ব্ল্যাক বক্স: কি এবং কিভাবে কাজ করে? 

608
0

বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো দেশে বিমান দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার সাথে সাথেই উদ্ধার তৎপরতার শুরুর পরবর্তী প্রধান কাজটি হয়ে থাকে দুর্ঘটনার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করা। কিন্তু মাটি থেকে হাজার ফিট উপরে, মানুষের নাগালের বাইরে ঘটে যাওয়া যেকোনো ঘটনা-দুর্ঘটনার পেছনের কারণ খুঁজে বের করা কিন্তু মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। সেই প্রয়োজন থেকেই ২য় বিশ্ব যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে উদ্ভাবন করা হয় ‘ব্ল্যাক বক্স’ নামক একটি যন্ত্র।

‘ফ্লাইট ডেটা রেকর্ড’ নামেও পরিচিত ব্ল্যাক বক্স বিমানের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বস্তু, যা কি-না এক কথায় বিমানের সকল তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষিত থাকে। ১৯৪৭ সালে যন্ত্রটির ব্যবহার প্রথম শুরু হলেও ১৯৫৮ সাল থেকে নিরাপত্তা জনিত কারণে বিমানে ‘ব্ল্যাক বক্স’ থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়। বিমানের ধ্বংসস্তুপ থেকে অথবা সমুদ্রের গভীরে নিমজ্জিত বিমানের সংকেত ৯০ দিন পর্যন্ত পাঠানোর ক্ষমতা রাখে এই যন্ত্রটি।

উন্নত প্রযুক্তির জাদুকরী ছোঁয়ার একটি বৈপ্লবিক আবিষ্কার বলা চলে ‘ব্ল্যাক বক্স’ নামক এই বস্তুটিকে। বিমানের সকল তথ্যের সংরক্ষণ এই যন্ত্রটিতে থাকার কারণে যেকোনো বিমান দুর্ঘটনার পর ‘ব্ল্যাক বক্স’ উদ্ধার করার বিষয়টি প্রথমেই চলে আসে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য।

প্রচন্ড মজবুত হয়ে থাকে এই ‘ব্ল্যাক বক্স’ Image Source: cntraveler.com

ব্ল্যাক বক্স কি? 

বিমান উড্ডয়ন থেকে শুরু করে অবতরণ পর্যন্ত সকল ঘটনা বা কার্যাদি রেকর্ড বা সংরক্ষণ করে ব্ল্যাক বক্স নামক এই বস্তুটি। ১৯৫৪ সালের দিকে এটি আবিষ্কৃত হয় অধিক হারে বিমান দুর্ঘটনা রোধ করার উদ্দেশ্যে। ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডিং যার সংক্ষিপ্ত নাম এফডিয়ার এবং ককপিট ভয়েস রেকর্ডিং-এর জন্য ব্যবহৃত রেকর্ডার এর নাম সিভিয়ার মূলত ‘ব্ল্যাক বক্সে’র মধ্যে থাকে।

টাইটেনিয়াম ধাতু দিয়ে তৈরি এবং অন্য একটি টাইটেনিয়াম এর তৈরি বাক্সের ভেতর এটি সংরক্ষিত থাকে। প্রত্যেক বিমানে সাধারণত দুটি ব্ল্যাক বক্স থাকে। বিমানের সামনের দিকে একটি থাকে অন্যটি বস্তুটির নিরাপত্তার জন্য বিমানের পেছনের দিকে রাখা হয়। তবে নাম ‘ব্ল্যাক বক্স’ হলেও বস্তুটি কিন্তু মোটেও ব্লাক না।

ব্ল্যাক বক্স-এর নাম ‘ব্ল্যাক বক্স’ কেন?

‘ব্ল্যাক বক্স’ এর নাম কিন্তু শুরুর দিকে ‘ব্ল্যাক বক্স’ ছিল না। লাল রঙের বস্তু হওয়ায় এটিকে ‘রেড এগ’ নাম দেওয়া হয়েছিল। তবে, এর ভেতরের রঙ ছিল কালো, আর একারণেই পরবর্তীতে ‘ব্ল্যাক বক্স’ নামকরণ করা হয়। তবে নাম যেটাই হোক না কেন, এখনো কিন্তু ব্ল্যাক বক্সের রঙ উজ্জ্বল কমলা রঙের। উজ্জ্বল কমলা রঙ খুব সহজেই চোখে পড়ে।

বিমান দুর্ঘটনার পর অনুসন্ধানকারী দলে উদ্দ্যেশই থাকে অতিদ্রুত বিমানের ‘ব্লাক বক্স’ উদ্ধার করা Image Source: chinagate.cn

যেকোনো বিমান দুর্ঘটনার পর উদ্ধার কর্মীদের অন্যতম প্রধান কাজ থাকে ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা। কমলা রঙের হওয়ায় ধ্বংসস্তুপের মাঝে খুঁজে পাওয়ার কাজটা অনেকাংশেই সহজ হয়ে যায়।

ব্ল্যাক বক্স কিভাবে কাজ করে?

