এককালের ১০ হাজার মানুষের বসবাসের স্থান তুর্কির দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত কায়াকোয় গ্রামটি দীর্ঘকাল জনবসতিহীন হওয়ার কারণে ভূতুড়ে গ্রাম হিসেবে বর্তমানে সকলের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। তবে হঠাৎ করেই জনমানবহীন হয়নি গ্রামটি। জনশূন্য ভূতুড়ে এই গ্রামটির এই দশার পেছনে কোনো অস্বাভাবিক অতিপ্রাকৃত কারণ নেই। বরং সভ্যতার দাবিদার মানুষেরই হাত রয়েছে এর পেছনে।
ফাঁকা, জনমানবহীন ছোট্ট এই গ্রামের বর্তমান এই অবস্থা হওয়ার পেছনে রয়েছে বিস্তৃত ইতিহাস। ১৪ শতকের শুরুর দিকে সংগঠিত হওয়া, গ্রিক-তুর্কি যুদ্ধের শেষে কায়াকোয়কে জোরপূর্বক পরিত্যাগ করা হয়। জোর করে সেখানে বসবাসকারীদের করা হয় নিজের ভিটা-মাটি ছাড়া। শুধুমাত্র ধর্মের কারণে, ধর্মভিত্তিক এই বিভক্তি আদৌ কি কেউ চেয়েছিল? কে জানে!
তবে যাই হোক, কায়াকোয় সম্পর্কে প্রথম যে জিনিসটি আলাদা করে নজর কাড়ে তা হলো এর ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান। গ্রামটি পাশেই রয়েছে অসম্ভব সুন্দর একটি পাহাড়, আর তারই কোল ঘেঁষে গ্রামটি গড়ে উঠেছে। এর একদিকে রয়েছে উপত্যকা এবং অন্যদিক হতে দেখা যায় উপসাগর। পাহাড় আর সাগরের স্বর্গীয় দৃশ্য চোখ আর মন জুড়াবে যে কোনো মানব চক্ষুকে।
শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বিপুলতা নয়, গ্রামটির পরিত্যক্ত বাড়ি, গীর্জা এবং অন্যান্য ভবনে পরিপূর্ণ হওয়ার কারণে, একইসাথে সবকিছু আছে এবং কিছুই নেই এর যে বিচিত্র অনুভূতি এবং নিঃসঙ্গতার দোলাচাল মানব মনে উঁকি দেয় তা গ্রামটিকে আলাদা এক সৌন্দর্য দান করে।
ভূতুড়ে হওয়ার পেছনের ইতিহাস
কায়াকোয়র ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় অতীতে আনাতোলিয়ান মুসলিম এবং গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসীদের আবাসস্থল ছিল এই গ্রামটি। তবে উভয়েই সুখে, শান্তিতে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করে আসছিল বহু বছর ধরে। ধর্ম, রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান সব কিছু আলাদা হলেও, নিজেদের মধ্যকার ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল অটুট।
তবে বসবাসকারীদের মধ্যকার ওই সুখ স্বচ্ছলতায় একটা সময় পর ব্যাঘাত ঘটে। এর মূলে রয়েছিল রাজনৈতিক কারণ। এক প্রকার জোরপূর্বকভাবেই যেন কায়াকোয়কে করা হয় জনমানবহীন, বিরানভূমিতে।
যেহেতু কায়াকোয়র অধিকাংশ জনগন খ্রীষ্ট আর মুসলিম ধর্মাবলম্বী ছিল তাই গ্রিক-তুর্কি যুদ্ধের পর ধর্ম হিসেবে ভাগ করে খ্রীস্ট ধর্মাবলম্বীদের পাঠানো হয় গ্রীসে অন্যদিকে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের পাঠানো হয় তুর্কীতে। নিজ ধর্মের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি করতে চাওয়াই এই বিভাজনের মূল কারণ।
ইতিহাসের পাতায় থেকে যাওয়া যুগে যুগে মানুষের সৃষ্ট যুদ্ধ-বিগ্রহের কারনে কি পরিমাণ ক্ষতি এক এক সময় এক এক জাতি বহন করছে তা যেনো আজও কথা বলে৷ না, কোনো জ্বীন-ভূতের আছড়ে না, কায়াকোয়া জনশূন্য আজ মানুষেরই কারনে। শুধুমাত্র ধর্ম অনুসারীদের সংখ্যার ভিত্তিতে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রমাণ করতে এই বিভাজন।
শুধুমাত্র পায়ের নিচের মাটি না পরম-আত্মীয় প্রতিবেশী, নিজ গ্রামের আলো-বাতাস, অথবা পরম মমতায় নিজ হাতে লাগানো ছোট্ট গাছটি সব কিছু ছেড়ে তাদের চলে যেতে হয়েছিলো অন্য কোনো দেশে, অন্য কোনো গ্রামে। যা তাদের নিজের না।
কায়াকোয়তে কিভাবে যাবেন?
