১৮৯১ থেকে ১৯১৬, এই সময়ে পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘতম রেলওয়ে তথা ‘দ্যা গ্রেট সাইবেরিয়ান রেলওয়ে’ নির্মিত হয়। ভুল বললাম? না, ঠিকই বলছি। আপনি যে রেলওয়ের কথা ভাবছেন সে রেলওয়ের কথাই বলছি। রাশিয়ার দেয়া আদি নামের চেয়ে বরং সাইবেরিয়ার উপর দিয়ে যাওয়া এই রেলওয়ে পশ্চিমা বিশ্বের দেয়া নামেই অধিক পরিচিত হয়। ‘ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে’ নামেই আমরা একে চিনি। বিশ্বের দীর্ঘতম এই রেলওয়ে রাশিয়ার মস্কোর যারোস্লাভস্কি থেকে ভ্লাডিভস্টক পর্যন্ত ৫৭৭৬ মাইল পথ অতিক্রম করেছে!
নান কারণে বিতর্কিত হয়েও ভীষণ প্রতিকূল পরিবেশ ও বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে এই বিখ্যাত রেলওয়ের কাজ চলে দীর্ঘ পঁচিশ বছর। সমসাময়িক সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই রেলওয়ে নির্মাণে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার খরচ হয় যা মূল্যস্ফীতি তুলনা করলে বর্তমান সময়ে অনেক বেশি হবে। এই রেলওয়ের পেছনে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয় তা তৎকালীন রাশিয়ার মোট জাতীয় বাজেটের এক পঞ্চমাংশের সমান ছিল। উপরন্তু, ব্যয়বহুল এই রেলওয়ে আদৌ ভবিষ্যতে কোনো উপকারে আসবে কিনা, এর কাজই বা সম্পূর্ণ করা সম্ভব হবে কিনা, এসব বিষয়েও তৈরি হয় অনেক বিতর্ক। কিন্তু সকল বিতর্ক পাশ কাটিয়ে নিজের গন্তব্যে ঠিক পৌছে যায় ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে। কীভাবে? সেই ইতিহাসই আজ দেখবো চলুন।
রাশিয়ায় রেলওয়ের শুরু
পৃথিবীর ষষ্ঠ দেশ হিসেবে রাশিয়ায় রেলওয়ের প্রচলন হয় ১৮৩৬ সালে। ২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই রেললাইন নির্মাণ করা হয় সম্রাট প্রথম নিকোলাসের বাড়ি থেকে এবং শেষ হয় প্যাভলভস্কে গিয়ে। এই রেললাইনই তৎকালীন জারসকোভ তথা বর্তমান পুশকিনের সাথে সেন্ট পিটারসবার্গের যোগাযোগ সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে সম্রাটের আদেশে ১৮৪২ সালে সেন্ট পিটারসবার্গ রেলওয়ে স্টেশনের কাজ শুরু হয় এবং একই সাথে সেন্ট পিটারসবার্গের সাথে মস্কোর যোগাযোগের জন্য রেলওয়ে নির্মাণ শুরু হয়।
তৎকালীন সবচেয়ে বিখ্যাত দুজন আর্কিটেক্ট কনস্টানটিন টন এবং রুডলফ ঝেলিয়াজেভিখ স্টেশনের নকশা প্রণয়ন করেন। এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৮৫২ সালে। ১৮৫৬ সালে সম্রাট প্রথম নিকোলাসে মৃত্যুর পর এর নামকরণ করা হয় ‘নিকোলেভ রেলওয়ে’। সেই থেকেই শুরু রাশিয়ায় রেলওয়ের সম্প্রসারণ। ৮০’র দশকে রেলওয়ের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। আর তখনই একটি ট্রান্স সাইবেরিয়া রেলওয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে যা কিনা রাশিয়ার একটি বিশাল অংশকে সংযুক্ত করবে।
পরিকল্পনা
