ্ট্র যার চারপাশে রয়েছে সাগরের নীলাভ জলরাশি। পাখির চোখে দূর থেকে দেখতে ফিজি দেশকে আপনার কাছে সমুদ্রের ভাসমান নৌকার মতো মনে হবে। ফিজিতে আসা ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় হলো ফিজির নিখুঁত সমুদ্র সৈকত, গুচ্ছ দ্বীপ আর ঝোপালো বন।
এছাড়াও পাহাড়ের মনোরম জলপ্রপাত, প্রবাল প্রাচীর এবং এলোমেলো আগ্নেয়গিরির শিখর যেন প্রতিটি দর্শনার্থীদের কাছে এক অন্য রকম প্রশান্তিময় স্থান। প্রকৃতি যেন এই দ্বীপ রাষ্ট্রকে দুহাত ভরে দিয়েছে। তাই এর অপার সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে।
যেখানেই দৃষ্টি পড়ে সেখানেই যেন অফুরন্ত প্রকৃতির লীলা খেলা। ফিজি একটি ছোট দেশ হলেও অল্প কথায় এর সৌন্দর্য বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। সুতরাং প্রকৃতিগত দিক থেকে ফিজিকে অসাধারণ সুন্দর দেশ বলে মানা হয়।
অবস্থান ও জনসংখ্যা
সূর্যদয়ের দেশ হিসেবে খ্যাত ফিজি হলো পৃথিবীর অন্যতম সুখী রাষ্ট্র। এটি একটি দ্বীপ রাষ্ট্র যা ওশেনিয়ার মেলানেশিয়া উপঅঞ্চলে অবস্থিত। ফিজির দক্ষিণে নিউজিল্যান্ড আর পশ্চিমে রয়েছে ভানুয়াতু। ২০২২ সাল পর্যন্ত ফিজির জনসংখ্যা হলো ৮,৮৩,৪৮০। আর আয়তন ১৮,২৭২ বর্গ কিলোমিটার।
আর ভৌগলিকভাবে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপ অঞ্চলটি নিউজিল্যান্ডের প্রায় ১৭৭০ কিলোমিটার উত্তরে এবং হনলুলু থেকে ৪৪৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। অনেকেই আবার ফিজিকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ হিসেবেই চিনে।
ফিজিতে ৩০০টিরও বেশি দ্বীপ রয়েছে এর মধ্যে মাত্র ১০৬টি দ্বীপে জনবসতির বসবাস। উনিশ শতকের শুরুতে ইউরোপীয় অধিবাসীরা ফিজিতে বসবাস করতে শুরু করে। ১৮৭৪ সালে এখানে ব্রিটেনের উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৯৭০ সালে ফিজি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। ফিজিতে লোক সংখ্যা প্রায় নয় লক্ষ এবং জনগোষ্টীর মাত্র ৫৫% ফিজিয়ান ৪০% ভারতীয় আর বাকি ৫% অন্যান্য জাতিগোষ্টীর।
অর্থনৈতিক অবস্থা
ফিজির জনগণ মূলত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তির উপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে পর্যটন হলো প্রধান শিল্প। তাই এই শিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছে দেশটির প্রধান অর্থনীতি।
পর্যটন শিল্প ছাড়াও চিনি উৎপাদন, এবং কাপড় তৈরি হলো ফিজির অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। তাছাড়া দেশটিতে প্রচুর জেলে সম্পদও রয়েছে; যা দিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
এত ছোট এক দ্বীপ রাষ্ট্র তবে তারা অর্থনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী। আর দেশটির জনপ্রতি জিডিপি দশ হাজার ডলার। ফিজিয়ান ডলারের মানও অনেক বেশি।
রাজধানী
ফিজির রাজধানী হলো সুভা। সুভা শহরটি ফিজিয়ান দ্বীপপুঞ্জের বৃহত্তম ভিতি লেভুতে অবস্থিত। এখানে রয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ও বন্দর যেখানে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ পাড়ি জমায় ফিজির সোন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য। সুভায় আরও আছে ঐতিহাসিক স্থাপত্য, সবুজ পার্ক এবং জাদুঘর।
এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য এই শহরটির বেশ সুনাম রয়েছে। সুভার প্রধান আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বার হলো নাদি শহর। অন্য দিকে ফিজির প্রধান প্রধান দ্বীপ বা গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো হচ্ছে সুভা, নাদি, লোটোকা, সিগাটোকা, লামাসা, বাবু।
জলবায়ু
ফিজিতে গ্রীষ্মের সময় উচ্চ তাপমাত্রা গড়ে ৮০° এর মাঝামাঝি ফারেনহাইট এবং শীতে এর গড় নিম্ন তাপমাত্রা ৬০° ডিগ্রি ফারেনহাইটের মধ্যে থাকে। আবার নিচু এলাকার চেয়ে উঁচু এলাকার তাপমাত্রা সাধারণত কম থাকে।
অন্য দিকে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সব জেলাতেই সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় এবং এই সময়ে গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় (হারিকেন) অনুভূত হয়। আর এই প্রাকৃতিক দূর্যোগ সম্ভবত প্রতি দুই বছরে একবার অনুভূত হয়।
এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বড় দ্বীপগুলির বৃষ্টিপাত কমে এলে বার্ষিক গড় প্রায় ১২০ ইঞ্চি (৩,০০০ মিমি) পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে।
সাংস্কৃতিক জীবন
অন্যান্য দেশের মতো ফিজির জনগণের সংস্কৃতিতে ও বিচিত্রতা রয়েছে। আর এজন্য দেশটির জনগনের বিরাট অংশ একটি মিশ্র জাতিসত্তাকে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে অবদান রাখে। ফিজির জনগণদের প্রধান ভাষা তিনটি যথা: ইংরেজি, হিন্দি, ফিজীয়।
ঐতিহ্যবাহী ফিজিয়ানরা জীবনের অনেক বৈশিষ্ট্য নিয়ে এখনও টিকে আছে। আর তাদের মধ্যে যারা উচ্চ-পদস্থ তারা অনেক সম্মানিত। তাদেরকে দেশের যেকোন আচার অনুষ্ঠানে তাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়।
এছাড়াও ফিজিয়ানরা বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানগুলিতে তাদের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পের অনুশীলনের জন্য আগ্রহ দেখায়। যেমন কাগজের তুঁতের ছাল থেকে তৈরি মাসি বা তপা কাপড় তৈরি করা, মাদুর বুনন, কাঠ খোদাই, এবং ক্যানো তৈরি করে তাদের নিজস্বতার জানান দেয়।
ইউরোপের দেশ ফিজি ভৌগলিকভাবে ছোট হলেও দেশটিতে প্রচুর নির্মাণ শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। এখানে শুধু ভ্রমণই নয় কাজের সন্ধানেও অনেক মানুষ পাড়ি জমায়।
ভারতীয়দের বসবাস
ফিজি বাংলাদেশ ও ভারত থেকে অনেক দূরের একটি দেশ। তারপরেও ভারতীয় লোক এখানে থাকা অনেক আশ্চর্যের বিষয়। আসলে ভারত যখন ব্রিটিশদের অধীনে ছিল তখন ভারতের মতো ফিজিও ব্রিটিশদের অধীনে ছিল।
আর তখন থেকেই ভারতীয়রা ফিজিতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে এবং ফিজিতে তাদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে নেয়। ওই সময় ব্রিটিশরা ফিজির বসবাসকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিল। সেইসাথে সেখানে পণ্য উৎপাদনের জন্য ব্রিটিশরা ভারতীয়দের নিয়ে ফিজিতে বসবাস করতে শুরু করে।