প্রায় ২৫ ঘন্টার তথ্য রেকর্ড করার মতো স্টোরেজ বা জায়গা থাকে ‘ব্ল্যাক বক্স’-এ। এছাড়াও ভেতরে থাকে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মেমোরি চিপ। বিমান জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় লাগানো থাকে সেন্সর যা বিমানের সার্বিক পরিবেশ এবং পরিস্থিতি অর্থাৎ সময়, গতি, তাপমাত্রা, চাপ ইত্যাদি ফ্লাইট ডাটা অ্যাকুইজিশন ইউনিটে প্রেরণ করে। 

এই সকল তথ্য এবার চলে যায় ব্ল্যাক বক্সে। তবে নির্দিষ্ট সময় পর পর পুরাতন ডাটা বা তথ্যগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে যায় যাতে করে নতুন তথ্য সংগ্রহে জন্য জায়গা পাওয়া যায়।

একটি ব্ল্যাক বক্সে ২ ধরনের তথ্য সংরক্ষণ প্রক্রিয়া হয়ে থাকে।

১. ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার (এফডিআর)

২. ককপিট ভয়েস রেকর্ডার (সিভিআর)

ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার:

যন্ত্রটির ভেতরে থাকা এফডিআর-এর সাহায্যে বিমান সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের তথ্য যেমন এয়ারস্পিড বা বাতাসের গতিবেগ, উচ্চতা, উল্লম্ব ত্বরণ এবং জ্বালানী প্রবাহের মতো জিনিসগুলি রেকর্ড করা হয়ে থাকে। এসকল তথ্য ব্যবহার করে বিমান দুর্ঘটনার কারণ ছাড়াও যেকোনো প্রয়োজনীয় তথ্যাদি অতি সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করা যায়।

ব্লাক বক্সের ভেতরের কাঠামো Image Source: thenews.com

ককপিট ভয়েস রেকর্ডার:

এটিতে মূলত বিমানের পাইলটদের মধ্যে কথাবার্তা, পাইলট এবং যাত্রীদের মধ্যে কথাবার্তা, বিমানবন্দর গুলোর সাথে যে তথ্য বিনিময় হয়েছে সেসব রেকর্ড ইত্যাদি সংরক্ষিত অবস্থায় থাকে। ককপিট ভয়েস রেকর্ডার-এ সর্বশেষ ২ ঘন্টার কথাবার্তা রেকর্ড থাকে।

এফডিআর এবং সিভিআর সমন্বয়ে বিমানের যেকোনো সময়ের সার্বিক পরিস্থিতির একটা স্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায়। বিমান দুর্ঘটনার কারণ এবং দুর্ঘটনার সময়কার ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপাত্ত উদ্ধারকারী দলসহ পরবর্তী সময়ে সঠিক তদন্তের কাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

অস্বাভাবিক রকমের মজবুত এই যন্ত্র ১১ হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস (১১,০০০°c) পর্যন্ত তাপ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে! এছাড়াও ৬ হাজার মিটার সমুদ্রের তলদেশের প্রচন্ড চাপ সহ্যের ক্ষমতা ব্ল্যাক বক্সের রয়েছে। রয়েছে পানি রোধি বিশেষ সেন্সর যা গভীর  সমুদ্রের মাঝেও প্রতি সেকেন্ডে সংকেত পাঠাতে সক্ষম।

যন্ত্রটি নির্বিঘ্নে কাজ করার জন্য জেনারেটর ব্যবহৃত হয় শক্তির উৎস হিসেবে। তবে জেনারেটর ছাড়া অর্থাৎ কোনো রকম বিদ্যুৎ সংযোগ ছাড়াই সর্বোচ্চ ৩০ দিন পর্যন্ত কাজ করতে পারে।

কেন ব্ল্যাক বক্স উড়োজাহাজের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ? 

প্রায় প্রতি বছরই বিশ্বের কোথাও না কোথাও বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় নিরীহ বিমান যাত্রী। ১৯৭৭ সালের ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের বাংলাদেশের ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে হাজার হাজার মানুষ। এসকল দুর্ঘটনা প্রতিহত করা সম্ভব যদি কিনা দুর্ঘটনার কারন খুঁজে বের করা যায়।

বিমান দুর্ঘটনার কারন বের করতে সাহায্য করে ‘ব্লাক বক্স’ Image Source: alarabiya.net

আর ঘটনার পেছনের কারণ অনুসন্ধানের এই কাজটি করে থাকে ব্ল্যাক বক্স। এবং পরবর্তী সতর্কতাই পারে এই ধরনের বিমান দুর্ঘটনার ঝুঁকি হ্রাস করা।

শুধু কি বিমানেই ‘ব্ল্যাক বক্স’ থাকে?

শুধুমাত্র বিমানেই ‘ব্ল্যাক বক্স’ থাকে ব্যাপারটা এমন নয়, যদিও বিমানের সূত্র ধরেই বেশি পরিচিত এটি। তবে অন্য যেকোনো যানবাহন যেমন গাড়িতেও বর্তমান সময়ে ব্যবহৃত হচ্ছে ব্ল্যাক বক্স।

অনেকেই মনে করে থাকেন, সুউচ্চ আকাশে নিয়তির নিষ্ঠুরতার বলি হিসেবে যে সকল বিমান যাত্রীরা মৃত্যুবরণ করেন, প্রিয়জন হারানোর সেই শোকের কালো ছায়ারই প্রতীকী রূপ হিসেবে ‘ব্ল্যাক বক্স’ এর ‘ব্ল্যাক’ অংশটির নামকরণ।

তবে কারণ যাই হোক, ব্ল্যাক বক্সের বদৌলতেই জানা যায় প্রত্যেক বিমান দুর্ঘটনার সুনির্দিষ্ট কারণ। যা নিরীক্ষা করে সচেতন হওয়া যায় আসন্ন আরো একটি বিমান দুর্ঘটনা থেকে, বেঁচে যায় আরো কিছু প্রাণ। স্বজনরা নিরপদে ফেরে স্বজনদের কাছে।

 

Feature Image: pinterest.com 
References: 

01. What is black box how does it work. 
02. Airplane Black Box all you need to know about the device. 
03. Flight data recorder black box.