মাউন্ট এভারেস্ট বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, এই নামটি শুনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শুভ্র সাদা তুষারে ঢাকা পর্বত শৃঙ্গটি পৃথিবীর বুকে সগৌরবে টিকে আছে। আশ্চর্যজনক এই মাউন্ট এভারেস্টকে আপনার অনেক দূর দেখতে মনে হবে ঠিক যেন একটি ফাঁকা ক্যনভাস। আর তাই পর্বতটির রহস্যঘেরা সৌন্দর্য যা সবাইকে আকৃষ্ট করে।
আকাশের সাথে মিতালী করা মাউন্ট এভারেস্ট জয় করা কোনো সহজ বিষয় নয়। এর সর্বোচ্চ চূড়ায় পা রাখতে হলে একজন পর্বতারোহীকে নিতে হয় অনেক বড় চ্যালেঞ্জ সাথে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা। কারণ এই বিখ্যাত পর্বতটি জয় করতে হলে একজন পর্বতারোহীকে দুঃসাহসিকতা সাথে সব ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে।
যদিও এর উচ্চতা, তুষারপাত, এবং অন্যান্য কঠিন বিপদের কারণে এর চূড়ায় পৌঁছানো একজন পর্বত আরোহীর জন্য একটি কঠিন সিদ্ধান্ত। তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছে হাজার হাজার মানুষ। কারণ এই রহস্যময় পর্বতটি জয় করা একজন পর্বতারোহীর কাছে সারা জীবনের জন্য স্বপ্নের মতো।
আর যুগের পর যুগ বহু চেষ্টার পর ১৯৫৩ সালে মানুষ প্রথম মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছায়। এরই ধারাবাহিকতায় মাউন্ট এভারেস্ট আরোহণের ধারাবাহিকতা নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। দিনে দিনে মানুষ এভারেস্ট এ আরোহনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। চলুন পৃথিবীর এই সর্বোচ্চ চূড়ার বিচিত্রতাপূর্ণ সম্পর্কে জানতে এই লেখাটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিই।
মাউন্ট এভারেস্ট কোথায় অবস্থিত?
মাউন্ট এভারেস্ট আবার কারো কারো কাছে হিমালয় নামে পরিচিত। আর এই হিমালয় কোন নির্দিষ্ট উঁচু পর্বত নয় বরং ছোট ছোট অনেকগুলো নির্দিষ্ট হিম অঞ্চল নিয়ে গঠিত মাউন্ট এভারেস্ট।
বিশ্বের এই সর্বোচ্চ পর্বতটি নেপাল ও চীনের সীমান্তবর্তী এলাকায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এর দুই দিকে নেপাল ও চীনের সীমান্ত এলাকায়, আর অন্য দিকে তিব্বতের সীমানা অবস্থিত।
এই বিখ্যাত পর্বতটি আবার নেপালি ভাষায় সাগরমাথা এবং তিব্বতি ভাষায় চোমোলুংমা নামে পরিচিত। মাউন্ট এভারেস্ট আরোহণের প্রধান দুইটি পথ রয়েছে। যেমন আরোহনকারীরা নেপাল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব পর্বতশৃঙ্গ এবং তিব্বত থেকে উত্তর পর্বতশৃঙ্গ দিয়ে যাত্রা শুরু করতে পারেব। উত্তরদিকে রয়েছে রিজ ছোট,আর বেশিরভাগ পর্বতারোহীরা হেটেঁ দক্ষিণ-পূর্ব রিজটি ব্যবহার করে কারণ এদিকে প্রযুক্তির সহায়তায় পৌছানো কিছুটা সহজ। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ফটোগ্রাফার কোরি রিচার্ডস বলেছেন-
এটি এখনো আগের মতোই উচ্চ, ঠান্ডা এবং শক্তিশালী। ভ্রমণকারীরা এই পর্বত আরোহণ করতে শৃজনশীলতা এবং তাদের দক্ষতার পরিচয় দেয়। তিনি আর বলেন, যেকোনো কিছুর কাছে যাওয়ার জন্য সবসময়ই একটি নতুন উপায় থাকে এবং এভারেস্ট তার থেকে ব্যতিক্রম নয়।
মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা কত?
