পৃথিবীতে যতগুলো সভ্যতা গড়ে উঠেছে তার কোনোটিই রাতারাতি তৈরি হয়নি। বরং দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় বিস্তার লাভ করেছে। মূলত নদীর অববাহিকাগুলো ছিল এক একটি সভ্যতা গড়ে ওঠার কেন্দ্রস্থল। ভৌগলিক অবস্থান, যোগাযোগ এবং সাংস্কৃতিক বিস্তারের উপর কেন্দ্র করে সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছিল।
প্রাচীন তিনটি বৃহৎ সভ্যতার মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো এবং বহুল চর্চিত সভ্যতা হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতা। বাকি দুটো হচ্ছে মেসোপোটেমিয়ো এবং মিশরীয় সভ্যতা।
ব্রোঞ্জযুগীয় এই সভ্যতাটি আনুমানিক ৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ (পুনবর্ধিত কাল ২৫০০-১৯০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ) পর্যন্ত সময়কাল ধরে গড়ে উঠেছিল। এর কেন্দ্রস্থল ছিল পাঞ্জাব অঞ্চলের সিন্ধু নদের অববাহিকা। বিস্তার লাভ করেছিল ঘগ্গর-হকরা নদী উপত্যকা থেকে গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চল পর্যন্ত।
এই সভ্যতার খননকার্য হরপ্পা অঞ্চলে শুরু হয় বিধায় একে হরপ্পান সভ্যতা হিসেবেও অভিহিত করা হয়। ভৌগলিক বিস্তৃতির দিক থেকে এটি প্রাচীন পৃথিবীর সুবৃহৎ সভ্যতা। এই সভ্যতা বিস্তার লাভ করে প্রায় ১৩ লাখ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। বিকাশ ঘটে সমগ্র উত্তর পশ্চিম ভারত জুড়ে। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ, দক্ষিণ পূর্ব আফগানিস্তান এবং উত্তর ও দক্ষিণ বেলুচিস্তানে এই সভ্যতার বিস্তৃতি লক্ষ্য করা যায়।
বহুল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় একটি ধারণা হচ্ছে, সিন্ধু সভ্যতার বিস্তার ঘটেছে আর্যদের হাত ধরে। ঘটনার সত্যতা কতটুকু তা ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই কেবল বোঝা সম্ভব।
ভারতবর্ষে মানুষের বসতি গড়ে উঠেছিল প্রায় পৌনে এক লক্ষ বছর পূর্বে। তবে সেটি ছিল কেবল বেঁচে থাকার সংগ্রাম। অন্যান্য প্রজাতির জীবের সাথে ইতর বিশেষ ছিল খুব সামান্যই। এই অঞ্চলে আধুনিক সভ্যতার যাত্রা শুরু হয় কেবল পাঁচ হাজার বছর পূর্বে।
হরপ্পায় প্রাপ্ত নিদর্শন পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, সেখানে বেশকিছু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বসবাস করতো। অপরদিকে আর্যরা ছিল অনেকাংশেই বহিরাগত।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীদের চেয়ে তাই এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদেরই সিন্ধু সভ্যতা গড়ে তোলার অবদান বেশি। আর আর্যরা পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল বিধায়ই নানা দেশের শিল্প-সংস্কৃতি এবং পুরাণে বেশকিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
এই বিস্ময়কর সভ্যতাটি সর্বপ্রথম চিহ্নিত হয় ১৯২১ সালে হরপ্পায় এবং ১৯২২ সালে মহেঞ্জোদারোতে। দু’টো অঞ্চলই বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশে এদের অবস্থান৷
মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষ ১৯৮০ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর আওতাভুক্ত হয়। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়ের হাত ধরে সিন্ধু সভ্যতা আলোর মুখ দেখে। পরবর্তীতে এই অভিযানে তালিকাভুক্ত হয় দয়ারাম সাহানি, জর্জ মার্শাল এবং মর্টিমার হুইলারের নাম।
সুবৃহৎ দুটি শহর হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো এবং আরো ১০০টি ছোট শহর এবং গ্রাম নিয়ে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। বড় শহর দুটোর বিস্তার ছিল মাত্র ১.৬ কিলোমিটার। তবে ক্ষমতার পালাবদল আবর্তিত হয়েছে এই শহর দুটিকে ঘিরেই। হরপ্পার জনসংখ্যা ছিল (২৩,৫০০-৩৫,০০০) এবং মহেঞ্জোদারোর জনসংখ্যা ছিল (৩৫,০০০-৪১,২৫০)।
প্রাথমিকভাবে এই সভ্যতা কৃষির উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কিছুটা ছাপও লক্ষ্য করা যায়। গম, বার্লি, রবিশস্য, সরিষা এই সকল ফসলের চাষ হতো। তুলা চাষের প্রমাণও মিলেছে এই সভ্যতায়। সেই সাথে গৃহপালিত পশুপাখিরও চল ছিল। কুকুর, বেড়ালকে পোষ মানানো হয়েছিল। গৃহপালিত পশু হিসেবে শূকর, উট, মহিষ এবং এশীয় হাতির ব্যবহার ছিল।
