বিস্তৃত এই পৃথিবীতে বিস্ময়ের অভাব নেই। পাহাড় থেকে শুরু করে সমুদ্র,প্রকৃতির সব উপাদানই যেন প্রতিনিয়ত তাদের চমকপ্রদ খেল দেখিয়ে যাচ্ছে। সেই চমকপ্রদ খেলার অন্যতম একটি হচ্ছে অরোরা বোরিয়ালিস। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি কিংবা কোন চলচ্চিত্রের দৃশ্য, অরোরা বোরিয়ালিসের সেই আলো যেন আমাদের অনেকের মাথায় প্রশ্ন জাগায়।
অনেকে হয়তো উক্ত আলোকে কৃত্রিমও মনে করতে পারেন। তবে সেটি কৃত্রিম কোন ঘটনা নয় বরং প্রকৃতি সৃষ্ট এক অনন্য ঘটনা যা পৃথিবীর উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুতে ঘটতে দেখা যায়। এদেরকে বলা হয় মেরুজ্যোতি। আজকের আয়োজন নর্দান লাইটস অর্থাৎ অরোরা বোরিয়ালিস নিয়ে।
অরোরাকে একটি পোলার লাইট বলা হয় যেটা আকাশে প্রাকৃতিক আলো প্রদর্শন করে। এই প্রদর্শন মূলত উচ্চতর অক্ষাংশ তথা অর্কটিক এবং এন্টার্কটিকাতে দেখা যায়।
এই চিরগতিশীল আলোর অনেক নকশা দেখা যায়। কখনো এটি আলোক পর্দা আবার কখনো একে পেঁচান আলোক রশ্মিও মনে হয়। হাজার বছর ধরে ঘটতে থাকা এই অরোরা বোরিয়ালিসকে নিয়ে নানা মতবাদ দেখা যায়। কখনো এটিকে রহস্যময় শক্তি, কখনো স্বর্গীয় আলো আবার ভাইকিংসরা তো আলোর এই খেলাকে তাদের তাদের ভ্যাল্কিরির অস্ত্র হিসেবেও আখ্যা দিত। তবে অরোরা নামকরণ হয় গ্রীক দেবী অরোরা থেকে।

কোথায় হয়?
বেশিরভাগ অরোরা দেখা যায় একটি নির্দিষ্ট বন্ধনীর মধ্যে। আর এই বন্ধনীকে (Band) অরোরাল জোন বলা হয়ে থাকে যেটি সাধারণত উচ্চতার দিক থেকে ৩ ডিগ্রী থেকে ৬ ডিগ্রী প্রশস্ত এবং জিওমেট্রিক পোল থেলে ১০ থেকে ২০ ডিগ্রী হয়ে থাকে। অরোরা সাধারণত অন্ধকার আকাশে পরিষ্কার দেখা যায়। যেই অংশে এই ঘটনা ঘটে তাকে অরোরাল ওভাল ডাকা হয়।
ইলিয়াস লুমিস,হারমান এবং ট্রমহোল্টের বিশ্লেষণ দ্বারা উক্ত অরোরাল জোনের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। আগেই বলা হয়েছে যে, উত্তরের অরোরাকে অরোরা বোরিয়ালিস এবং দক্ষিণের অংশকে অরোরা অস্ট্রালিস বলা হয়। এগুলো আলাস্কা, কানাডার কিছু প্রদেশ, আইসল্যান্ড ,গ্রীনল্যান্ড ,নরওয়ে,সুইডেন,ফিনল্যান্ড এবং রাশিয়াতে দেখা যায়। তবে মানুষের কাছে নরওয়ের অরোরা বেশি জনপ্রিয়।
এছাড়াও হঠাৎ হঠাৎ আলোর এই খেলা এস্তোনিয়া,লাটভিয়া,ডেনমার্ক এমনকি স্কটল্যান্ডেও দেখা যায়। তবে এর পরিমাণ খুবই ক্ষীণ।
কেন এই অরোরা বোরিয়ালিস?
অরোরা অর্থাৎ অরোরা বোরিয়ালিস কেন হয় তার জন্য সম্পূর্ণ প্রমাণিত ভিত্তি এখনো জানা যায় নি। তবে মৌলিক বিষয়টি হচ্ছে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের সাথে সূর্যের থেকে আসা সৌর ঝড়ের মিথস্ক্রিয়াতে এর সৃষ্টি হয়ে থাকে।
অর্থাৎ যেই আলো দেখা যায় সেটি পৃথিবীতে ঘটা কোন কারণের জন্য হয়ে থাকে না। এর মূল কারণ সূর্যের পৃষ্ঠতলে ঘটতে থাকা কর্মকান্ড। সূর্য থেকে আসা প্রবল সক্রিয় কণাগুলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলকে আঘাত করে যার গতি ঘন্টায় ৪৫ মিলিয়ন মাইল। তবে এই সৌর ঝড় আমাদের পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের জন্য এই দুনিয়াকে আঘাত করতে পারে না।