নিঃসন্দেহে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত উঁচু পর্বতশৃঙ্গ যার উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৯,০৩২ ফুট উচ্চতায় পৌঁছেছে মাউন্ট এভারেস্ট এর চূড়া। যদি ও ব্যাপক তুষারের তারতম্য, মাধ্যাকর্ষণ বিচ্যুতি এবং আলোর প্রতিসরণ ও অন্যান্য কারণের মাউন্ট এভারেস্টের সঠিক উচ্চতা নিয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে।
২০২০ সালে চীন এবং নেপাল যৌথভাবে মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ২৯.০৩১,৬৮ ফুট (৮,৮৪৮,৮৬মিটার) ঘোষণা করেছিল, যা পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।
প্রথম অভিযানসমূহ
মাউন্ট এভারেস্টের রহস্যময়ীতার কারনে মানুষ এর পেছনে ছুটে চলে। আর এ জন্য গন্তব্য যত দূর্গমই হোক এর রহস্যভেদ করা যেন কারো কারো কাছে নেশার মতো। ১৮৫৫ সালে আলপাইন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন টমাস ডেন্ট নিজের লিখা প্রকাশিত বইয়ে ঘোষনা দেন দূর্গম মাউন্ট এভারেস্ট পর্বতে আরোহন করা সম্ভব।
দুঃখের বিষয় হলো নেপালে সেই সময় বিদেশীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। আর তাই ব্রিটিশরা তিব্বতের দিক থেকে এই পর্বতের উত্তর শৈলশিরা ধরে বেশ কয়েকবার আরোহণের চেষ্টা চালিয়ে যান।
এরপর আবারও ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ আরোহীরা তিব্বতের দিকে প্রায় ৭ হাজার মিটার পর্যন্ত ওঠতে সক্ষম হন। এর ঠিক এক বছর পর ১৯২২ জর্জ ফিঞ্চ এভারেস্টে পা রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।
পরবর্তীতে ম্যালোরি এবং কর্নেল ফেলিক্সও দ্বিতীয়বারের মতো ব্যর্থ অভিযান করেন। আর তখন বৈরি আবহাওয়ার কবলে পড়ে নেমে আসার পথে সাতজন মালবহনকারী তুষার ঝড়ের কবলে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন।
অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, সময়টা ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে-র সকালে তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারি প্রথমবারের মত পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ করতে সক্ষম হন। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে কে আগে চূড়ায় পা রেখেছিলেন। তবে এটা সত্যি তারা দুইজনই ইতিহাসে এক নতুন কীর্তি স্থাপন করেন যা ছিল এক অসাধ্য সাধনার ফলাফল। সারা পৃথিবীতে তাদের নিয়ে আলোড়ন শুরু হয়।
এভারেস্টের বয়স
বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন ভূতাত্ত্বিক মান অনুসারে এভারেস্টের বয়স ৫০ থেকে ৬০ মিলিয়ন বছর। ভারতীয় এবং ইউরেশিয়ান টেকটোনিক প্লেটগুলির সংঘর্ষের ফলে উর্ধ্বমুখী শক্তি দ্বারা পর্বতটি তৈরি হয়েছিল। যার ফলে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত গঠনকারী শিলাগুলিকে ঠেলে দেয়। এছাড়াও বিজ্ঞানিদের ধারণা সেই শক্তি আজও কাজ করছে।
এভারেস্টের পথপ্রদর্শক কারা?
এভারেস্টের পথপ্রদর্শক হিসেবে মূলত শেরপারা প্রধান ভূমিকা পালন করে। একজন শেরপার শারীরিকভাবে অসাধারণ সক্ষমতা রয়েছে যে উচ্চতায় বোঝা বহন করে এবং আরোহীকে পথ দেখিয়ে পর্বতশৃঙ্গের চূড়ায় নিয়ে যেতে পারে। শেরপারা মূলত সবাই তিব্বতি। তাদেরকে তিব্বতি উপজাতি অথবা ‘প্রাচ্যের মানুষ’ও বলা হয়।
প্রাকৃতিক ভাবেই শেরপাদের দেহের ফুসফুস স্বাভাবিক ফুসফুসের তুলনায় অনেক বড়। ধারণা করা হয় অক্সিজেন স্বল্প জায়গায় থাকতে থাকতে তাদের দেহ সেইভাবেই তৈরি হয়ে যায়। তাই তারা এভারেস্টের আবহাওয়ার সাথে সহজে মানিয়ে নিতে পারে। আর এজন্য একজন পর্বতারোহীর সবচেয়ে বড় পথ পদর্শক হলো শেরপা।
অপরদিকে, স্থানীয় কোম্পানি নেপাল সরকারের তত্ত্বাবধানে পর্বতারোহীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেয়।এইসব কোম্পানির এভারেস্ট অভিযান একটি বড় ব্যবসা। এখান থেকে তারা প্রযুক্তি, এবং বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত অভিযানের উন্নতির জন্য প্রতি বছর শত শত পর্বতারোহীর অভিযান পরিচালনা করে থাকে।
