এরিয়া ৫১-পৃথিবীর সবচেয়ে গোপনীয় অঞ্চল

318
0
Source: Travel Nevada

আমেরিকার নেভাডা অঙ্গরাজ্যের মরুভূমির ধুলে ভরা এক সড়ক রয়েছে, যেটি শেষ হয় একটি বড় দরজায় গিয়ে। এই বড় প্রবেশদ্বারের ভেতরে কি হয়, তা আজ পর্যন্ত কেউ স্বচক্ষে দেখেনি এবং নিশ্চিত কোন তথ্যও প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। তবে উক্ত অঞ্চলের প্রতিটি অংশেই আমেরিকার মিলিটারির ক্যামেরা উপস্থিত। শুধু তাই নয় এর পাহাড়ের চূড়ায় একটি পিক আপ ট্রাক দেখা যায় যার ভেতর থেকে সবকিছুই নজরে রাখা হচ্ছে।

বলছি আমেরিকার উচ্চতর নিরাপত্তাবিশিষ্ট এলাকা নেভাডার দক্ষিণাঞ্চলে এবং লাস ভেগাস থেকে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গোপনীয় স্থান এরিয়া-৫১ এর কথা। আজকের আলোচনা এই রহস্যেভরা এলাকাটিকে নিয়েই।

Area 51 events in Nevada prompt emergency crowd planning | AP News
এরিয়া ৫১ এর প্রবেশদ্বার Source: AP News

বলা হয়ে থাকে এরিয়া-৫১ হলো আমেরিকার অ্যাডভান্স এয়ারফোর্স দ্বারা গঠিত দূরবর্তী বিচ্ছিন্ন (Remote Detached) বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন একটি সামরিক ঘাঁটি। আনুষ্ঠানিকভাবে এটিকে হোমি এয়ারপোর্ট বলা হয়ে থাকে। তবে এর মধ্যে কি হয়?

অনেক তত্ত্ব, এলিয়েন কন্সপাইরেসি ইঙ্গিত করে। বলা হয়ে থাকে, আমেরিকান সরকার এরিয়া-৫১কে ভিনগ্রহের প্রাণি তথা এলিয়েন সম্পর্কিত গবেষণার জন্য ব্যবহার করে থাকে।

এরই প্রেক্ষিতে, উক্ত অঞ্চলের অনেকেই সেখানে ভিনগ্রহের এয়ারক্রাফট ‘ইউএফও’ দেখার দাবি করেন। তবে এসব তত্ত্ব কিংবা মিথ থেকে সরে গিয়ে এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, এরিয়া-৫১ আসলেই আছে এবং এটি এখনো সচল।

Area51
হোমি এয়ারপোর্ট Source: Wired

পূর্বে এর অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় থাকলেও আজকাল গুগলের স্যাটেলাইট ছবি থেকে এর অবস্থান নিশ্চিত বলে মেনে নেওয়া হয়। কিন্ত আমেরিকা সরকার এরিয়া-৫১কে কেনই বা জনসম্মুখে তুলে আনতে চায় না? প্রশ্ন রয়েই যায়।

এলিয়েন কন্সপাইরেসি

১৯৪৭ সালে নিউ মেক্সিকোর রসওয়েলে একটি আকাশযান বিধ্বস্ত হয়েছিল। কেউ বলেন, উক্ত আকাশযানটি একটি এলিয়েন স্পেসক্রাফট অর্থাৎ ইউএফও (Unidentified Flying Object-UFO) ছিল। আর এই বিধ্বস্ত হওয়া এলিয়েন এয়ারক্রাফট নিয়ে আমেরিকান সরকার এরিয়া-৫১ এ গবেষণা করছে বলে তারা ধারণা করেন।

Exclusive Area 51 Pictures: Secret Plane Crash Revealed
এরিয়া ৫১ এ বিধ্বস্ত এক বিমান Source: National Geographic

যদিও এর প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকান কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে, সেটি কোন এলিয়েন স্পেস ক্রাফট ছিল না বরং সেটি ছিল একটি ‘উইপন বেলুন’ (Weapon Baloon)। তারা সরাসরি ঘোষণা দেন যে, এর সাথে এলিয়েন স্পেস ক্রাফটের কোন সম্পর্ক নেই।

