যদি কয়েক বছর পেছনে ফিরে যাওয়া যায় তাহলে আমরা সবার আগে নস্টালজিক যে ব্যাপারগুলো ছিল তা হাতড়ে বের করতে চেষ্টা করবো। মনে আছে স্কুল জীবনে টিভিতে বা কম্পিউটারে বসে অ্যানিমেশনে ডুবে থাকার কথা? অসংখ্য অ্যানিমেশনের ভীড়ে আমাদের শৈশবটা যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। অ্যানিমেশনের জগতে ডুবে থাকাটা তখন মন্দ ছিল না!
পৃথিবীতে প্রায় হাজার হাজার অ্যানিমেশনের ভীড়ে জাপানিজ অ্যানিমেশন বা অ্যানিমে ছিল পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। এই জাপানিজ অ্যানিমেশন শৈশবকে এমন এক দ্বারে নিয়ে গিয়েছিল যেখানে নিজের কল্পনা জগতকেও হার মানাতে বাধ্য হয়েছিল। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘জিবলি’।
স্টুডিও জিবলির ইতিহাস কিন্তু আজকালের না! এর প্রকাশ ঘটে জাপানিজ এক বিখ্যাত স্বপ্নবাজ তরুণের হাত ধরে যার নাম হায়াও মিয়াজাকি। ১৯৮৫ সাল নাগাদ প্রথম এর অভিষেক ঘটে। এছাড়া এর পেছনে বিরাট অবদান ছিল তাকাহাতা ইসাও-এরও। আজ জানবো স্টুডিও জিবলির এত বিখ্যাত হওয়ার পেছনে গল্প, এর মুভি নিয়ে খুঁটিনাটি এবং আরও অনেক অজানা তথ্য।
প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্প
Nausicaä of the Valley of the Wind এর সাফল্যের পর দুই বন্ধু হায়াও এবং ইসাও পরিকল্পনা করলেন যে তাদের ভিন্নধর্মী কিছু শুরু করা দরকার। সেই চিন্তা থেকেই তারা বেছে নিলেন তারা তাদের অ্যানিমেশন জগতকেই পুরো পাল্টে দিবেন। হায়াকো ছিলেন জাপানিজ সিনেমা পরিচালক।
ইসাও তার দীর্ঘদিনের চেনা বন্ধু ও একই সাথে কলিগ হওয়ার দরুন একে অপরের এই চিন্তাকে প্রসারিত করতে শুরু করে। আর সেই চিন্তা থেকে ১৯৮৫ সালের ১৫ জুন নির্মাণ করলেন পৃথিবীখ্যাত এক জগত যার নাম জিবলি। এই নামটি নেয়া হয় মূলত ২য় বিশ্বযুদ্ধে ইতালিতে ব্যবহৃত বিমান Caproni ca. 309 Ghibli থেকে।
জাপানি এই অ্যানিমেশন গুলো আর কেবল জাপানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র বিশ্বে। জিবলি নামকরণে অনেকেই হয়তো জানেন না এর অর্থ আসলে কি! এই ছোট শব্দটি আসলে আরবী ভাষা যার অর্থ দাঁড়ায় মরুভূমির গরম বাতাস।
আর এই অদ্ভুত অর্থের সাথে তারা এই নামটি রাখেন কেননা তারা চাচ্ছিলেনই নতুন এক জগতের মাধ্যমে অ্যানিমি জগতকে বাতাসে উড়িয়ে দিতে। আর সেই থেকে কেবল শুরু, এরপর জাপানিদের এই অ্যানিমেশন জগতকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি! রাজ করে চলেছে সমগ্র বিশ্বে।
জাপানিরা তাদের আর্ট সবসময়ই অন্যান্য দেশের আর্ট থেকে নিজেদের এগিয়ে রেখেছিলেন। তাদের বিভিন্ন আর্ট, অ্যানিমেশন অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ সুগঠিত এবং চমৎকার ছিল। যদিও এর পূর্ণ রূপ দিতে পারেননি তৎকালীন অ্যানিমেশন মেকাররা! তারা তাদের আর্ট হিসেবে হাইকু তথা কবিতাকেও আর্ট বলেই আখ্যায়িত করতো।
জাপানিজ অ্যানিমেশনগুলো চলে এসেছিল ভিন্ন মাত্রায়, ভিন্ন গতিতে। এই জাপানিজ অ্যানিমেশনগুলোর বেশ পরিচিত নাম হচ্ছে অ্যানিমে। এখন কেবল জাপানে নয়, পুরো বিশ্বে চোখ বন্ধ করে এদের ভক্ত বলা যেতে পারে। এই অ্যানিমেগুলোর পথচলা শুরু হয় সাধারণত নব্বই দশকের দিকে। আর এরপর একের পর এক সিনেমা মুক্তির পর এই জগতকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আর আজকের এই বহুল জনপ্রিয় জিবলির পেছনে সবচেয়ে বেশি যার নাম উচ্চারিত হয় তার নাম হচ্ছে হায়াও।
মূলত তিনিই জাপানিজ অ্যানিমেশন জগতে বেশ বড় ধরণের এক পরিবর্তন নিয়ে আসে। জাপানিরা তাদের এই অ্যানিমেশনের জগতকে তাদের সংস্কৃতি বলেই জানতো। আর সেই সংস্কৃতির নাম ছিল ‘ওটাকু’। এই ওটাকু বর্তমানে বেশ বিখ্যাত হলে কি হবে, একে নিয়ে পূর্বে বেশ ভালোই ব্যাঙ্গাত্মক শব্দ ছুড়ে বসতেন সাধারণ জনগণেরা।
তাদের মতে, এটি ছিল নিন্মমানের সংস্কৃতি যা তাদের দেশের সাথে যায় না। আর এই ভাবনাকেই মূলত মরুভূমির বাতাসের মতো উড়িয়ে দিতে সক্ষম হোন হায়াও মিয়াজাকি।
জিবলির সৃষ্টি
১৯৮৬ সালে হায়াওর হাতে প্রথম মুক্তি পায় ‘ক্যাসেল ইন দ্য স্কাই’। এই জিবলি মুক্তি পাওয়ার পরে বেশ ভালো সাড়া পাওয়া যায়। সিনেমাটি একটি অ্যাডভেঞ্চারধর্মী, যাতে দেখা যায় এক সরকারি এজেন্ট দ্বারা শিতলা নামের এক অনাথ মেয়েকে অপহরণ করা হয়। আর সেই মেয়েকে যে জাহাজে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তাতে আক্রমণ করা হয়।
এক সময় মেয়েটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে পানিতে পড়ে গেলে পাজু নামের এক অনাথ ছেলে তাকে উদ্ধার করে। উদ্ধারের পর ছেলেটি তাকে এক খনির শহরে নিয়ে যায়, এবং সেখানে উদ্ধারকৃত মেয়েটিকে এক ছবি বের করে দেখায়। ছবিটি মূলত তার প্রয়াত বাবার তোলা। আর এরপর সেখানে ঘটতে থাকে নানান অ্যাডভেঞ্চারে জড়ানো কাহিনী।
ক্যাসেল ইন দ্য স্কাই মুক্তির দুই বছর পর একাধারে মুক্তি পায় ‘গ্রেভ অফ দ্যা ফায়ারফ্লাইস’ এবং ‘মাই নেইবার তোতোরো’। ক্যাসেল ইন দ্যা স্কাই মুক্তির পর তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও এই দুটি সিনেমা সবার মন জয় করতে বাধ্য করেছিল এবং হায়াও বুঝতে পেরেছিলেন এই জগতে ব্যাঙ্গাত্মক কথার শেষ হতে চলেছে।
গ্রেভ অফ দ্যা ফায়ারফ্লাইস একটি ট্রাজেডিক ঘরানার সিনেমা, যাতে দেখা যায় এক যুদ্ধে পুরো পরিবার হারানোর পর ছোট্ট বোন তার ভাইয়ের সাথে এক নিরাপরদ, অস্বাস্থ্যকর জায়গায় আশ্রয় নেয়।
দীর্ঘদিন পুষ্টিকর খাবার না খেয়ে মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং এক সময় নিস্তেজ হয়ে যায়। এই সিনেমা দেখে মন খারাপ হয়নি এমন মানুষ পাওয়া বিরল!
