রেঁনেসা যুগের শিল্পগুলোর মধ্যে সম্ভবত এটিই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য৷ যার পরতে পরতে রয়েছে রেঁনেসা যুগের শিল্পকর্ম, ইতিহাস ও ঐতিহ্য৷ মাইকেলেঞ্জেলোর শৈল্পিক হাতের ছোঁয়ায় প্রতিটি দেয়াল যেন হয়ে উঠেছে জীবন্ত, যেন কানে কানে বলে যায় সেই যুগের কথা৷ বলছিলাম সিস্টিন চ্যাপেলের কথা, যেখানে থাকা চিত্রকর্মে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য৷
সিস্টিন চ্যাপেলের ইতিহাস
সিস্টিন চ্যাপেল পোপদের ব্যক্তিগত চ্যাপেল৷ তবে এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো এখান থেকেই নতুন পোপদের নির্বাচিত করা হতো৷ এই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বলা হয় কনক্লেভ (Conclave)। ল্যাটিন Cum clave থেকে শব্দটি এসেছে যার মানে হলো With a Key. কারণ এখানে কার্ডিনালদের রীতিমতো চ্যাপেলে আটকে রাখা হতো নতুন পোপ নির্বাচন করতে৷ এবং আজও তা চলমান আছে৷ বাইরের জগতের সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই৷ নতুন পোপ সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদেরকে ভোটের পর ভোট দিয়ে যেতে হয়৷
নির্বাচনের সময় চ্যাপেলের ছাদে চিমনি স্থাপন করা হয়৷ যেখান থেকে ধোয়া বের হয় সিগন্যাল হিসেবে৷ যদি সাদা ধোয়া বের হয়, যেটা আসলে ব্যালট পেপার পুড়ানোর মাধ্যমে তৈরী করা হয় তাহলে নতুন পোপ নির্বাচিত হয়েছে বলে ধরা হয়৷ যদি কোনো প্রার্থীই দুই তৃতীয়াংশ ভোট না পায় তখন কার্ডিনালরা কালো ধোয়া তৈরী করেন যা ব্যালট পেপারের সাথে ভেজা ঘাস ও রাসায়নিক পুড়িয়ে তৈরী করা হয়৷ এর মানে হলো এখনো কোনো সফল নির্বাচন সম্পন্ন হয়নি৷
১৪৯২ সালে চ্যাপেলের প্রথম কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয় সিস্টিন চ্যাপেলে৷ যা সেই বছরের ৬-১১ আগস্ট পর্যন্ত হয় এবং উক্ত নির্বাচনে পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার নির্বাচিত হোন৷ যিনি রদ্রিগো বোরজা নামেও পরিচিত৷ সিস্টিন চ্যাপেল বা ‘চ্যাপেলা সিস্টিনা’র নামকরণ হয় পোপ সিক্সতাসের নামানুসারে৷ পোপ সিক্সতাসের জন্ম ইতালিতে৷ পুরো চ্যাপেলটি ৪০ মিটার লম্বা ও ১৩ মিটার প্রশস্ত৷ চ্যাপেলের চিত্রকর্মগুলো প্রায় ১১০০ বর্গ মিটার জুড়ে, যা একটি আদর্শ ফুটবল মাঠের প্রায় ৬ ভাগের ১ ভাগ৷ সিলিং-এর ফ্রেস্কো রয়েছে ৮০০ বর্গ মিটার এলাকা জুড়ে৷
চতুর্থ সিক্সতাস-এর আমলে রেনেসাস চিত্রশিল্পীদের একটি দল ফ্রেস্কো সিরিজ তৈরী করেন যাদের মধ্যে ছিলেন সান্দ্রো বত্তিচেলি, পিয়েত্রো পেরুগিনি, পিনচুরিচ্চিও, ডমিনিকো, কজিমো রজেলি প্রমুখ৷ পাঠকদের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে ফ্রেস্কো কি? ফ্রেস্কো হলো এক ধরণের শিল্পকর্ম৷ ইতালিয়ান শব্দ Fresh থেকে এটি এসেছে যার অর্থ সতেজ৷
