নশ্বর এই পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যার রহস্য উদঘাটনে গবেষক,বিজ্ঞানীগণ নানা প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। হয় কিছুর ফলাফল পাওয়া গেছে আবার অনেক ঘটনার কারণ এখনো অজানা। এই অজানা ঘটনা গুলোর উৎস বের করতে গিয়ে বের হয়ে এসেছে নানা তত্ত্ব এবং বিশ্লেষণ।
এমন এক ঘটনা হচ্ছে সাইবেরিয়াতে ঘটে যাওয়া টুংগাসকা নদীর তীরে ঘটে যাওয়া এক রহস্যময় বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণ কেন ঘটেছিল, তা নিয়ে রয়েছে নানা জল্পনা কল্পনা। আজকের আয়োজন টুংগাসকা বিস্ফোরণকে নিয়েই।
১৯০৮ সালের ৩০ শে জুন সকাল ৭ টা ১৫ মিনিটের সময় সাইবেরিয়ার প্রত্যন্ত এক জঙ্গলে এমন এক বিস্ফোরণ ঘটে যেটি পুরো দুনিয়ার কৌতুহলপ্রবণ মানুষকে অবাক করে তোলে। উক্ত বিস্ফোরণের প্রভাব আশেপাশের এক হাজার কিলোমিটার দূরের মানুষও অনুভব করতে পেরেছিল বলে জানা যায়।
প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এই বিস্ফোরণকে অনেকেই টুংগাসকা উল্কাপাতও বলে। বিস্ফোরণের দরুণ একটি সাধারণ চেয়ার এতই গরম হয়ে গিয়েছিল যে সেটিতে বসে থাকা ব্যক্তির চেয়ার থেকে উঠে যেতে হয় বলে জানা যায়। উল্লেখ্য, ব্যক্তিটি বিস্ফোরণের মূল অঞ্চল থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিলেন।
বলা হয়ে থাকে যে, বায়ুমন্ডলীয় এই ঘটনাটি আকাশে সূর্য কিংবা তার চেয়ে বড় আগুনের ন্যায় আকৃতির ছিল যার শব্দ কল্পনাতীত বলা চলে। এটি অনেক শক্তি সঞ্চার করে টুংগাসকা অঞ্চলে বিস্ফোরিত হয়।
এর সিসমিক তথা ভূকম্পনজনিত এবং বায়ুমন্ডলীয় তরঙ্গ সম্পূর্ণ ইউরোপ জুড়ে রেকর্ড করা হয়। উক্ত বিস্ফোরণের পর সকালের আকাশ সাধারণের চেয়ে অতি আলোকিত এবং রাতের আকাশও উজ্জ্বল দেখায় বলে জানা যায়।
এই বিস্ফোরণের অদ্ভুত এক বিষয় হচ্ছে যে, এর কারণে মানবিক কোন বিপর্যয় তথা মানুষের মৃত্যু ঘটেনি। তবে এর ফলাফল সইতে হয়েছে প্রকৃতিকে। দুই হাজার বর্গ কিলোমিটারের জঙ্গল এবং প্রায় ৮০ মিলিয়নের মতো গাছ বিস্ফোরণের জন্য তথা উল্কা পিন্ডের আঘাতে ধবংস হয়। এছাড়াও শত শত বল্গা হরিণেরও মৃত্যু ঘটে।
কেন এই বিস্ফোরণ ঘটলো?
এর উত্তর সমাধানে অনেক প্রয়াস দেখা যায়। তবে বিস্ফোরণের অবস্থানগত সমস্যা অর্থাৎ উক্ত সময়ে সেটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং রুশ বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র হওয়া এবং খারাপ আবহাওয়ার দরুণ তৎক্ষণাৎ বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়নি। তবে এটাকে খবরের কাগজগুলোতে আগ্নেয়গিরি অগ্নুৎপাত বলেও আখ্যা দিতে দেখা যায়।
পরে এই কান্ড ঘটার উৎস বের করতে লিওনিড কুলিক পদক্ষেপ নেন। রাশিয়ান এই খনিজবিদ্যাবিদ ১৯২৭ সালে প্রায় বিশ বছর পরেও অনুসন্ধানে গিয়ে বিস্ফোরণের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে পান। ১৯২১ সালেও তিনি এই অনুসন্ধান করতে চাইলেও খারাপ আবহাওয়ার জন্য তা ভেস্তে যায়।
সে যাইহোক, তিনি সেখানে গিয়ে টপোগ্রাফিক অনুসন্ধান চালান এবং ধবংস হওয়া গাছগুলোর চিত্র তুলেন। সেখনে লক্ষ্য করেন যে গাছগুলোর প্রধান শাখা এবং বাকল ছিল না।
হিরোসিমাতে হওয়া পারমাণবিক আক্রমণেও ঠিক এমন অবস্থার গাছ পাওয়া গিয়েছিল। তাই অনেকেই এটাকে পারমাণবিক বিস্ফোরণ বলেও ধারণা করেন। যদিও কুলিক উক্ত অঞ্চলে অনেক ব্যক্তির থেকে তথ্য নেন। তথ্যগুলো থেকে তেমন কোন ফলাফলে আসা যায়নি।
এর পাশাপাশি পূর্বে থেকেই আলোচনায় ছিল যে এটা একটি উল্কার প্রভাব। তবে কুলিক সেখানে কোন বড় গর্ত কিংবা উল্কার চিহ্ন পাননি।
কোন নির্দিষ্ট কারণ না পাওয়ার প্রেক্ষিতে অনেক তত্ত্বই বের হতে থাকে। যেমন কেউ বলে যে একটি ছোট প্রতিবস্তু বা এন্টিম্যাটার বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে এবং পদার্থের সাথে সংঘর্ষ করে বলেই এই বিস্ফোরণ। আবার ঐ বিস্ফোরণ ছোট একটি কৃষ্ণগহ্বর গঠনের কারণে হয়েছে বলে ধারণা করে। অন্যান্যরা তো পুরো ঘটনাকে ভিনগ্রহের প্রাণীদের কৃতকর্ম বলেও চালিয়ে দেয়।
সম্প্রতি ফ্রান্সের একজন লেখক জুলস ভার্ন (Jules Verne) তার বই “জার্নি ট্যু দা সেন্টার অফ দি আর্থ” গ্রন্থের ভার্নশটস থিওরিতে অনুমান করে বলেন যে বিস্ফোরণের কারণ ভূগর্ভ থেকে বিস্ফোরিত হওয়া একটি ম্যাগমা (অনুমানকৃত) গ্যাসের সংমিশ্রণ।
সায়েন্টিফিক রিসার্চ পাবলিশিং নামক এক জার্নালে চীনা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক নতুন এক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। তিনি গ্রহাণু শিলার নিউক্লীয় (Rockburst Plus Nuclear Explosoion) বিস্ফোরণের কারণে উক্ত ঘটনা ঘটেছে বলে তার রিসার্চ পেপারে দাবী করেন। অর্থাৎ টুংগাসকা বিস্ফোরণ একটি থার্মো নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ যা গ্রহাণু বায়ুমন্ডলে প্রবেশের পর শিলা (rockburst) দ্বারা হয়েছিল।
এই শিলা বিস্ফোরণ তখনই ঘটে যখন হঠাৎ করে শক্তিশালী এক শক্তির চাপ বের হয় যেটা পরমাণুর সম্প্রসারণে হয়ে থাকে। অর্থাৎ এটি এমন ঘটনা যেটি শিলার স্থিতিস্থাপক বিকৃতির কারণে সম্ভাব্য শক্তি জমা হয় এবং হঠাৎ একটি নির্দিষ্ট ও প্রচন্ড শক্তি বের হয়। গভীর কূপ খনিতে নিরাপত্তা বিপত্তির জন্য এই শিলা বিস্ফোরণ অন্যতম ভূমিকা রাখে।
এই শিলা বিস্ফোরণ কয়ে মাস ধরেও ঘটতে পারে। সায়েন্স রিসার্চ অনুযায়ী এই তীব্র শিলা বিস্ফোরণের কারণে ৭ থেকে ৮ ডিগ্রীর তাপমাত্রার সাথে ৪.৬ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটতে পারে। এর ফলে বিকট শব্দ ঘটে এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা তো রয়েছেই।
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা শিলা বিস্ফোরণের এই শক্তির কারণ সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে পারে না। ফলস্বরুপ, শিলা বিস্ফোরণ প্রক্রিয়ার অনুসন্ধান বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এই গবেষণায় আরো বলা হয় যে , মহাজাগতিক এই সম্প্রসারণ হলো পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক টেকটোনিক আন্দোলনের শক্তির উৎস। আর এই শিলা বিস্ফোরণ প্রায় একই ধরণের গ্রহগত ভূতাত্ত্বিক টেকটোনিক আন্দোলন যা একটি প্রাকৃতিক বিষয়।
এরকম ঘটনা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায়নি। কিন্ত ২০১৩ সালে রাশিয়ার আকাশে আবার এক ধরণের উল্কাপিন্ড দেখা যায়। এটাকে চেলিয়াবিনস্ক উল্কা বলা হয়। এই ঘটনায় প্রায় এক হাজার মানুষ আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
পঞ্চাশ ফুটের এই গ্রহাণুটি সেই এলাকার বাড়িগুলোর জানালা ভেঙ্গে ফেললেও টুংগাসকার মতো বিরাট ধবংসযজ্ঞ চালায়নি। চেলিয়াবিনস্কের এই ঘটনা প্রতি ১০ থেকে ১০০ বছর পর পর হতে পারে । কিন্ত বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, টুংগাসকার মতো উল্কাপাত প্রতি ৩০০ বছরে ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
নাসার গবেষক লোরেন হুইলারের মতে, খুব অল্প সংখ্যক উল্কাপাত হওয়ার দরুণ এর পর্যবেক্ষণও কম হয়েছে। এর ফলে বায়ুমন্ডলে কিভাবে গ্রহাণুগুলো ভেঙ্গে যায় এবং তারা মাটিকে কতটা ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে সে সম্পর্কে অনেক অনিশ্চয়তা রয়ে গিয়েছে। তবে,কম্পিউটেশনাল মডেলের দ্রুত অগ্রগতির জন্য চেলিয়াবিনস্ক, টুংগাসকা এবং অন্যান্য ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে এর কারণ গুলো উদঘাটন করা ভবিষ্যতে সম্ভব হবে।
যদিও এখনো অনেকেই এই বিস্ফোরণকে ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব দিয়ে প্রমাণ করতে চান এবং সাইবেরিয়ার সেই অংশে লোক মুখে নানা কথাই ভেসে বেড়ায়।
তবে এই ধরণের ঘটনার রহস্য উদঘাটন হোক বা না হোক, তাঙ্গাস্কার উক্ত বিস্ফোরণ যদি কোন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সংঘটিত হতো তাহলে মানব মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অন্যান্য যেকোন বিস্ফোরণের চেয়ে অধিক হতো বলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
Feature Image: wonderopolis References: 01. An explosion that rocked the world. 02. Solving the Mystery of the Tunguska Explosion. 03. Siberia. 04. Tunguska Event: Violent Detonation Over Siberia 1908.