টেরারিয়াম: বদ্ধ বয়ামে সবুজ পৃথিবী

1640
0
Sources : Pexel.com

অ্যাক্যুরিয়াম আমরা কম বেশি সবাই চিনি, তবে টেরারিয়াম কিছুটা নতুন হতে পারে আমাদের জন্য। অনেকের এই বিষয়ে কিছু ধারনা আছে, আবার কেউ হয়তো আজ প্রথম শুনছেন কিংবা কেউ এটাকে চিনলেও নাম জানেন না। 

টেরারিয়াম হলো একধরনের ক্ষুদ্র বা মিনিয়েচার বাগান, যেটা ঘরের মধ্যে আপনি করতে পারবেন। একটা কাঁচের জার বা বোলে তৈরি করা হয় ছোট্ট একটা সবুজের জগত। ফার্ন-মসসহ নানা সবুজ, রঙবেরঙের মিনি প্লান্ট এর সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। 

সাধারণত যে সকল গাছের গ্রোথ খুব বেশি না, সেই গাছগুলো এই জারের জন্য নির্বাচন করা হয়। যাতে নিজের সখ পূর্ণ করতে পারেন তাই টেরারিয়াম কী, কীভাবে বানাবেন, কী উপকারিতা অর্থাৎ টেরারিয়াম সম্পর্কে আপনাদের ধারণা স্পষ্ট করার জন্য আমাদের এই প্রয়াস।  

টেরারিয়াম 

টেরা শব্দটি ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ হলো পৃথিবী এবং আরিয়াম অর্থ হলো জায়গা বা পাত্র। অর্থাৎ টেরারিয়াম অর্থ দাঁড়াচ্ছে ঘরের মধ্যে কিংবা টেবিলে ছোট জায়গাতে পৃথিবীর একটা অংশকে ধরে রাখা। অ্যাক্যুরিয়ামে থাকে মাছ এবং পানি আর এই টেরারিয়ামে থাকে মাটি-উদ্ভিদ।  

টেরারিয়ামের ইতিহাস 

সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে, জনপ্রিয়তা পাওয়া এই ছোট্ট ইকোসিস্টেমের শুরু প্রায় ২০০ বছর আগে। ১৮৪২ সালে বোটানিস্ট ড.  নাথানিয়েল বাগশ’ ওয়ার্ড ভুলক্রমে এটি আবিষ্কার করেন। তিনি একটা বদ্ধ কাঁচের বয়ামে মথ পুপা বড় করছিলেন। 

Sources: Pexel.com

তিনি খেয়াল করলেন, এই বদ্ধ বয়ামে ফার্ন এবং মস বেশ ভালোভাবেই বেড়ে উঠছে। এইগুলো তিনি রেখেছিলেন, মথের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করতে। 

এরপর তিনি কিছু এক্সপেরিমেন্ট করতে থাকেন বয়ামে উদ্ভিদ আসলেই বেড়ে উঠবে কিনা সেটা নিয়ে। তার পরীক্ষার ফলে এও জানা যায় যে, এই বদ্ধ ইকো সিস্টেমের দরুণ, অন্য এলাকা কিংবা পরিবেশের গাছও এই বদ্ধ বয়ামে বেঁচে থাকে। এরকম বেশ কিছু পরীক্ষার পর তিনি এই বিষয় নিয়ে পেপারও লেখেন। 

কিছুদিন পর ইউরোপ এবং বৃটেনে এই টেরারিয়াম বেশ জনপ্রিয় হয়, এর মূল কারন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গাছ কিংবা ফার্ণ কিংবা মস অর্থাৎ এ জাতীয় উদ্ভিদের অন্যদেশে বেড়ে ওঠা এবং বেঁচে থাকার যে বিষয়টা। দ্বিতীয় কারন হল, অন্য এলাকার এবং অঞ্চলের ইকোসিস্টেম ভালো মতো বোঝা। 