ফিজির ভারতীয়রা সেখানে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বজায় রাখে। যেমন জুলাই বা আগস্টের প্রথম দিকে পূর্ণিমার সময় বার্ষিক গুরু পূর্ণিমা উৎসবের সময় অগ্নি হাঁটা এবং আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতির পালন করে।
এছাড়াও তারা দীপাবলি, আলোর হিন্দু উৎসবের আয়োজন করে। এমনকি তারা প্রতি অক্টোবর মাসকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে বেছে নেয়।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য
ফিজিতে যদিও সরকার কিছু প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা প্রদান করে। কিন্তু দেখা যায় বেশিরভাগ স্কুলগুলি একটি একক জাতিগত বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দ্বারা পরিচালিত এবং স্থানীয় কমিটির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। শুনতে অবাক হওয়ার বিষয় হলেও ফিজিতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষার্থীরা ফি দেয় কিন্তু তাদের শিক্ষার সম্পূর্ণ খরচ দেয় না, তাই সরকারকে ছাত্রদের ভর্তুকি দিতে হয়।
ফিজির ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (২০১০) নাসিনুতে অবস্থিত, সারা দেশে ক্যাম্পাস এবং কেন্দ্র রয়েছে। আর ফিজির বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ প্যাসিফিক যেটি রাজধানী সুভার কাছে অবস্থিত। ফিজির সরকারের রয়েছে নিজস্ব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। দেশের সরকার প্রযুক্তিগত, কৃষি, এবং চিকিৎসা শিক্ষা ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেয়।
শহরে বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র, ক্লিনিক এবং ছোট ছোট হাসপাতালের একটি জাতীয় নেটওয়ার্ক রয়েছে। অন্যদিকে সুভা, লাউটোকা এবং লাবাসার শহরে রয়েছ বড় বড় হাসপাতাল।
ধর্ম
ফিজিতে নানান ধর্মের মানুষ রয়েছে। ফিজির সংস্কৃতি উষ্ণ এবং অন্যদের স্বাগত জানানোর জন্য তাদের অনেক সুনাম রয়েছে। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে একইসাথে দেশটিতে মুসলিম, খ্রিস্টান, হিন্দু থেকে শিখ পর্যন্ত বিভিন্ন ধর্মের লোকের বসবাস করে।
এখানে অনেক বড় বড় মসজিদও রয়েছে। এই মসজিদগুলোতে প্রতিদিন সুমধুর সুরে আজান দেওয়া হয়। শুনতে আশ্চর্যজনক মনে হলেও ফিজিতে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জন্মদিনে সরকারি ছুটিও রয়েছে। এশীয় বংশের ফিজিয়ানরা যেমন ভারতীয়রা ইসলাম, হিন্দুধর্ম এবং শিখের দিকে ঝোঁক থাকে।
অনেক আদিবাসীদের ফিজিয়ানরা খ্রিস্টান হিসাবে চিহ্নিত করে। এর কারণ হলো ১৯ শতকে, যখন ব্রিটেন ফিজিতে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, তখন অনেক ফিজিয়ান গ্রামের প্রধানরা খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। তারা ধর্মান্তরের আগে, শামানবাদ এবং অ্যানিমিজম যা ছিল আদিবাসী ফিজিয়ানদের প্রধান ধর্মীয় বিশ্বাস।
ঐতিহ্যবাহী নাচ