বাণিজ্যিক কার্যক্রম হিসেবে হরপ্পায় বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি করা হতো এবং তৈরি পণ্য প্রদেশের বাইরে সরবরাহ করা হতো। এভাবে একটি আন্তঃপ্রদেশীয় বাণিজ্য গড়ে ওঠে। মহেঞ্জোদারোর বাড়ি-ঘরগুলোর আকার-আকৃতি ঐ সময়ের সামাজিক অবস্থান তুলে ধরে। সেই সাথে রাজনৈতিক প্রভাব এবং পদমর্যাদার বিষয়টিও প্রদর্শন করে।
সিন্ধু সভ্যতা থেকে পাওয়া বিভিন্ন শৈল্পিক নিদর্শন ঐ সময়কার জীবনযাপন, মানসিকতা এবং ধর্মবিশ্বাসকে তুলে ধরে। পাথরের মূর্তি এসময় দূর্লভ ছিল। সিন্ধু সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জের মূর্তিগুলো সংখ্যায় কম এবং আকারে ছোট হলেও এদের তাৎপর্য অনেক বেশি। এসব পর্যবেক্ষণ করেই তৎকালীন মানুষদের ধর্মবিশ্বাস এবং ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।
হরপ্পায় প্রাপ্ত শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘টেরাকোটার শিল্পকর্ম’। বেশিরভাগ মূর্তিই গয়না পরিহিত দণ্ডায়মান নারী এবং দাড়ি শোভিত, শিং পরিহিত পুরুষ। এরা মূলত বিভিন্ন দেব-দেবীকে নির্দেশ করে। কিছু বাচ্চাসহ মাতৃমূর্তি এবং গৃহস্থালি কর্মকাণ্ডের টেরাকোটাও পাওয়া গিয়েছে। মৃৎপাত্রে আঁকা তৎকালীন ঐতিহ্যের ছবিও আবিষ্কৃত হয়েছে।
সিন্ধু সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সিলমোহর। এই সিল মোহরগুলোতে হাতি, বাইসন, গণ্ডার, ষাঁড়, বাঘ অঙ্কিত রয়েছে। প্রতিটি সিলমোহরই কোনো না কোনো ধর্মীয় আচারকে নির্দেশ করে। এগুলো একই সাথে পৌরাণিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে।
কপার এবং ব্রোঞ্জ ছিল হাতিয়ার তৈরির মূল উপকরণ। কুঠার, বর্ষা, তীর, ছুরি প্রভৃতি অস্ত্র তৈরি করা হতো এই উপকরণ দিয়ে। স্বর্ণ এবং রূপার ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। তবে স্বর্ণের তুলনায় রূপার ব্যবহারই ছিল বেশি। স্বর্ণের ব্যবহার হতো মূলত অলংকার হিসেবে। মহেঞ্জোদারো থেকে যে প্রাচীন লিপি উদ্ধার করা হয়েছে সেটার মর্মার্থ স্পষ্টভাবে উদ্ধার করা যায়নি। তবে এটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা নয়।
কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, মন্দির এবং প্রাসাদের সংখ্যা এবং অস্তিত্বের প্রমাণ কম মেলে বিধায়, এটিকে প্রদেশ বা রাজ্য নয় বরং, কতগুলো স্বাধীন শহরের সমষ্টি বলাই যুক্তিযুক্ত। এই মতবাদ অনুসারে এখানকার সমাজব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হতো কিছু মুষ্টিমেয় বণিকগণের দ্বারা। সিন্ধু সভ্যতায় বাণিজ্যের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই সভ্যতায় ব্যবহৃত বাণিজ্য পথগুলোর বেশিরভাগেরই ভৌগলিক অবস্থান বেশ তাৎপর্য বহন করে।
সকল দিক থেকে সমৃদ্ধ এই সভ্যতাটি নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। অথচ এটি আবিষ্কারের বয়স খুব বেশি নয়। সভ্যতার ভাঙ্গা গড়ার পরিক্রমায় এক সময় এই সভ্যতাও বিলীন হয়ে যায়। যদিও এর প্রকৃত এবং পরিষ্কার কোনো কারণ আজও অনুসন্ধান করে বের করা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এর আধিপত্য ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
দ্রুত নগরায়ন এবং জনসংখ্যাধিক্যের কারণে এটি জৌলুশ হারাতে শুরু করে। বাণিজ্যিক কার্যক্রমও ঝিমিয়ে পড়ে। তবে এটি বিলীন হওয়ার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় আবহাওয়ার পরিবর্তনকে। ধারণা করা হয় উক্ত এলাকার সংগঠিত বন্যা এবং সরস্বতী নদীর শুকিয়ে যাওয়া এই ভাঙনকে ত্বরান্বিত করে। লোকজন দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে সরে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে কালের গর্ভে হারিয়ে যায় এক আশ্চর্য সভ্যতা। দীর্ঘকাল পরে ধ্বংসাবশেষ থেকে যার অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে।
ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত নমুনা থেকে এযাবতকাল যত তথ্য পাওয়া গেছে, এই সভ্যতা বিশাল এক বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। এত প্রাচীন একটি সভ্যতার জীবনযাপন, শিল্প, সংস্কৃতি, বাণিজ্য, ধর্মবিশ্বাস সকল কিছু মিলিয়ে কোনো অংশেই পিছিয়ে ছিল না। বরং বর্তমান সভ্যতার সোপান হিসেবে কাজ করেছে। ফলে এটি পৃথিবীতে আজ বহুল চর্চিত বিষয়। সিন্ধু সভ্যতা শুধু একটি সভ্যতা নয় বরং ইতিহাসের অগ্রযাত্রার মাইফলক।
Feature Image: wallpaperaccess.com Reference: 01. Indus Civilization. 02. Indus Saraswati. 03. What Was The Indus Valley Civilization.