ক্রিকেট খেলার জন্য বিশ্বব্যাপী বেশ জনপ্রিয় এবং পরিচিত একটি দেশ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়া কিন্তু একটি দেশ না বরং কয়েকটি দেশ মিলে একটি মহাদেশ। নিউজিল্যান্ড, তাসমানিয়া সহ বেশ কিছু ছোট দ্বীপ এই মহাদেশের অংশ। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যখানে অবস্থিত তাসমান সাগর।
সেই সাগরের বুক চিরে গেছে ছোট্ট একটি দ্বীপ, নাম তার তাসমানি। তাসমানির পূর্বের ইতিহাস বেশ করুণ। অনেক অনেক বছর আগে এই দ্বীপে বসবাস করতো প্রাচীন আদিবাসী জনগোষ্ঠী। এরা আদিম তাসমানিয়ান নামেই পরিচিত। বেশ শান্তশিষ্ট, ভদ্র এই আদিবাসী গোষ্ঠীকে খুবই নির্মমভাবে হত্যা করে বিলীন করে দেওয়া হয়।
নিরীহ তাসমানিয়ানদের উপর শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা চাপিয়ে দেয় ব্ল্যাক ওয়ার। যা ছিল এক অসম যুদ্ধ। আদতে যুদ্ধ বলা হলেও এটি মোটেও কোন যুদ্ধ ছিল না, স্রেফ নিরবে গণহত্যা করে তাসমানিয়ানদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র ছিল। উনিশ শতকে হারিয়ে যাওয়া আদিম তাসমানিয়ান আদিবাসী গোষ্ঠীর গল্প শুনাবো আজ।
আদিম তাসমানিয়ানদের পরিচয়
প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে তাসমানিয়ায় প্রথম আগমন ঘটে আদিম তাসমানিয়ানদের, ৬ হাজার কআদিবাসী তাসমানিয়ানদের পূর্বপুরুষরা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইউরোপীয় যোগাযোগের আগ পর্যন্ত তারা ৮ হাজার বছর ধরে মানব জাতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল।
তাসমানিয়ান আদিবাসীরা এমন ভাষায় কথা বলত যা মূল ভূখণ্ডের আদিবাসীদের কাছে দুর্বোধ্য ছিল। দ্বীপটি বেশ কয়েকটি লোকের মধ্যে বিভক্ত ছিল যারা বিভিন্ন উপভাষায় কথা বলে, প্রতিটি দ্বীপ একটি শিকার অঞ্চল দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকত। এরা পালাওয়া নামে পরিচিত ছিল।
আদিম তাসমানিয় মানুষ দেখতে বেশ বিদ্ঘুটে ছিল। তাসমানিয়ান পুরুষ প্রায় ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং তাসমানিয়ান নারীর উচ্চতা ৪ ফুট ১১ ইঞ্চির কাছাকাছি ছিল। গায়ের রঙ ছিল কুচকুচে কালো। দাঁত স্বাভাবিকের তুলনায় বড় বড়, লম্বা মাথা, দীর্ঘ চোয়ালবিশিষ্ট মুখের অবয়ব ছিল। এই ছিল তাদের শারীরিক গড়ন।
তাসমানিয়ানরা অন্যান্য আদিবাসীগোষ্ঠির তুলনায় আচার ব্যবহারে শান্তশিষ্ট হলেও নিজের গোত্রগুলো মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়ত। তাদের নিজস্ব সম্পত্তি বলতে তাবিজ, অস্ত্র ও কিছু আসবাবপত্র ছিল। সবচেয়ে বলিষ্ঠ পুরুষকে যুদ্ধের সময় নেতা বানানো হত। বর্শা, ধনুক দিয়ে শিকার করতে পারত তারা। কাঠে কাঠ ঘষে আগুন জ্বালিয়ে মাংস পুড়িয়ে খেতো। তবে ক্যাঙ্গারু খেতে বেশ পছন্দ করত তারা। তাসমানিয়ান সমাজে বৃদ্ধদের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য।
গ্রীষ্মকালীন সময়ে তাসমানিয়ান আদিবাসীরা ১৫ থেকে ৫০ জন লোকের দল বানিয়ে বা পরিবার হিসেবে অভ্যন্তরীণ খোলা বন এবং অভ্যন্তরীণ ভূমিতে চলে যেত এবং শীতকালীন সময়ে তারা উপকূলে চলে যেত। তবে করোবোরি (গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান উদযাপনকারী একটি নৃত্য), শিকারের জন্য বা আক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য মাঝে মাঝে সবাই একত্রিত হতো।
রীতিনীতি
আদিম তাসমানিয়ানদের নির্দিষ্ট কোন ধর্ম ছিল না। তবে তারা বেশ কিছু রীতিনীতি পালন করত। দেবতা ও জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস করত তারা। খারাপ আত্মা ও দেবতা থেকে বাঁচতে ঘুমানোর সময় চারপাশে মশাল জ্বালিয়ে রাখত। কখনো কখনো আত্মাকে উপকারী মনে করলেও অধিকাংশ তাসমানিয়ান আত্মাকে অনিষ্টকারী হিসেবে ভাবত। তাদের বিষাস মরার পর সব মানুষ ভূত হয়ে যায়।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনেকধরনের রীতিনীতি ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় রীতি ছিল মৃতদেহ পুড়িয়ে দেয়া ও ছাইগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলা। এছাড়াও নির্দিষ্ট ব্যক্তির কবর চিনে রাখার জন্য তাসমানিয়ানরা কবরের উপর ডালপালা পুঁতে দিত। মৃত ব্যক্তির নাম সহজে মুখে নিত না। জাদুবিদ্যায় বিশ্বাসী তাসমানিয়ানরা তাদের শত্রুকে দমন করার জন্য তার ব্যবহৃত কোন জিনিস বা যেকোনো অঙ্গকে চর্বির সাথে মিশিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলত। মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল।