এটি এক ধরনের ম্যুরাল পেইন্টিং যেখানে সতেজ, ভেজা প্লাস্টার দিয়ে অঙ্কন করা হয়৷ সিস্টিন চ্যাপেলের এই চিত্রকর্মগুলো ১৪৮২ সালে সম্পন্ন হয় এবং পোপ সিক্সতাস ১৪৮৩ সালের ১৫ আগস্ট সিস্টিন চ্যাপেলে প্রথম মাস উদযাপন করেন কুমারী মেরিকে উৎসর্গ করে৷
১৪৭১ সালে ফ্রেঞ্চ নির্বাসন শেষে পোপ চতুর্থ সিক্সতাস রোমে ফিরে আসেন৷ সিদ্ধান্ত নিলেন বিপ্লবী কাজ করার৷ কিন্তু চ্যাপেল ততদিনে অনেকটাই ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় সিক্সতাস নতুন তৈরীর সিদ্ধান্ত নেন৷ লাল ইট দিয়ে তৈরী চতুর্ভুজাকৃতির এই সিস্টিন চ্যাপেল দেখতে অনেকটা বাইবেলে বর্ণিত সোলেমানের মন্দিরের মতো৷ জেরুজালেমে অবস্থিত এই মন্দিরটি খ্রিষ্টপূর্ব ৭০ সালে ধংস হয়ে যায়৷
১৫০৮ থেকে ১৫১২ সালের মধ্যে, পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস এর আমলে মাইকেলেঞ্জেলো চ্যাপেলের সিলিং অঙ্কন করেন৷ যা পশ্চিমা আর্টে পরিবর্তন আনে এবং মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম শৈল্পিক কর্ম হিসাবে বিবেচনা করা হয়৷
মাইকেলেঞ্জেলো ও সিস্টিন চ্যাপেল
সিস্টিন চ্যাপেলের রয়েছে অনেক গল্প৷ যার বেশিরভাগই বিখ্যাত শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর সাথে সম্পর্কিত৷ তার জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, অনমনীয়তা, গর্ব সবকিছুই যেন এই দেয়ালে অঙ্কিত৷ ইতালির তুস্কান অঞ্চলে ১৪৭৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন মাইকেলেঞ্জেলো৷
পড়ালেখার চাইতে চিত্রকর্মে বেশি আগ্রহ থাকায় তার পিতা তাকে ডমেনিক গ্রিলান্দোর কাছে শিক্ষানবীশ হিসেবে পাঠান৷ গ্রিলান্দো ছিলেন সেই সময়ের নামকরা চিত্রকর৷ সেখান থেকেই মাইকেলেঞ্জেলোর অসাধারণ সব কাজ হতে থাকে৷
সেই সময় রোমের এক কার্ডিনাল রাফায়েল-এর কাছ থেকে রোমান ওয়াইন দেবতা বাক্কাসের মূর্তি তৈরীর কাজ পান তিনি৷ কিন্তু সেটি রাফায়েলের পছন্দ না হলেও রোমে থাকা ফ্রান্সের প্রতিনিধি মাইকেলেঞ্জেলোর চিত্রকর্মে মুগ্ধ হোন৷ তারই অনুরোধে মাইকেলেঞ্জেলো তৈরি করেন ‘পিতা’ নামক মূর্তিটি৷
ফ্লোরেন্সের স্বাধীনতার প্রতীক ‘ডেভিড’ মূর্তিটিও মাইকেলেঞ্জেলোর হাতে গড়া৷ বলা হয়ে থাকে রেঁনেসা যুগের সেরা ভাস্কর্য হলো ‘ডেভিড’৷ পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের আমন্ত্রণে রোমে ফিরে গেলে তখন তাকে দেওয়া হয় সিস্টিন চ্যাপেলের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ৷