উক্ত চৌম্বকক্ষেত্র কণাগুলোকে মেরু অংশের দিকে সরিয়ে নেয়। মূলত কণাগুলো যে শুধুমাত্র পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে তা কিন্ত নয়। এটি সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহগুলোতেও অরোরা সৃষ্টি করে। তবে আমাদের এই দুনিয়ার চৌম্বকক্ষেত্র যখন কণাগুলোকে আকর্ষণ করতে তখন সেগুলো আটকে পড়ে এবং সম্পূর্ণ পৃথিবী পরিভ্রমণ করতে থাকে।

উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুর বায়ুমন্ডলের সাথে চৌম্বক রেখা সংযুক্ত। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রত্যেক মেরুর সাথে এই চৌম্বক ও বায়ুমন্ডলের মেলবন্ধন নেই। শুধুমাত্র উত্তর এবং দক্ষিণ দিকের সাথে এর সংযুক্তি থাকার ফলে সূর্যের সেই ঝড় বায়ুমন্ডলের কণাগুলোকে আন্দোলিত করে।এই আন্দোলনের ফলেই সৃষ্টি হয় নানা ধরণের বর্ণ বা রঙ।
অরোরা বোরিয়ালিস কেন সংঘটিত নয় তা বিংশ শতাব্দীর পূর্বে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আলোচনা হয় নি। নরওয়ের বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান বির্কল্যান্ড ( Kristian Brikeland) ই বলেন যে, সূর্য থেকে নিঃসরণ হওয়া ইলেকট্রন বায়ুমন্ডলে এই আলো তৈরি করে।

নর্দান লাইটসের এই উজ্জ্বল রঙ মূলত রাসায়নিক মিশ্রণের ফলে হয়ে থাকে। সব ধরণের অণু এবং পরমাণু তথা হাইড্রোজেন কিংবা কার্বন ডাই অক্সাইড নিজেদের রঙের সাথে বিকিরণ করে।
সূর্য হতে আসা এই সৌর ঝড় প্রতিনিয়তই ঘটে চলছে। হয়তো কখনো এটি অল্প গতিতে হয় অথবা কখনো চরম গতিতে পৌছে যায়। চরম গতিতেই নর্দান লাইটকে সবচেয়ে উজ্জ্বল দেখা যায়। ২০১৪ সালে এই আলোকজ্জ্বল অবস্থা দেখা গিয়েছিল এবং অনুমান করা হয় ২০২৫ সালে আবার তা ঘটবে। উল্লেখ্য, ঝড়ের সম্পূর্ণ চক্র পূর্ণ হতে ১১ বছরের মতো সময় লাগে।
বলা হয়ে থাকে ইলেক্ট্রনের উচ্চতার সাথে কোন পরমাণু সংঘর্ষ করছে তার উপর রঙ নির্ভর করে। ৬০ মাইলের উচ্চতায় নাইট্রোজেনের সংঘর্ষে বেগুনি আভা সৃষ্টি হয়। ৬০ থেকে ৯০ মাইল উচ্চতার এর রঙ হয় নীল, ৯০ থেকে ১৫০ হলে অক্সিজেনের সাথে ইলেক্ট্রনের সংঘর্ষে সবুজ রঙ দেখা যায়। আর এর উপরে তথা ১৫০ মাইলের উপরে সংঘর্ষ হলে নর্দান লাইটস লাল বর্ণের হয়ে থাকে।