ইদানিংকালে এর জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়ছে। এর একটা কারন, দেখতে দারুণ এই সবুজের বয়ামগুলো, যেন পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি। অন্যদিকে শহুরে জীবনে একটু খানি সবুজের দেখা পাওয়া নিজের হাতের কাছেই।  

কীভাবে কাজ করে এই টেরারিয়াম

টেরারিয়াম এর মধ্যে কিন্তু পুরো ইকোসিস্টেম রয়েছে। পার্থক্য হলো এটা একটা ছোট্ট এবং বদ্ধ বয়ামে কিংবা বোলে থাকে। তাই এর আবহাওয়া আলাদা এবং নিজস্ব। টেরারিয়ামের ইকোসিস্টেমে আছে দুটো প্রধান সাইকেল ওয়াটার বা পানির সাইকেল এবং কার্বন সাইকেল। 

Sources : Pexel.com

টেরারিয়ামের মাটি তৈরিতে এক্টিভেটেড ব্ল্যাক কার্বণ বা চারকোল। বদ্ধ বয়ামে থাকা মাটি এবং উদ্ভিদগুলো বাষ্প নির্গত করে। এই বাষ্প গ্লাসের গায়ে জমা হয় এবং ধীরে ধীরে বৃষ্টির মত করে পড়তে থাকে। এতে করে মাটির আদ্রতা বজায় থাকে। রোদ এবং প্রচন্ড গরম বা আলো যেখানে আসে, সেখান থেকে দূরে রাখা হয় এই জার।

পুরো প্রক্রিয়া নিজে নিজেই চলতে থাকে এভাবে। প্রতি সপ্তাহে এক থেকে দু’বার পানি স্প্রে করতে হয় এই জারে। তবে খুব সাবধানে এই কাজ করতে হয়, যাতে বদ্ধ জারে হাতের স্পর্শ না লাগে। 

টেরারিয়াম তৈরি করতে যা লাগবে

টেরারিয়াম তৈরি করা খুব যে কঠিন তা কিন্তু না, তবে এই ইকোসিস্টেম তৈরি করতে সতর্কতা প্রয়োজন। 

১. ছোট গোল বা লম্বা কিংবা যে কোন মাপের কাঁচ অথবা প্লাস্টিকের বয়াম বা বোল। এটা অবশ্যই পরিষ্কার হতে হবে।
২. মাটি।
৩. এক্টিভেটেড চারকোল, এটা পানি পরিশোধন করে এবং ফাঙ্গাল ইনফেকশন তৈরি করতে দেয় না।
৪. ছোট ছোট গাছ, যা অতিরিক্ত বড় হয় না এবং যা কন্টেইনারের মধ্যে জীবিত থাকবে।
৫. মস বা ফার্ণ, সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে।
৬. সাজানোর জন্য নুড়ি পাথর, সিরামিক এর কোন ছোট ছোট আইটেম যা টেরারিয়ামকে আকর্ষনীয় করে তোলে।
৭. টুইজারস, পাথর কিংবা গাছগুলো ঠিক মতো বসানোর জন্য। 

Sources : Pexel.com

কীভাবে তৈরি করবেন

প্রথমেই একটা পরিমিত মাপের জার বা বয়াম বা যে কোন স্বচ্ছ আধার নিন, সেটা কে ভালো করে পরিষ্কার ও শুষ্ক করে নিন। জার শুকালে প্রথমে শুষ্ক আর পরিষ্কার স্টোন লেয়ার দিন, না দিলেও চলে। তবে দিলে এটা পানি ফিল্টার করতে সাযায্য করবে। এর পর ঘন করে এক্টিভেটেড চারকোলের একটা স্তর দিতে হবে। 

এটার ঘনত্ব তুলনামূলক বেশি হলে ভালো হবে। এরপরে মাটির স্তর দেয়া প্রয়োজন। মাটি এমন ভাবে দেয়া প্রয়োজন যাতে, জারের অর্ধেক পূর্ণ হয়ে যায়। 