পোপ মাইকেলেঞ্জেলোকে সেই সময়ের একজন বিখ্যাত শিল্পী হিসেবে বিবেচনা করেন এবং তিনি চান মাইকেলেঞ্জেলো চ্যাপেলে ফ্রেস্কো চিত্র অঙ্কন করুক৷ কিন্তু মাইকেলেঞ্জেলো তা অস্বীকার করেন এবং এই কাজ এর দায়িত্ব রাফেলোকে দিতে বললেন৷ বলা ভালো, রাফেলো ছিলেন সেই সময়কার বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের মধ্যে একজন৷ মাইকেলেঞ্জেলো তখন ফ্লোরেন্সে অবস্থান করছিলেন এবং তিনি তখনও তা প্রত্যাখ্যান করছিলেন৷
কিন্তু পোপ তবুও তাকে জোর করতে থাকেন এবং ঘটনা অবশেষে কুটনৈতিক পর্যায়ে রূপ নেয়৷ ফলে তিনি বাধ্য হয়ে রোমে যান এবং কাজ করতে সম্মত হোন৷ ১৫০৮ সালে যখন কাজ শুরু হয় পোপ তখন প্রতিদিন মাইকেলেঞ্জেলোকে দেখতে আসতেন ফ্রেস্কোর অগ্রগতির খবরের জন্য৷ তখনও তাদের সম্পর্ক সহজ হয়নি৷
পোপের পর পোপ বদলালেও মাইকেলেঞ্জেলো টানা ৪০ বছর ধরে কাজ করে গেছেন সিস্টিন চ্যাপেলে৷ পুরো সিলিং এর কাজ শুরু হয়েছিল ১৫০৮ সালে এবং শেষ হয় ১৫১২ সালে, অর্থাৎ মোট ৪ বছর লেগেছিল৷
ফ্রেস্কোর নিয়ম হলো যেখানে পেইন্টিং করা হবে সেখানের প্লাস্টার থাকতে হবে ভেজা৷ সুতরাং ছোট ভাগে ভাগ করে একেকটা কাজ করা জরুরী ছিল৷ প্লাস্টার শুকিয়ে যাওয়ার আগেই কাজ শেষ করতে মাইকেলেঞ্জেলো স্পেশাল ফ্রেস্কো টেকনিক ব্যবহার করেন৷ যেখানে ৩টি লেয়ারে চিত্রকর্ম করা হয়৷
একটু রুক্ষ স্ক্র্যাচ লেয়ার, ব্রাউন লেয়ার এবং একটি ডেলিকেইট বা পাতলা লেয়ার৷ যেটা পেইন্টিং এর সারফেসটা তৈরী করতো৷ ফ্রেস্কো চিত্র আঁকার সময় শিল্পীদের খুব সতর্ক থাকতে হয়৷ কারন কাজগুলোকে খুব ছোট ভাগে ভাগ করে নিতে হয় এবং যাতে এগুলো দিনে শেষ হওয়ার আগেই শেষ করা যায়৷ সামান্য ভুল করা মানেই আবার নতুন করে কাজ শুরু করা৷
সাম্প্রতিক সময়ে একটি পূনরূদ্ধার দলের এটি পরিষ্কার এবং মেরামত করতে সময় লেগেছে ৯ বছর৷ তাই এটি এখনো অনেকের কাছে বিস্ময় যে মাইকেল এঞ্জেলো কিভাবে মাত্র ৪ বছরে পুরো কাজ শেষ করেছিলেন৷
সিস্টিন চ্যাপেলে মানবতার আধ্ম্যাত্মিক যাত্রাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷ যার শুরু হয়েছে ‘ক্রিয়েশন অব অ্যাডাম’ থেকে এবং শেষ হয়েছে ‘দ্য লাস্ট জাজমেন্ট’ দিয়ে৷ চ্যাপেলের সিলিংয়ে মূলত স্ট্যারি স্কাই চিত্রকর্ম ছিল তবে গাঠনিক সমস্যার কারণে তা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং বিরাট ফাটল দেখা যায়৷ মাইকেলেঞ্জেলোর চিত্রকর্ম সিলিং এর পূণ:নির্মাণের জন্য দরকার ছিল৷
চ্যাপেলের কেন্দ্রবিন্দু হলো এর সিলিং যা ওল্ড টেস্টামেনকে চিত্রিত করে৷ যার মধ্যে রয়েছে সৃষ্টি, মানুষের পতন,যীশুর জন্ম ইত্যাদি৷নয়টি সেন্ট্রাল প্যানেল এ চিত্রিত হয়েছে ‘দ্য জেনেসিস’ বই থেকে৷ পুরো সিলিং এ মোট ৩৪৩ টি চিত্র রয়েছে৷ সংখ্যাটা আশ্চর্যজনক৷ কারন চিত্রকর্ম আকার শুরুতে মাইকেল এঞ্জেলো বলেছিলেন মাত্র ১২ জনের কথা৷