নর্দান লাইটস দেখার কিছু সেরা জায়গা
অরোরা বোরিয়ালিসকে স্বচক্ষে দেখতে চাইলে আপনার জন্য রয়েছে অসাধারণ কিছু জায়গা। পূর্বেই বলা হয়েছে নর্দান লাইটস বিশ্বের উত্তর মেরুতে দেখা যায়। এই উত্তর মেরুতেও নির্দিষ্ট কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে এর খুব পরিষ্কার অভিজ্ঞতা নেওয়া যায়।
ফেয়ারব্যাঙ্কস, আলাস্কা
এই অংশটি অরোরার একদম ব্যান্ড বরাবর অবস্থিত। আগস্ট থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত শহরটিতে সবুজ,হলুদ এবং বেগুনি রঙের স্বর্গীয় আভা দেখা যায়। মূলত রাত ১০ টা থেকে ভোর ৩টা পর্যন্ত এই অবস্থা বিরাজ করে।
:max_bytes(150000):strip_icc():format(webp)/fairbanks-alaska-23bc91e78bb8441b943381178798b109.jpg)
স্বালবার্ড, নরওয়ে
নর্দান লাইটস দেখার জন্য নরওয়েতে অনেক জায়গা রয়েছে। স্বালবার্ড এর মধ্যে অন্যতম, কেননা এই অংশটি কন্টিনেন্টাল নরওয়ে এবং উত্তর মেরুর মাঝে অবস্থিত। এটি পৃথিবীর একমাত্র অঞ্চল যেখানে সকাল বেলাও অরোরা দেখা যায়।
:max_bytes(150000):strip_icc():format(webp)/svalbard-norway-northern-lights-NLIGHTS119-8f24b843e23b4f31859162bc150c46db.jpg)
ফিনল্যান্ড
ফিনল্যান্ডে নর্দান লাইটস বছরের ২০০ দিনেরও বেশি সময় ধরে দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই অসম্ভব দৃশ্য দেখার জন্য রিসোর্ট হাউস থেকে শুরু করে নানা পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে।
:max_bytes(150000):strip_icc():format(webp)/kakslauttanen-finland-1d01a7b8a9274803aa93358775b78f35.jpg)
গ্রীনল্যান্ড
অল্প আলোক দূষণ থাকার কারণে গ্রীনল্যান্ডে খুব পরিষ্কারভাবে নর্দান লাইটস উপভোগ করা যায়। এই অংশের রঙকে গ্রীন-মিল্কি লাইটও বলা হয়ে থাকে।
:max_bytes(150000):strip_icc():format(webp)/greenland-f17c76cac9014816a3449d8b252b93d2.jpg)
ইউকন, কানাডা
আগস্ট থেকে এপ্রিলের মাঝামঝি সময় পর্যন্ত কানাডার ইউকন প্রদেশে অরোরা বোরিয়ালিস দেখা যায়। এখানে আলোর দৃশ্যমানতার জন্য সবুজ এবং হলুদ রঙের নিওন শেড (Neon Shade) দেখা যায়।
:max_bytes(150000):strip_icc():format(webp)/yukon-canada-b5bd19e4f0c7434db856e04188c059a9.jpg)
এছাড়াও সুইডেনের ল্যাপল্যান্ডের টর্ন নদী থেকে, আইসল্যান্ডের হোটেল রাঙ্গাতে বসে এমনকি আমেরিকার পেনসেল্ভেনিয়ার চেরি স্প্রিং ষ্টেট পার্ক থেকেও প্রকৃতির এই সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা নেওয়া যায়।
বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম সমস্যা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের দরুণ প্রকৃতির আচরণের ব্যাঘাত ঘটা। এরজন্য অরোরা বোরিয়ালিসেও এর প্রভাব পড়বে কিনা প্রশ্ন উঠে। তবে বলা হচ্ছে যে , অরোরা বোরিয়ালিসের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে না । যদিও আগামীতে পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে অরোরার পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
Feature Image: GoOpti
References: