জার্মান পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী একটি দেশ। এর গোড়াপত্তন খ্রিস্টপূর্ব ১০০ সালের দিকে শুরু হলেও আধুনিক জার্মানির ভিত্তি স্হাপিত হয় ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজয়ের পর ১৮৭১ সালে।
দেশটি ইউরোপ মহাদেশের কেন্দ্রে অবস্থিত। পৃথিবীতে সংঘটিত আধুনিককালের ভয়াবহ দুটি বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া জার্মানি একসময় দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। কিন্তু অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলির তুলনায় পরবর্তীতে আবার একত্রিত হয়ে জাতীয় ঐক্য অর্জন করে, দ্রুত অর্থনৈতিক এবং সামরিকভাবে এগিয়ে যায়।
নিজেদের যোগ্যতা আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ভঙ্গুর অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তোলে।আজ পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে জার্মানি অন্যতম। শুধু রাজনীতি বা অর্থনীতিই নয়,বরং সাংস্কৃতিক,ভৌগলিক,সামাজিক সব দিক থেকে সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে নিজেদের তৈরি করেছে।
জার্মানির ইতিহাস ও পরিচয়
অতি প্রাচীন কাল থেকেই জার্মানির অস্তিত্ব ছিল।খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে শক্তিশালী রোমান সৈন্যরা দক্ষিণে দানিউব নদী এবং পশ্চিমে রাইন পর্যন্ত ভূমি দখল করতে পারলেও মধ্য জার্মানি মুক্ত ছিল।
যখন রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, তখন আঞ্চলিক জার্মানি দলগুলি এবং পরবর্তী সম্রাটদের অধীনে জার্মান ইউরোপীয় বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হয়।
মধ্যযুগের শেষের দিকে হ্যানসেটিক লীগ গঠিত হয় এবং উত্তর জার্মানির বন্দর শহরগুলি (যেমন ব্রেমেন, হামবুর্গ এবং লুবেক) অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক শক্তিতে পরিণত হয়। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে জার্মানি শহর ও রাজ্য বিশপ ও আর্চবিশপ, বিভিন্ন রাজা, রাজকুমার, ডিউক, ইম্পেরিয়াল নাইট এবং অন্যান্য সামরিক আভিজাত্যের নেতৃত্বে নিয়ন্ত্রণহীন দলে বিভক্ত ছিল।
১৫১৭ সালে মার্টিন লুথার প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার শুরু করেছিলেন। ফলস্বরূপ ত্রিশ বছরের যুদ্ধে (১৬১৮-১৬৪৮) জার্মানির শহর এবং অর্থ ধ্বংস হয়েছিল এবং বেশিরভাগ জমি হারিয়ে ফেলেছিল।
অবশিষ্ট জার্মান রাজ্যগুলি তখন রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ছিল।কিন্তু এর সুশাসনের অধীনে প্রুশিয়া এবং ব্র্যান্ডেনবার্গ রাজ্য ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছিল।গঠিত হয়েছিল একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র এবং একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি, যার সদর দপ্তর বার্লিনে ছিল।
১৭৯৩ সালে শুরু করে দক্ষিণ এবং পশ্চিমের রাজ্যগুলি নেপোলিয়নের সুদূরপ্রসারী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারেনি, শুধুমাত্র প্রুশিয়া শক্তিশালী প্রতিরোধের প্রস্তাব দিয়েছিল। ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নিক যুদ্ধ শেষ হলে স্বায়ত্তশাসিত জার্মান রাজ্য এবং শহরগুলির একটি কনফেডারেশন গঠিত হয়।
অটো ভন বিসমার্ক, তথাকথিত “আয়রন চ্যান্সেলর”, সেই রাজ্যগুলিকে একটি সম্মিলিত সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। বার্লিন ছিল রাজধানী।এসময় অর্থনীতির উন্নতি ঘটে এবং গির্জার প্রভাব ম্লান হয়ে যায়। অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ড, অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সিংহাসনের উত্তরাধিকারী এবং তার স্ত্রী সোফিকে হত্যার পর ১৯১৪ সালের জুন মাসে সারাজেভোতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।