এরপরই মুক্তি পায় জিবলি জগতের চমৎকার সিনেমা ‘মাই নেইবার তোতোরো’। সিনেমাটি একটি ভৌতিক ঘরানার হলেও এর চমৎকার কাজ শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্ত বয়স্কদেরও পছন্দের শীর্ষে স্থান করে নেয়।
১৯৮৯ সালে যখন ‘কিকিস ডেলিভারি সার্ভিস’ মুক্তি পায় তখন থেকেই জিবলি স্টুডিও সবার নজরে আসতে শুরু করে। তবে এই সিনেমার প্রচার করা হয় টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে।
স্টুডিও জিবলি এভাবেই অনেকদিন চলতে থাকে। কিন্তু একসময় এসে ঝিমিয়ে পড়ে স্টুডিও জিবলির পথ। এই জগতের সবকিছু যেন থমকে গিয়েছিল চোখের পলকেই! আর তাই এর প্রতিষ্ঠাতা হায়াও ২০০১ সালে ফিরে আসেন নতুন উদ্যমে।
চমৎকার এক সিনেমা স্পিরিটেড এওয়ে মুক্তির পর বেশ আলোড়ন ঘটে জিবলি জগতে। সারা বিশ্ব তথা আন্তর্জাতিক ভাবেই হায়াও আলোচিত হয়ে উঠেন।
স্পিরিটেড এওয়ে মুক্তির পর আমেরিকাতে এই সিনেমা মুক্তি দেয়া হয়। তবে এই সিনেমা আমেরিকাতে এমনি এমনি মুক্তি পায়নি! হায়াওকে চুক্তিতে বসতে হয়েছিল ডিজনি ও চিফ ক্রিয়েটিভ অফিসার জন ল্যাস্টারের সাথে।
আর তার এই চুক্তি, আমেরিকাতে সিনেমা মুক্তি পাওয়া এসবই তাকে নিয়ে গিয়েছিল সফলতার চরম শিখরে। এটি এতটাই জনপ্রিয়তা পায় তখন যে, এই সিনেমাটি পরবর্তীতে মিয়াজাকিকে অস্কার জিততে এগিয়ে নিয়ে যায়।
সিনেমাটি মূলত এক মেয়েকে নিয়ে রচিত। যেখানে দেখা যায় তার মা-বাবার সাথে ঘুরতে যাওয়ার সময় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এক অশরীরী জগতে প্রবেশ করে ফেলে মেয়েটি। সেই সময় তার আটকে রাখা বাবা মা এবং নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে তাকে বেশ ভারী রকমের ঝামেলায় পড়তে হয়। এই সিনেমাটিতে মিউজিকেরও বেশ ভালো ব্যবহার করা হয়েছে। অত্যন্ত সুমধুর গান, মিউজিক ইত্যাদি দিয়ে সাজানো এই সিনেমাতে ডুবে যেতে বাধ্য হবে যে কেউ!
যে পথ ধরে দীর্ঘকাল হেঁটে গিয়েছেন মিয়াজাকি আর তার অ্যানিমেশন জগত, সেই পথ থেকে কখনো সরে আসেননি মিয়াজাকি। সাফল্যের ধরা দিত থাকা এই ব্যক্তি চাননি তার অ্যানিমেশনের জগতটি ছেড়ে অন্য কোন জগতে প্রবেশ করা। সারা বিশ্বে প্রায় সবকিছুই পরিবর্তিত হলেও জিবলি চলছে তার নিজ গতিধারায়। এই জগতের কিংবা অ্যানিমেশন প্রেমীদের কাছে জিবলি একটি আবেগের জায়গায়ই থাকবে চিরকাল!
Feature Image: imdb.com Reference: 01. Studio Ghibli. 02. History of Studio Ghibli.