উপনিবেশিক হানা
শান্তিপ্রিয় তাসমানিয়ানদের দিনকাল বেশ ভালোই যাচ্ছিল কিন্তু তাদের কপালে শান্তি খুব বেশিদিন জুটল না। ১৮০৩ সালে তাসমানিয়াতে প্রথম স্থায়ী শ্বেতাঙ্গ বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। ১৮০৪ সালে তাসমানিয়ান আদিবাসীদের একটি গ্রুপের উপর শ্বেতাঙ্গরা একদম অকারনে আক্রমণ করে। এভাবেই শুরু হয় ব্ল্যাক ওয়ার।
শ্বেতাঙ্গরা আদিবাসীদের সাথে অমানুষের মতো আচরণ করত, তাদের শিকারের জায়গা দখল করত, তাদের খাদ্য সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছিল, মহিলাদের আক্রমণ করত এবং পুরুষদের হত্যা করত। তাসমানিয়ান আদিবাসীদের প্রতিরোধের প্রচেষ্টা ইউরোপীয়দের উন্নত অস্ত্র ও শক্তির কাছে ব্যর্থ হয়।
১৮৩১ থেকে ১৮৩৫ সালের মধ্যে, স্পষ্টতই সমঝোতার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা করে আদিম তাসমানিয়ানরা। ১৮৩৩ সালে, লেফটেন্যান্ট-গভর্নর জর্জ আর্থার দ্বারা পৃষ্ঠপোষক জর্জ অগাস্টাস রবিনসন তাসমানিয়ানদের এই আশ্বাস দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে রাজি করেছিলেন যে তাদের সুরক্ষা দেওয়া হবে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের জমি তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু এই আশ্বাস মিথ্যা ছিল; রবিনসন বা লেফটেন্যান্ট-গভর্নর আর্থার ফার্নোক্স দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসন ছাড়া অন্য কিছু করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন এবং মূল ভূখণ্ড তাসমানিয়া থেকে আদিবাসীদের অপসারণের সুবিধার্থে রবিনসন এই আশ্বাস দিয়েছিলেন।
আনুমানিক ২০০ তাসমানিয়ান আদিবাসীদের ফ্লিন্ডারস দ্বীপে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাদের সামাজিক সংগঠন এবং ঐতিহ্যগত জীবনধারা ধ্বংস হয়ে করে ফেলা হয়। সেখানে তারা নানাবিধ অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হরে থাকে। তাদের “সভ্য” করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে শ্বেতাঙ্গরা দাবি করলেও এটিও আসলে সত্য ছিল না। ফলাফল তারা মারা যেতে শুরু করে।
পরবর্তীতে শেষ ৪৭ জন জীবিত বাসিন্দাকে হোবার্টের দক্ষিণে অয়েস্টার কোভে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। ট্রুগানিনি এবং ফ্যানি কোচরান স্মিথকে তাসমানিয়ান বংশোদ্ভূত শেষ ব্যক্তি বলে মনে করা হয়।
১৮০৩ সালে তাসমানিয়ার ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গদের উপনিবেশের আগে, আনুমানিক ৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার পালাওয়া ছিল। এই জনসংখ্যা তিন দশকের মধ্যে সংখ্যায় মারাত্মক হ্রাসের সম্মুখীন হয়েছিল, যার ফলে ১৮৩৫ সালের মধ্যে মাত্র ৪০০ জন খাঁটি তাসমানিয়ান আদিবাসী বেঁচে ছিল। এই অবশিষ্টাংশের বেশিরভাগই শিবিরে বন্দী ছিল যেখানে পরবর্তী ১২ বছরের মধ্যে ৪৭ জন ব্যতীত সবাই মারা যায়। ১৮৭৬ সালে শেষ তাসমানিয়ান নারী ট্রুগানিনির মৃত্যু হয়।
এখনও বলা হয় যে এই নাটকীয় জনসংখ্যাগত পতন আসলে বিভিন্ন রোগের প্রভাবের ফলাফল। উদাহরণস্বরূপ, জিওফ্রে ব্লেনির মতে ‘রোগ তাদের বেশিরভাগকে হত্যা করেছিল কিন্তু যুদ্ধ এবং ব্যক্তিগত সহিংসতাও ধ্বংসাত্মক ছিল।’
তবে হেনরি রেনল্ডস ব্ল্যাক ওয়ারকেই ক্ষয়ক্ষতির জন্য দায়ী করেছেন। ঔপনিবেশিকতা ও গণহত্যার ইতিহাসের অনেক বিশেষজ্ঞ, যেমন বেন কিয়ারনান, কলিন টাটজ এবং বেঞ্জামিন ম্যাডলি বলেছেন যে,
রাফেল লেমকিনের দ্বারা নির্ধারিত এবং জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশনে গৃহীত সংজ্ঞা অনুসারে তাসমানিয়ান ধ্বংসযজ্ঞ গণহত্যা হিসাবে গ্রহনযোগ্য।
Feature Photo: wikiwand.com Sources: 01. Tasmanian Aboriginal people. 02. New Research Turns Tasmanian Aboriginal History On Its Head. 03. Aboriginal Tasmanians. 04. The lost tribe.