দ্য ক্রিয়েশন অব অ্যাডামসে ঈশ্বরকে দেখানো হয়েছে একজন বয়স্ক দাড়িওয়ালা পুরুষ হিসেবে৷ তার নিচে বাম দিকে আদম বা অ্যাডাম সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায়৷ ঈশ্বর ডান বাহু প্রসারিত করে নিজ আঙ্গুল দিয়ে অ্যাডামকে জীবন দিচ্ছেন৷ অ্যাডাম তার বাম হাত প্রসারিত করে ঈশ্বরের দেওয়া জীবন নিচ্ছে৷ ১৫১১ থেকে ১৫১২ এর মধ্যে এটি সম্পন্ন হয়৷ এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ফ্রেস্কোচিত্র বলে ধরা হয়৷
সিস্টিন চ্যাপেলের চিত্রকর্মগুলো সিরিজ আকারে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশ করে৷ নূহ নবী ও তার সময়ে ঘটিত বন্যা, নুহর আত্মত্যাগ, অ্যাডাম ও ইভের নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পরের ঘটনা, ইভের সৃষ্টি, অ্যাডামের সৃষ্টি, সাগর থেকে নদীর আলাদা হওয়া, সূর্য, চন্দ্র ও গাছপালার সৃষ্টি, অন্ধকার থেকে আলোর আলাদা হয়ে যাওয়া এসব সিরিজ আকারে অঙ্কিত আছে৷
সিস্টিন চ্যাপেলের কিছু নিয়ম কানুন
সিস্টিন চ্যাপেলে প্রবেশ করতে হলে কিছু নিয়ম আপনাকে অবশ্যই মানতে হবে৷ যেমন-
- ভিজিটররা যখন সিস্টিন চ্যাপেল,ভ্যাটিক্যান মিউজিয়াম,ভ্যাটিকান গার্ডেন ও সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় যাবে তখন তাদের অবশ্যই বাহু,কাঁধ এবং পা ঢাকা থাকবে৷ নারী পুরুষ সবার জন্য সকল ধরণের অশ্লীলতা এখানে নিষিদ্ধ৷
- বড় ছাতা,হাঁটার জন্য স্ট্রিকস(যদি না আপনি শারীরিকভাবে অক্ষম হোন), ক্যামেরা, ট্রাইপডস এগুলো নিয়ে মূল চ্যাপেলে ঢুকা যাবে না৷
- Nippon Telivision Network নামক একটি জাপানি কর্পোরেশন ৪.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে,সিস্টিন চ্যাপেলের ৯ বছরের পূণ:নির্মানের জন্য৷ তাই তাদের চুক্তি অনুযায়ী সিস্টিন চ্যাপেলের ভিতরে কোনোপ্রকার ফটোগ্রাফি কিংবা ফিল্মিং করা যাবে না৷
সিস্টিন চ্যাপেল পরিদর্শন করতে হলে আপনাকে প্রবেশ মূল্য দিতে হবে৷ ৬ বছরের নিচে শিশুদের জন্য প্রবেশ মূল্য ফ্রি৷ ৬-১৮ বছর বয়সী, শিক্ষার্থী ও তীর্থযাত্রীদের জন্য ৮ ইউরো৷ প্রাপ্তয়স্কদের ক্ষেত্রে এই প্রবেশ মূল্য ১৭ ইউরো৷ সোম-শনি সপ্তাহে ৬ দিনই খোলা থাকে, যে কেউ নির্ধারিত প্রবেশ মূল্য দিয়ে প্রবেশ করে সাক্ষী হতে পারেন ইতিহাসের অসাধারণ সব শিল্পকর্মের৷
Feature Image:unsplash.org References: 01.http://history.com. 02.http://thesistinechapel.org. 03.http://romesite.com. 04.http://britannica.com. 05.http://m.museivaticani.va.