বর্তমান যুগে বিষণ্নতা সকল রোগকে ছাড়িয়ে গেছে আর এই রোগে মোটামুটি সকলেই বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মরাই বেশি ভুগছে। একজন মানুষ আর্থিক, সামাজিক সকল ক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে থাকতে পারেন কিন্তু বিষণ্নতা তাকে এতটা খারাপ পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে পারে যার কারণে সে আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিতেও বাধ্য হয়! বিষণ্নতা ব্যক্তির স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনা, স্বাস্থ্য, কাজ ও জীবনের আরো ক্ষেত্রকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
এই বিষণ্নতা থেকে বাঁচতে মানুষ অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস ঔষুধ সেবন করে। ২০১৫ – ২০১৮ এই সময়ের মধ্যে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী আমেরিকানদের ১৩.৩% গত ৩০ দিনে এন্টিডিপ্রেসেন্ট ঔষুধ গ্রহণ করেছে। যার মধ্যে পুরুষদের চেয়ে মহিলার বেশি গ্রহণ করেছেন যা রিপোর্টে উঠে এসেছে। বয়স ও সময়ের সাথে সাথে এই এন্টিডিপ্রেসড ঔষুধ গ্রহণের পরিমাণও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বিষণ্নতা দূর করার জন্য অনেক ধরণের কাউন্সিলিং ব্যবস্থা রয়েছে অথবা ডাক্তারের শরনাপন্ন হলেও এই সমস্যার সমাধান মেলে কিন্তু প্রাকৃতিক কিছু উপায়ের মাধ্যমেও আপনি বিষণ্নতার লক্ষণ চিহ্ণিত করে তা থেকে বের হয়ে আসতে পারেন ফলে সুস্থ জীবনে প্রবেশ আপনার জন্য সহজ হবে। যে পদ্ধতি বা উপায়গুলোর আপনার জন্য কার্যকরী হবে যুগের এই মহামারী থেকে বের হওয়ার জন্য সেগুলো আমি ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করলাম।
আনন্দ দেয় এমন কিছু করা শুরু করুন
যা করতে আপনি ভালোবাসেন তা করুন, এটি সবচেয়ে সহজ উপায় বিষণ্নতা থেকে নিজেকে দূরে রাখার। যেসব জিনিস আপনাকে প্রফুল্ল করে, আপনার মনোযোগ ধরে রাখে সেই জিনিস ও বিষয় প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় হলেও করার চেষ্টা করুন। আমরা যখন উৎফুল্ল থাকার মতো কোন জিনিস করি তখন আমাদের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর এই নিয়ন্ত্রিত প্রভাব আপনার বিষণ্নতাকে নেভিগেট করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
নেতিবাচক চিন্তাকে “না” বলুন
আমাদের জীবন নেতিবাচক চিন্তায় ভরপুর আর নেতিবাচক চিন্তাই মানুষিক অশান্তির মূল কারণ। তাই হতাশার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে আপনাকে আপনার মানসিক চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করতে হবে। একজন ব্যক্তি যখন হতাশ হন, তখন তিনি সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে থাকেন। আর এই সিদ্ধান্তের ফলাফলই ব্যক্তিকে বিষণ্নতার দিকে নিয়ে যায়।
হতে পারে আপনি কোন কাজ ভালোভাবে করতে পারছেন না, আর এর জন্য আপনাকে হয়তো অনেক অকাট্য কথাও শুনতে হতে পারে যা আপনাকে হতাশায় নিমজ্জ্বিত করে পরবর্তীতে।
একটি কাজ আপনি এখন করতে পারছেন না তার মানে এই না যে আপনি তা একেবারেই করতেই পারবেন না। নিজের মাথা থেকে নেগেটিভ চিন্তা বাদ দিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করুন।
কারণ একটি পজিটিভ বা ইতিবাচক চিন্তা আপনার অসম্ভব কাজকেও কতটা কষ্টসহিষ্ণু করে দেয় তা আপনার কল্পনার বাইরে।
শারীরিক কসরত
শারীরিক কসরত বা ব্যায়াম এক অভাবনীয় নিয়ামক একজন মানুষের বিষণ্নতা দূর করার জন্য।
বিষণ্নতা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, নিয়মিত ব্যায়াম ঔষুধের মতো কাজ করে যার ফলে হালকা থেকে মাঝারি ধরণের বিষণ্নতা দূর করা সম্ভব।
ব্যায়ামের ফলে এন্ডোরফিন নামক হরমোন মস্তিষ্ক থেকে নিঃসৃত হয় যা একজন ব্যক্তির অস্বাভাবিক মেজাজকে স্বাভাবিক করতে সক্ষম।
আপনি যখন বিষণ্নতায় ভুগছেন তখন নিজের মনকে বুঝিয়ে ব্যায়াম করা চ্যালেঞ্জিং হবে বটে কিন্তু অল্প অল্প করে হলেও শুরু করা উচিত নিজেকে এই খারাপ পরিস্থিতি থেকে বের করে আনার জন্য।
এর জন্য প্রতিদিন একটু হাঁটাহাঁটি করা, হাত-পা ও পুরো শরীরের জন্য কিছু হালাকা ব্যায়াম দিয়ে শুরু করা ভালো হবে।
স্বাস্থ্যকর খাবার
বলা হয়ে থাকে আপনি তাই যা আপনি খান। তাই আপনি যদি বিষণ্নতা থেকে বের হতে চান তাহলে আপনাকে প্রচুর পরিমাণে স্বাস্থ্যকর খাবার এবং অনেক বেশি পরিমাণে পানি পান করতে হবে। যারা বিষণ্নতায় ভোগেন তারা সাধারণত খেতে চান না আবার কারো কারো অতিরিক্ত খাওয়ার বাতিক থাকে। কিন্তু কম বা বেশি যাই খান না কেন খেয়াল রাখুন তা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকারী।
যথাসম্ভব ফল-মূল, শাকসবজি এবং শস্য জাতীয় খাবার খান। স্বাভাবিক অবস্থায়ই একজন মানুষের নিজের স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত কিন্তু বিষণ্ন অবস্থায় তা আরো জোড়ালো হওয়া উচিত। বিষণ্ন অবস্থায় যে ধরণের খাবার গ্রহণ করবেন আর যা করবেন না তা হলো-
- কার্বোহাইড্রেট এবং চিনি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন যেমন: জাঙ্ক ফুড ও ডেজার্ট।
- নিজেকে লম্বা সময় ধরে ক্ষুধার্থ রাখবেন না।
- সঠিক সময়ে ক্ষুধা না লাগলেও হালকা ও স্বাস্থ্যকর কিছু খেয়ে নিন।
- নিজেকে সব সময় হাইড্রেট রাখুন। হাইড্রেট থাকতে সব সময় একটি পানির বোতল সাথে রাখুন।
- চিনি এবং ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলুন।
হাসি
মস্তিষ্কে ডোপামিনের নিঃসরণ হলে মানুষ অনেকটা হালকা অনুভব করে ও উৎফুল্ল থাকে। আর এই ডোপামিনের নিঃসরণ সবচেয়ে বেশি হয় যখন একজন মানুষ হাসে। নিজের ভিতর উৎফুল্লতা নিয়ে আসতে বিভিন্ন ধরণের ইন্টারেস্টিং বই পড়তে পারেন, অন্যদের সাথে কৌতুক করা, মজার মজার বিষয় নিয়ে চিন্তা করা যার ফলে ডোপামিনের ক্ষরণ হয়ে আপনি প্রফুল্ল্ থাকবেন।
নেশা জাতীয় দ্রব্য থেকে দূরে থাকুন
যারা বিষণ্নতায় ভুগে থাকেন তাদের সাধারণ একটি প্রবণতা হচ্ছে তারা বিভিন্ন ধরণের নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে যেমন: অ্যালকোহল, ড্রাগ, সিগারেট ইত্যাদি। বিষণ্নতা বা হতাশা থেকে বের হতে (যদিও এটি হয় না) অর্থাৎ সাময়িক প্রশান্তির জন্য মানুষ এই ধরণের নেশা দ্রব্য গ্রহণ করে থাকে।
এই ধরণের নেশা জাতীয় দ্রব্য যদি লম্বা সময় ধরে গ্রহণ করতে থাকেন তাহলে তা আপনার মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজ করার পদ্ধতিকে পরিবর্তন করতে পারে ফলে আপনার মানসিক অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাবে। তাই এই ধরণের নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ থেকে একেবারে বিরত থাকা উচিত।
পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম
বিষণ্নতা বিষয়ক একটি আর্টিকেল থেকে জানা গেছে যে, বিষণ্নতা এবং অনিদ্রার মধ্যে একটি শক্তিশালী যোগসূত্র রয়েছে। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব হতাশার লক্ষণগুলিকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং এটি একটি সাধারণ উপসর্গ। তাই নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম অপরিহার্য। নিম্নোক্ত টিপসগুলোর মাধ্যমে আপনি আপনার ঘুমকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারবেন।
- প্রতিদিন একই সময়ে বিছানায় যান এবং একই সময়ে ঘুম থেকে উঠুন।
- যে ঘরে ঘুমাচ্ছেন সেটি শান্ত, অন্ধকার ও তার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কিনা সেটি নিশ্চিত করুন।
- ঘুমানোর আগে ভারী খাবার গ্রহণ না করুন, পাশাপাশি ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন।
- দিনের শুরুতে ব্যায়াম করুন।
- ঘুমানোর জায়গা থেকে ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বিশেষ করে ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি অন্ত্যত 30 মিনিট আগে বন্ধ করে সরিয়ে রাখুন।
- শোয়ার সময় একটি বই পড়তে শুরু করতে পারেন এতে বিক্ষিপ্ততা দূর হবে ও খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে পারবেন।
বর্তমান পৃথিবীর মানুষের কাছে এক আতঙ্কের নাম এই “ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা” জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে মানুষ এই সমস্যাটি ফেইস করে। কিন্তু সঠিকভাবে এটি মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে অনেকে জীবনের আসল খেই হারিয়ে আরো বেশি হতাশায় নিমজ্জ্বিত হয়।
প্রাত্যহিক জীবনের সমস্যা থেকেই হতাশার জন্ম কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে সমস্যা জীবনের এক অংশ এর জন্য পুরো জীবন নষ্ট করার কোন মানে হয় না। তাই বিষণ্নতাকে আপনি না বলতে পারেন উপরে উল্লেখিত কিছু চমৎকার পদ্ধতির মাধ্যমে। কিন্তু বিষণ্নতা যদি খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে যায় তাহলে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত চিকিৎসার জন্য।
Feature Image: pinterest.com References: 01. 9-self-help-solutions-for-reducing-symptoms-of-depression. 02. how-to-fight-depression. 03. depression-tips. 04. natural-treatments. 05. What to know about avoiding depression.