পুরো রাশিয়া জুড়ে রেলওয়ের ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণের ভিত্তিতে মন্ত্রীসভা ১৮৯১ সালে একটি ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের পরিকল্পনা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন দেয়। প্রতিকূল আবহাওয়া ও বিপজ্জনক পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এই রেলওয়ে নির্মাণ প্রকল্পকে তিনটি ভাগে ভাগ করে শেষ করার পরিকল্পনা করা হয়। সময় ধরা হয় ১০ বছর। ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা আর প্রত্যাশা নিয়ে সেবছরই মে মাসে কাজ শুরু হয় এই বিখ্যাত রেলওয়ের। ভ্লাডিভস্টক এবং চেলিয়াবিংক্স থেকে একযোগে কাজ শুরু করা হয় যেন মাঝপথে এসে মিলিত হওয়া যায়। চলুন ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের নির্মাণ কাজের তিনটি ধাপ সংক্ষেপে দেখে নেয়া যাক।
প্রথম ধাপ
জার নিকোলাস আলেক্সান্দ্রোভিচ উদ্বোধন করেন ‘দ্য গ্রেট সাইবেরিয়ান রেলওয়ে’র নির্মাণ কাজ। ১৮৯১ সালের মে মাসে এর প্রথম ধাপের কাজ শুরু হয় ভ্লাডিভস্টক থেকে। প্রায় ৪০৮ কিলোমিটার দূরের গ্রাফসকায়া স্টেশনকে যুক্ত করা হয় ভ্লাডিভস্টকের সাথে। কাজ দ্রুত শেষ হয়ে গেলে ১৮৯৭ সালেই রেল যোগাযোগ শুরু হয় এই অংশে। যুগপৎ চলতে থাকে চেলিয়াবিংক্স থেকে ওব নদী পর্যন্ত ১৪১৮ কিলোমিটার রেললাইন বসানোর কাজও। এরপরই শুরু হয় ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের একেবারে মধ্যাংশের কাজ। ওব নদী থেকে ইরকুটস্ক পর্যন্ত ১৮৭১ কিলোমিটার রেললাইন বসানোর মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রথম ধাপের নির্মাণ কাজ। এই অংশের কাজ শেষ হয় ১৮৯৯ সালে।
দ্বিতীয় ধাপ
দ্বিতীয় ধাপটিই সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন ধাপ ছিল নির্মাণকারীদের জন্য। মাইসোভায়া স্টেশন থেকে শুরু করে বৈকাল হ্রদের পূর্ব উপকূল ধরে শিল্কা নদী পর্যন্ত ১১০৪ কিলোমিটার রেলওয়ে সংযোজন করতে গিয়ে প্রকৃতির কাছে চরম পরীক্ষাই দিতে হয় নির্মাণ শ্রমিকদের। এরপর শিল্কা নদী পেরিয়ে খাবারোভস্ক পর্যন্ত আরো ৩৬১ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের পরই শেষ হয় দ্বিতীয় ধাপের কাজ।
তৃতীয় ধাপ
সবচেয়ে অসমতল অংশের কাজটিই রেখে দেয়া হয়েছিল তৃতীয় ধাপের জন্য। সমতল রুটগুলোর কাজ শেষে তৃতীয় ধাপে বাকি ছিল কেবল মাঝের বন্ধুর রুটগুলোতে রেললাইন বসিয়ে সেগুলোর সংযোজন করা। প্রথমেই বৈকাল স্টেশন থেকে মাইসোভায়া স্টেশন পর্যন্ত ২৬১ কিলোমিটার রেললাইন বসানোর কাজ শেষ করা হয়। এরপর শুরু হয় ম্যারাথন অংশের কাজ। স্ত্রেতেংক্স থেকে খাবারোভস্ক পর্যন্ত ২১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ আমুর রেলওয়ে নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল ৬ বছর।