এর বাইরে আরেক পক্ষ দাবি করে যে, উক্ত আকাশযানটি কোন এলিয়েন স্পেস ক্রাফট নয় বরং আমেরিকান সেনাবাহিনীর টপ সিক্রেট বেলুন ক্রাফট ছিল। যেটি দ্বারা তারা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের উপর নজরদারি করছিল। উল্লেখ্য, এটিও আমেরিকান সরকার নাকচ করে দেয়।

This Is Not an Invasion of the Aliens”: How UFO Mania Went Mainstream | Vanity Fair
ইউএফও Source: Vanity Fair

কন্সপাইরেসি থিওরিস্টদের মতে, উক্ত ইউএফওটি এখনো এরিয়া-৫১ এ আছে। মূলত সরকারের গবেষক দল উচ্চতর ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক এলিয়েন স্পেস ক্রাফট-এর টেকনোলজি ও এর কৌশল সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন। শুধু তাই নয়, আমেরিকান সেনার এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন যে, রসওয়েলে বিধ্বস্ত হওয়া ইউএফও নিয়ে তিনি কাজ করেছে।

অপরদিকে, ১৯৮৯ সালে বব লাজার নামের এক ব্যক্তি লাসভেগাসের এক টিভি চ্যানেলে দাবি করেন যে, তিনিও এলিয়েন টেকনোলজি নিয়ে এরিয়া-৫১ এ কাজ করেছেন। লাজার উল্লেখ করেন যে, ঐ সময় তিনি এলিয়েনের মেডিকেল ফটোগ্রাফ দেখেছেন; এছাড়াও উক্ত এলাকার মানুষও দাবি করেছেন যে তারা ইউএফও দেখেছেন।

UAP EP 29: Whistleblower's part 1 – The Story of Bob Lazar – 850 WFTL
বব লাজার Source: 850 WFTL

রহস্যের উৎপত্তি

সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, আমেরিকান সরকার এরিয়া -৫১ নিয়ে এত কন্সপাইরেসি থাকা সত্ত্বেও সোজাসাপটা প্রতিক্রিয়া কখনোই দেখায়নি। পরবর্তীতে জানা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ু যুদ্ধের সময় রাশিয়ার তথা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য এই এলাকা প্রতিষ্ঠা করে।

২০০৫ সালে সিআইএ–এর কাছে ‘ফ্রিডম অফ ইনফরমেশন অ্যাক্ট’ অনুযায়ী রিপোর্ট চাওয়া হয়। পরে ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো এরিয়া-৫১ নিয়ে ডিক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস (Declassified Documents) প্রকাশ করে বিষয়টি স্বীকার করে যে তারা এরিয়া-৫১ কে মিলিটারি ঘাঁটি হিসেবেই তৈরি করেছিল।

Freedom of Information Act (FOIA) | City of Urbana
Source” City of Urbana

উক্ত রিপোর্টে বলা হয়, ইউ-২ ( U-2), এ-১২ অক্সকার্ট (A-12 OXCART) নামক দুটো এরিয়াল সার্ভেলেন্স প্রোগ্রামের উন্নয়ন এবং এর পরীক্ষণের জন্য এরিয়া-৫১ কে বেছে নেওয়া হয়েছিল।

আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ আরো বলে যে, এরিয়া-৫১ শুধুমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তথ্য লুকানোর জন্যই তৈরি করা, এলিয়েন বা অন্যকিছুর জন্য নয়।

৪০৭ পৃষ্ঠার এই ডকুমেন্টে বলা হয় যে, ১৯৫০ এর দশকে উত্তর-দক্ষিণ কোরিয়া যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন উত্তর কোরিয়াকে সমর্থন দেয় তখনই আমেরিকা বুঝে যায় যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকান পলিসির বিরুদ্ধে গিয়ে পৃথিবীতে আক্রমণাত্নক প্রভাব চালাবে। তাই আমেরিকান সরকার, সোভিয়েত টেকনোলজি এবং তাদের হঠাৎ আক্রমণ করার ক্ষমতা নিয়ে চিন্তিত ছিল।

Korean War - Causes, Timeline & Veterans - HISTORY
কোরিয়ান যুদ্ধের একটি চিত্র Source: History.com