নাচ ফিজিয়ানদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মেকে নামক একটি নাচ তাদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়, এতে নৃত্যশিল্পী এবং গায়ক উভয়ই অংশ গ্রহণ করে। তারা গল্প বলার সংগীতকে বেছে নেয়। ফিজিয়ানরা নাচ পরিবেশন করতে কিংবদন্তিদের জীবনী থেকে গল্পগুলিকে সংরক্ষণ করে।
এই সংগীত পরিবেশন করতে তারা বছরের পর বছর পার করে দেয়। এই নাচে ঐতিহ্যবাহী ফিজিয়ান জীবনের নানান দিকগুলি তুলে ধরে। তারা মার্জিত থেকে শুরু করে উত্তেজনাপূর্ণ নাচ ও পরিবেশন করতে পছন্দ। সাধারণত, পুরুষরা যোদ্ধার পোশাক পরে যখন এবং মহিলারা ঐতিহ্যবাহী অলঙ্কৃত নিদর্শনগুলির পোশাক পরে নাচ করে। তবে গ্রামে যখন নাচ করে তখন নৃত্যশিল্পীদেরকে দর্শকদের কাছ থেকে প্রশংসাপত্র আর উপহার দেওয়া হয়।
অপরাধ প্রবণতা
ফিজিতে গ্রামীণ এলাকার তুলনায় শহরাঞ্চলে অপরাধের ঘটনা বেশি ঘটে। যেমন বেশিরভাগ অপরাধই সংঘটিত হয় রাজধানী সুভায়। এছাড়াও নদীতে বা রিসোর্ট এলাকা থেকে দূরে নানান ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। নিচে ফিজির অপরাধ প্রবণতার কিছু তথ্য জেনে নিই।
- ফিজিতে আগত দর্শনার্থীদের সর্বদা মূল্যবান জিনিসগুলির প্রতি সচেতন থাকতে হয়। অবশ্য সেখানে আগত দর্শনার্থীদেরকে নিজেদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রতি মনোযোগী হতে আগে থেকেই সতর্কবার্তা দেয়া হয়। কারণ দেখা যায় পর্যটকদের হোটেলের কক্ষ থেকে পার্স ছিনতাই সেখানে সবচেয়ে সাধারণ অপরাধ বলে গন্য করা হয়।
- ফিজিতে ভ্রমণের সময় ভ্রমণকারীরা কোথা থেকে এসেছেন এবং কোথায় অবস্থান করছেন সেই সম্পর্কে অতিরিক্ত ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করার ব্যাপারেও গোপনীয়তা বজায় রাখতে হয়। তাই সঙ্গতভাবেই আপনি যদি ফিজি শহরে বেড়াতে যান তাহলে কোনও এলাকার সাথে পরিচিত না হলে সেখানখার হোটেল কর্মীদের জিজ্ঞাসা করে ওই এলাকা সম্পর্কে জেনে নিবেন।
- আরেকটি কথা সবারই জেনে রাখা উচিত ইদানীং ফিজিতে যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির ঘটনা বেড়েছে। তাই রাতের অন্ধকারে ও আপনার একা হাঁটা উচিত নয় এবং সর্বদা বিচ্ছিন্ন এবং নির্জন এলাকা এড়াতে ভুলবেন না।
বেশিরভাগ মানুষই ফিজি দেশ সম্পর্কে জানে না। আর তাই সঙ্গতভাবেই সেখানে থাকা মানুষ ও সামাজিক অবস্থান সম্পর্কেও অনেকেরই অজানা। জেনে অবাক হবেন হয়তো ফিজির অধিবাসীদেরও রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং তারা খুবই বন্ধুবৎসল জাতি।
চারপাশে সমুদ্রবেষ্টিত ফিজিতে রয়েছে চোখ জুড়ানো সুন্দর প্রকৃতি। আর তাই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ফিজিতে মানুষ ভ্রমণ করতে আসে। এছাড়াও এখানে আদি স্কুবা ডাইভিং, কায়াকিং এবং নানান ধরনের বিনোদন উপভোগ করার জন্য ও উপযুক্ত ।
আর স্থলে ও আছে হাইকিং ট্রেইলের মধ্যে একটি নিয়ে অজানা প্রান্তরে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ। সেই সাথে বোনাস হিসেবে স্থানীয় উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতও দেখা হয়ে যাবে।
Feature Image: pinterest.com References: 01. Fiji Republic Pacific Ocean. 02. Fiji. 03. Fiji Culture Tradition Heritage.