এই আমুর রেলওয়েই ইউরোপের সাথে প্রশান্ত মহাসাগরের যোগাযোগ স্থাপন করে। তবে বৈরী আবহাওয়া এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে প্রাথমিকভাবে আমুর রেলওয়ের রুট পরিবর্তন করে চীনের মাঞ্চুরীয়ার উপর দিয়ে নেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ইরকুটস্ক থেকে খাবারোভস্ক পর্যন্ত অংশটি সম্পূর্ণভাবে রাশিয়ার মধ্য দিয়ে নির্মাণ করা হয়।
প্রধান তিনটি রুট
- প্রধান ট্রান্স সাইবেরিয়ান রুটঃ মস্কো- ভ্লাডিভস্টক
- ট্রান্স মঙ্গোলিয়ান রুটঃ মস্কো-উলান বাটার
- ট্রান্স মাঞ্চুরিয়ান রুটঃ মস্কো-বেইজিং
যেভাবে গড়ে উঠলো দীর্ঘতম এই রেলওয়ে
ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে নির্মাণকালীন কখনো কখনো একই সময়ে কাজ করা শ্রমিকের সংখ্যা এক লক্ষও ছাড়িয়েছে! কাজ যত এগিয়েছে, শ্রমিকের প্রয়োজন তত বেড়েছে এবং একই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রাশিয়া ও সাইবেরিয়ায় প্রবেশ করা শরণার্থী সংখ্যাও। এসব দরিদ্র শরণার্থীরাই ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ অংশের কাজে শ্রম দিয়েছিল। কেননা এই রেলওয়ে নির্মাণে একটি বড় সমস্যাই ছিল ভৌগোলিকভাবে বৈরী স্থানগুলোতে কাজ করার জন্য শ্রমিক নিয়োগ করা। এসব শ্রমিকের অধিকাংশই ছিল কৃষক, দিনমজুর, কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত সাজাপ্রাপ্ত আসামী।
ভ্লাডিভস্টক থেকে যখন ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের কাজ শুরু হয় তখন মোট কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল সর্বসাকুল্যে ৯৬০০ এর মতো। কিন্তু সংখ্যাটা কাজের পরিমাণের সাথে সাথে বাড়তে থাকে দ্রুত। ১৮৯৬ সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৮৪ হাজার থেকে ১ লক্ষ ১০ হাজারে! অন্যদিকে নির্মাণের শেষের দিকে যখন আমুর রেলওয়ে নির্মাণের কাজ শুরু হয় তখন শ্রমিক সংখ্যা মাত্র ২০ হাজারে নেমে আসে। মজার ব্যাপার হলো, ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়েতে হাজতি আসামীদের কাজে লাগানোর মাধ্যমেই রাশিয়ায় শুরু হয় নির্বাসন ও সশ্রম দণ্ডবিধির মতো বিষয়গুলো।
টাইগা (একপ্রকার পাইন গাছের ঘন বন যা জলাভূমিতে সৃষ্টি হয়), বৈরী আবহাওয়া, তুষারপাত, হিমাংকের নিচে তাপমাত্রা, পাহাড়-পর্বত, বড় বড় নদী, বৈকালের মতো হ্রদসহ আরো অসংখ্য বাধা পেরিয়ে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের কাজ যে গতিতে এগিয়েছিল তা অভাবনীয়। এতো জটিলতার পরও বছরে প্রায় ৭৪০ কিলোমিটার রেললাইন বসানো হতো যা আজকের আধুনিক প্রযুক্তির বিশ্বেও বিস্ময়কর। অন্যদিকে রাশিয়ার বিশাল বিশাল নদীগুলোর উপর দিয়ে তৈরি করা এক একটি ব্রিজ এই রেলওয়েকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। সারা বিশ্ব তখন রাশিয়ান প্রকৌশলীদের সাফল্যে মুগ্ধ হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ আমুর নদীর উপর দিয়ে ৬৪ মিটার উচু ও ২.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ খাবারোভস্ক সেতুটি তো বিশ্বে ‘আমুর মিরাকল’ নামেই পরিচিতি পায়। শুধু এই একটি ব্রিজ তৈরি করতেই খরচ হয়েছিল ১৩.৫ মিলিয়ন রুবল! উচ্চাভিলাষী এই প্রকল্পের আরো অনেক ব্যয়বহুল স্থাপনার মধ্যে একটি ছিল স্লুদিয়াঙ্কা স্টেশন-১ যা ছিল সমসাময়িক বিশ্বে সম্পূর্ণ মার্বেল পাথরে তৈরি প্রথম ও দীর্ঘদিন যাবত একমাত্র রেলওয়ে স্টেশন।
ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে সম্পর্কিত বিস্ময়কর কিছু উপাত্ত
- ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের মূল রুটের দৈর্ঘ্য ৯২৮৮ কিলোমিটার।
- দীর্ঘতম ব্রিজ খাভারোভস্ক ব্রিজ, ২.৬ কিলোমিটার।
- এই রেলওয়ে দুটি মহাদেশের উপর দিয়ে গেছে, এশিয়া ৮১ ভাগ ও ইউরোপ ১৯ ভাগ।
- মস্কো থেকে ভ্লাডিভস্টক পর্যন্ত ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়েতে ভ্রমণকালে আপনি ১০টি টাইম জোন এর উপর দিয়ে যাবেন!
- এই রেলওয়ে মোট ৮৭টি শহরের উপর দিয়ে মস্কো থেকে ভ্লাডিভস্টক গিয়ে পৌঁছায়।
- ভোলগা, ওকা, ওব,আমুরের মতো ১৬টি বড় বড় নদী উপর দিয়ে তৈরি হয়েছে এই সুবৃহৎ রেলওয়ে।
- জাপান সমুদ্রতট বরাবর ৩৯ কিলোমিটার এবং সার্কাম-বৈকাল রেলওয়ে বৈকাল হ্রদের তট বরাবর প্রায় ২০৭ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে যা ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের শোভা বর্ধন করে।
- পুরো ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়েজুড়ে শীতকালীন গড় তাপমাত্রা থাকে -২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস!
ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের বর্তমান
২০০১ সালে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের ১০০ বছর পূর্তি উদযাপিত হয়। একইসাথে রাশিয়ান সরকার ২০০১ সালকে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের পুনর্জন্মের সময় ঘোষণা করে ও এর ব্যাপক সংস্কার কাজ শুরু করে। বর্তমানে এই রেলওয়ের দৈর্ঘ্য ১০ হাজার কিলোমিটারেরও অধিক এবং প্রস্তাবনা অনুযায়ী তা আরো বাড়বে। বিগত বছরগুলোতে রাশিয়ায় পরিবহণের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই রেলওয়ে। কিছু পরিসংখ্যান দিলেই পাঠকের বিষয়টি অনুধাবন করতে সুবিধা হবে। বর্তমানে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে দিয়ে বছরে ২ লক্ষাধিক কন্টেইনার পরিবাহিত হচ্ছে যা রাশিয়ার মোট কন্টেইনার পরিবহণের ৩০ শতাংশ! যেখানে মস্কো থেকে বেইজিংয়ে পণ্য পরিবহণে সময় লাগে ২৫ দিন, সেখানে ট্রান্স মঙ্গোলিয়ান রুটে সময় লাগে মাত্র ১৫ দিন। ফলে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে পণ্য পরিবহণে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে।
দৈর্ঘ্য, নির্মাণ জটিলতা, নির্মাণ ব্যয়, প্রকৌশল বিদ্যার অবিশ্বাস্য সাফল্য ও কৃতিত্ব, সব মিলিয়ে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে পৃথিবীতে মানুষের প্রচেষ্টা ও উদ্যমের এক অনন্য নিদর্শন হয়ে থাকবে। বিশ্বের বুকে রেলওয়ের আধুনিকায়নে এই রেলওয়ের অবদান অনস্বীকার্য।