তুর্কীর ওলুডেনিজ ন্যাচার পার্কের উত্তর-পশ্চিম অংশের এই গ্রামটি অবস্থিত। কায়কোয়ে আসতে, আপনাকে প্রথমে মুগলার ফেথিয়ে জেলায় পৌঁছাতে হবে। ফেথিয়ে নিজেও সুন্দর, মনোরম এবং সময় কাটানোর জন্য একটি চমৎকার জায়গা। ওলুডেনিজ থেকে ছেড়ে যাওয়া মিনিবাসগুলি কায়কোয় যেতে ইচ্ছুক যাত্রীদের সেখানে নিয়ে যায়। ৪.৫ কিলোমিটার দূরে গাড়িতে যেতে সময় লাগে প্রায় ৮ মিনিট।
তুর্কীর ফাতিয়েতে যাওয়ার অন্যতম একটি রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয় স্থানটি। সাইকেলিস্টদের কাছে বেশ জনপ্রিয় জায়গাটি এর সৌন্দর্য্য আর নিজস্ব অবস্থানের জন্য। কারন জায়গাটি এমন স্থানে যে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আদর্শ হিসেবে বিবেচিত সকলের জন্য।
কায়াকোয়র যা কিছু একজন দর্শনার্থীদের আনন্দ দিবে
যদিও নির্জন এই গ্রামটি ঘুরতে ঘুরতে চমকপ্রদ কিছু আবশ্যিক করনীয় না থাকলেও সেখানে থাকাকালীন আপনাকে কিছু জায়গা প্রদর্শন করতেই হবে। চাইলে পাশের ছোট চ্যাপেল সহ পাহাড়ে আরোহণ করা যেতে পারে।
এই স্পটটি থেকে পুরো গ্রামের একটি চমৎকার দৃশ্য যেমন ধরা পড়ে তেমনি পাশের সাগরের জলরাশি যে কারো মনকে প্রফুল্ল করতে সক্ষম। এছাড়াও গ্রামের ভেতর সবচেয়ে বড় বড় গীর্জা দুটিকে পরিদর্শন করা যেতে পারে। যদিও বর্তমানে সেটি বন্ধ আছে ফলে ভেতরে প্রবেশ সম্ভব না।
কায়াকোয় পুরোটা ঘুরেফিরে দেখতে বড়জোর এক ঘন্টা সময় লাগতে পারে। তবে কায়াকোয়ের নিজস্ব যে শোভা তা যে কোনো দর্শনার্থীদের কয়েক ঘন্টা সময়ের জন্য এখানে আটকে রাখতে পারে। পরিত্যক্ত হলেও গ্রামটিতে প্রবেশ করতে নামমাত্র ফি দিতে হয় কর্তৃপক্ষকে। যদিও এর সৌন্দর্য্য এর কাছে তা পয়সা উসুল বলা চলে৷
কায়াকোয় নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমা
বিশ্ব ঐতিহ্যের বাহক কায়াকোয়া’কে ইউনেস্কো ‘বিশ্ব বন্ধুত্ব ও শান্তির গ্রাম’ হিসেবে মনোনীত করেছে। ছোট্ট এই ভূতুড়ে গ্রামের পেছনের ইতিহাস এতটাই গুরুত্ব বহন করে যে, গ্রামটি নিয়ে সিনেমা তৈরি করেছে হলিউড। চলচ্চিত্রটির নাম ‘দ্যা ওয়াটার ডিভাইনার’।
বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান অভিনেতা রাসেল ক্রো দ্য ওয়াটার ডিভাইনার (লাস্ট হোপ) নামক এই ফিল্মের শেষ সিকোয়েন্সগুলি চিত্রায়িত করেছেন, যেখানে তিনি সেম ইলমাজ এবং ইলমাজ এরদোগানের সাথে অভিনয় করেছিলেন। চলচ্চিত্রের কলাকুশলীরা সিনেমাটি কায়কোয়ের পুরানো চার্চের চারপাশে চিত্রগ্রহণ করেন। এমনকি সেখানে বসবাসকারী লোকেরা এই দুর্দান্ত ছবিতে অতিরিক্ত চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিল যা বেশ প্রশংসনীয় একটি কাজ বলা চলে।
চলচ্চিত্রটিতে দেখা যায়, কায়াকোয়ে বসবাসকারী একজন ব্যক্তির গল্প চিত্রিত হিয়েছে। যিনি চানাক্কালের যুদ্ধে তার সন্তানদের হারিয়েছিলেন এবং যুদ্ধের পরে তিনি তাদের সন্ধানে তুর্কিয়েতে ফিরে আসেন। চিত্রগ্রহণের জন্য সেই গ্রামের-ই ঘোড়া এবং গাড়িগুলি ছবিতে অংশ নেওয়া বিদেশী অভিনেতারা ব্যবহার করেছিলেন।
বর্তমানে ইউনেস্কোতর তত্ত্বাবধানে বিশ্বের প্রাচীন গ্রামগুলার এক-তৃতীয়াংশের উন্নয়ন এবং সংরক্ষণের কাজ চলছে। তার ই অংশ বিশেষ পর্যটন শিল্পের সুবিধার জন্য একটি হোটেল নির্মাণ কাজ চলছে এখানে।
Feature Image: pinterest.com Reference: 01. The Ghost Village of Kayakoy. 02. The Story Behind Turkeys Abandoned Religious Ghost Town. 03. The Ghost Town Fethiyes Kayakoy Village. 04. Kayakoy Abandoned Village.