Sources : Pexel.com

অতিরিক্ত সারের দরকার সেভাবে পরে না। মাটির স্তরের পর টুইজারের সাহায্যে এখন প্রয়োজনীয় গাছ, কাঠের টুকরো, নুড়ি বা যা যা দিতে চান। সব কিছু দেবার পরে হালকা পানি স্প্রে করে দিবেন।

এরপর জারের মুখ বেশ শক্ত করে আটকে দিতে হবে যাতে বাইরে থেকে পানি-বাতাস বা অন্য কিছু প্রবেশ করে ফাঙ্গাল ইনফেকশন এর সৃষ্টি না করে। প্রতি সপ্তাহে একবার জারের মধ্যে পানি স্প্রে করে দিতে হবে।  

Sources : Pexel.com

টেরারিয়ামের জন্য কী কী গাছ দরকার

সাধারনত যে গাছগুলো ধীরে ধীরে বড় হয় সেগুলোই এই বদ্ধ কাঁচের বয়ামে চাষ করা হয়। ফার্ণ, মস, এয়ারপ্ল্যান্টস, সাকুলেন্ট, ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপ্স, সানড্যু প্লান্টস, পিচার প্ল্যান্টস, ক্ষুদ্রাকৃতি কিছু উদ্ভিদ, পেপারোমিয়া ইত্যাদি চাষ করা হয়। 

টেরারিয়ামের উপকারিতা

আজকাল শহরে বারান্দা কিংবা ছাদ পাওয়া যায় না, আর গেলেও সখের বাগানের জায়গা হয় না সেখানে। কেউ ইন্ডোর প্লান্ট লাগান, তবুও মনের মধ্যে খুঁত খুঁত করে। এই ছোট্ট কাঁচের জারে আপনি রঙ্গে বেরঙে ফুল-পাতায় সাজাতে পারবেন। 

জায়গার সংকুলান করা কঠিন কিছু না এই জারের জন্য, রাখতে পারবেন ঘরের যে কোন স্থানে। অতিরিক্ত যত্ন নেবার দরকার পরে না, নিয়ম করে পানির স্প্রে করা লাগে। এতে করে ব্যস্ত জীবন থেকেও খুব যে বেশি সময় দেয়া লাগবে সেটাও না। 

Sources : Pexel.com

যেসব গাছের সখ আছে আপনার কিন্তু অতিরিক্ত রোদের জন্য লাগাতে পারেন না কিংবা অতিরিক্ত বাতাসে গাছ ভালো মত বেড়ে ওঠে না। সেই গাছগুলো বদ্ধ জারে লাগাতেই পারেন।  অন্যদিকে টেরারিয়াম এর পরিচর্যায় কিন্তু সেরকম অতিরিক্ত কোন খরচ হয় না, আবার যত্নের জন্য বেশি অর্থ ব্যয় হয়না বললেই চলে। 

শুধু নিজের ঘরের সৌন্দর্য বাড়াবে তাই নয়, উপহার হিসেবেও চমৎকার এই ছোট্ট বাগানটি। ঘরে বসেই যেমন বানিয়ে নিতে পারবেন, তেমনি অনেকে এই টেরারিয়াম বিক্রিও করে।  টেরারিয়াম, ঘরের মধ্যে, টেবিলে, যে কোন স্থানে রাখতে পারবেন। এতে আপনার জায়গা-সময়-অর্থ সব অপচয় যেমন রোধ হবে, তেমনি এক টুকরো বাগান আপনার মন ভালো করে দেবে।

 

 

Image sources: pexel.com 
Sources: 

01. ultimate-guide-to-terrariums. 
02. mini-garden. 
03. what-is-a-terrarium. 
04. terrarium. 
05. the-history-of-the-terrarium