এমতাবস্থায়, আমেরিকান নেভি ও বিমান বাহিনী একটি প্রাথমিক নিরীক্ষণ ভিত্তিক মিশন চালায়। তারা সোভিয়েত আকাশে ‘লো ফ্লাইয়িং এয়ারক্রাফট’ পাঠায়। যেহেতু উক্ত এয়ারক্রাফটটি অল্প উচ্চতায় উঠতে পারতো তাই আমেরিকানরা ধরেই নিয়েছিল যে, সোভিয়েত মিলিটারি এধরণের বিমান খুব সহজেই বিধ্বস্ত করতে পারবে।

তাই ১৯৫৪ সালের নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার নতুন এক প্রজেক্ট হাতে নেন। যার নাম দেন ইউ-২ (U-2)। এর পরীক্ষণ এবং উন্নয়নের জন্য এক নির্জন এলাকার দরকার ছিল যেটি জনসাধারণ এবং সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি থেকে দূরে থাকবে।

Lockheed U-2 - Wikipedia
ইউ-২ আকাশযান Source: Wikipedia

এর কারণেই গ্রুম লেকের এই এরিয়া-৫১ এলাকাটিকে বেছে নেওয়া হয়। যদিও এই অঞ্চলটিকে আমেরিকান কর্প্স দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহার করেছিল। ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের এই এলাকা নিয়ে সিআইএ- এর রিপোর্ট অনেক মানুষের প্রশ্নের জবাব দিয়েছে আবার অনেকের দেয়নি।

প্রথমত, কেন এর নাম এরিয়া -৫১? বলা হয়ে থাকে, ‘অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন নাম্বারিং গ্রিড’ (American Energy Commission Numbering Grid) থেকে নামটি নেওয়া। কিন্ত এরিয়া-৫১ তো এই সিস্টেমের অন্তর্গত নয়। তাহলে কেন এই নাম?

United States Atomic Energy Commission - Wikipedia
“এটমিক এনার্জি কমিশন নাম্বারিং গ্রিড” Source: Wikipedia

সিআইএ-এর দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে, ১৯৫৫ সালের ইউএফও ছিল সেই ইউ-২ বিমান। এটি সিঙ্গেল ইঞ্জিনের এক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জেট বিমান ছিল যেটিকে আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা ও বিমানবাহিনী ব্যবহার করতো সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর অনেক উচ্চতা থেকে নজরদারি রাখার জন্য।

জানা যায় যে, তৎকালীন যাত্রীবাহী বিমানগুলো ১০ থেকে ২০ হাজার ফিট উপরে উঠতে পারলেও ইউ-২ ৪০ হাজার ফিট উচ্চতায় উড়তো। এজন্য কমার্শিয়াল বিমানের পাইলটরা নেভাডার উক্ত অঞ্চলে বিমান উড্ডয়নের সময় উপরে অপরিচিত এয়ারক্রাফটের রিপোর্ট দিতো যাকে তখন ইউএফও নামে চালিয়ে দেওয়া হতো।

U-2 High-Altitude Reconnaissance Aircraft, United States of America
ইউ-২ এর অধিক উচ্চতায় গমন Source: Airforce Technology

আর আমেরিকান সরকার উক্ত গুজবের সুযোগ নিয়েছিল বটে, সবাই যেন এলাকাটিকে এলিয়েন সম্পর্কিতভাবে তার জন্য ইউএফও অফিসও তৈরি করে। কারণ এর প্রতিক্রিয়া দেখালে হয়তো তাদের গোপন গবেষণা ব্যাহত হতো।

বর্তমানেও এরিয়া-৫১ এ কাজ চলছে, তবে এখন আর ইউ-২ নয়, বরং এফ-১১৭এ, ট্যাসিট ব্লু নামক অত্যাধুনিক আকাশযানের পরীক্ষণ হচ্ছে।

Northrop Tacit Blue > National Museum of the United States Air Force™ > Display
ট্যাসিট ব্লু Source: Airforce Museum

এর বাইরে যদিও এখনো কন্সপাইরেসি তত্ত্ববিদগণ দাবি করেন যে, সিআইএ-এর রিপোর্ট ‘আইওয়াশ’ ছাড়া কিছু নয়। যার উদাহরণ আমেরিকান টিভি সিরিজ এবং এক্স ফ্লাইস নামক সিনেমাগুলোতে উঠে আসে।

 

Feature Image: Travel Nevada 
References: 

01. Story Behind the Myth of Area 51. 
02. What is Area 51. 
03. Area 51: What is it and what goes on there? 
04. Where is Area 51?