এছাড়াও নেপালি গাইডদের দ্বারা গড়ে উঠেছে পেশাদার শিল্প। যারা প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময় দড়ি এবং মই দিয়ে পথ প্রস্তুত করার জন্য একসাথে কাজ করে। প্রতিটি শিবিরে তাঁবু, স্টোভ, বোতলজাত অক্সিজেন এবং খাবারের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি মজুত করে এবং তারপর ধৈর্য্যর সাথে আরোহীদের প্রশিক্ষণ দেয়।
একটি অভিযাত্রী দলের তিন থেকে চার মাসের এভারেস্ট অভিযানের জন্য, বেশিরভাগই কোম্পানিগুলোই ২,৫০০ মার্কিন ডলার থেকে ৫,০০০ মার্কিন ডলার-এর মধ্যে উপার্জন করে। একটি অভিযাত্রী দলের দক্ষতার উপর নির্ভর করে ৪০,০০০ মার্কিন ডলার থেকে ১০০,০০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত খরচ হয়৷ ২০১৮ সালের পারমিট ফিতে ৫.২ মার্কিন ডলার মিলিয়ন সংগ্রহ করেছে বলে জানিয়েছে সেখানকার পর্যটনখাত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, খুম্বু ক্লাইম্বিং সেন্টারের মতো শিক্ষাগত সুযোগের তৈরি করে নেপালি গাইডরা আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ এবং সার্টিফিকেট অর্জন করছে।
এভারেস্ট আরোহণকারীর কি কি ঝুঁকি রয়েছে?
২৯,০৩২ ফুট উচ্চতায় এভারেস্টের চূড়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠে বিদ্যমান বায়ুর চাপের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ থাকে, যা একজন পর্বতারোহীর যথেষ্ট শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে দেয়। এই কারণে, বিজ্ঞানীরা নির্ধারণ করেছেন যে মানবদেহ ১৯,০০০ ফুটের উপরে বেশি সময়ের জন্য থাকতে সক্ষম নয়।
সঙ্গতভাবেই, পর্বতারোহীরা পাহাড়ের ওপরে উঠে যাওয়ায় এবং তাদের অক্সিজেন গ্রহণ কমে যায়। তাদের শরীরে পালমোনারি এডিমা, সেরিব্রাল এডিমা এবং রক্তের এম্বোলিজমসহ বেশ কিছু রোগের ঝুঁকি বাড়ছে।
এই এলাকায়, অক্সিজেন এতই সীমিত যে শরীরের কোষগুলি মারা যেতে শুরু করে ।তাই অবশ্যই অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে চূড়ায় উঠতে হয়।এছাড়াও পর্বতারোহীরা হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা গুরুতর উচ্চতার অসুস্থতাও অনুভব করতে পারে।
১৯৯৮ সালে NOVA অভিযানের সদস্য ডেভিড কার্টার PBS-কে বলেছেন ডেথ জোনে আরোহণ করা মানে নরকে প্রবেশ করা, তার ভাষায় এটি “একটি জীবন্ত নরক”। তাই পর্বতারোহীরা চূড়ায় পৌছানের পর ডেথ জোন বা মৃত্যু অঞ্চলে যতটা সম্ভব কম সময় ব্যয় করে।
তবে এভারেস্ট ভ্রমণ দিনে দিনে অনকেটাইয়া নিরাপদ হয়ে উঠছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং বাণিজ্যিক কার্যকলাপের সাথে অনেক বেশি লোকের আরোহণের কারণে এখন অনেকটাই সহজ হচ্ছে। ধারণা করা হয় ১৯২৩ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত ১৭০ জন পর্বতারোহী মারা যায়। কিন্তু ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৭,৯৯০টি সামিট ছিল তবে এতে ১২৩ টি মৃত্যু বা ১.৫ শতাংশ সহ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
মনে রাখতে হবে, মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় সফল ভাবে পদার্পণ করতে একজন পর্বত আরোহীকে নিতে হবে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা। এছাড়াও নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ এবং সাথে অসীম মনোবল। কারণ শক্ত মনোবলের অভাবে তীরে এসে তরী ডুবতে সময় লাগবে না।
Feature Image: unplash.com Sources: 01. Mount Everest. 02. Mount Everest: The deadly history of the world's highest peak. 03. Mount Everest's 'death zone'.
Porea onek valo laglo
Onek kichu janthea parlam