আর জার্মান ছিল মূল আক্রমণকারী এবং সেই যুদ্ধের ভয়াবহতায় লক্ষাধিক লোক মারা যায়, বিশেষ করে ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামে। ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং জার্মানির উপর যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ আরোপ করা হয়, যার মধ্যে অঞ্চলগুলির ক্ষতি এবং কায়সারের প্রস্থান অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অ্যাডলফ হিটলার ১৯৩৩ সালে সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এবং একটি আক্রমনাত্মক জাতীয়তাবাদী নীতি অনুসরণ করেছিল যা শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত করে। ১৯৪৫ সালে এই ইউরোপীয় দুঃস্বপ্ন শেষ পর্যন্ত শেষ হয়। লক্ষ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল, হিটলার বার্লিনে আত্মহত্যা করেছিলেন এবং জার্মানি অবশেষে ১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।
১৯৪৫ সালে ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পরাজয়ের পর নাৎসি আমলের সমাপ্তি ঘটে এবং বিজয়ী শক্তি তিন বছর শাসনক্ষমতায় ছিল। তবে জার্মানির সাথে মিত্র শক্তির ঠান্ডা যুদ্ধ চলছিল যার ফলে ১৯৪৮ সালে জার্মান বিভক্ত হয়ে দুটি জার্মান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল।একটি পশ্চিম ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানি (FRG) এবং অপরটি পূর্ব জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (GDR)।
তবে ১৯৯০ সালে এ দুই জার্মানি আবারও একত্রিত হয়ে বিশাল জার্মানি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় । যার সাংবিধানিক নাম হয় ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানি। দেশটি জাতিসংঘ, NATO, G8 এবং G4 এর সদস্য রাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে জনবহুল এবং অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী সদস্য রাষ্ট্র।
জার্মানির ভৌগলিক অবস্থান ও জলবায়ু
জার্মানির অবস্থান ইউরোপ মহাদেশের কেন্দ্রে। এর উত্তরে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ এবং দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। উত্তরে উত্তর সাগর ও বাল্টিক সাগর এবং দক্ষিণে আল্পস পর্বতমালা।
দেশটির আনুষ্ঠানিক নাম ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানি। এর আয়তন ৩,৫৭,০২২ বর্গ কিলোমিটার। ১৬ টি রাজ্য নিয়ে গঠিত হয়েছে জার্মানি। এর রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর হল বার্লিন।
বিভিন্ন পাহাড়ি ও পার্বত্য অঞ্চলের কারণে সারা জার্মানিতে আবহাওয়া ও জলবায়ুর অনেক বৈচিত্র্য দেখা যায়। এমনকি ১০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যেও তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণে বড় পার্থক্য দেখা যায়। গ্রীষ্মে এটি দক্ষিণ দিকে উষ্ণ হয়ে উঠে এবং শীতের সময় ঠিক উল্টো। এখানে দীর্ঘ সময়ের তুষারপাত বিরল। আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তনের ফলে বছরের যে কোনো সময় বৃষ্টি হতে পারে।
যেমন জার্মানির উপকূলীয় অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে গরম এবং শীতকালে শীত অনুভূত হওয়ায় ওখানে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু বিরাজমান। মধ্য অংশ এবং দক্ষিণে ক্রান্তিকালীন জলবায়ু রয়েছে।আলপাইন ও উচ্চভূমি অঞ্চলে শীতল আবহাওয়া এবং বেশি বৃষ্টি হয়।এছাড়া এদেশটির জলবায়ু কিছু পরিমাণে উপসাগরীয় স্রোত দ্বারাও প্রভাবিত হয়।
মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বসন্তকাল এবং এসময়ই আবহাওয়া অপ্রত্যাশিতভাবে বৃষ্টি, রোদ বা বাতাস নিয়ে আসে।তবে জার্মানি দেখার জন্য এটি বছরের একটি সুন্দর সময়। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল।এসময়টা উষ্ণ এবং সাধারণত রৌদ্রোজ্জ্বল তবে এটি সবচেয়ে বৃষ্টিপাত এবং আর্দ্রতার ঋতুও। এসময় তাপমাত্রা ৩৫° সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে।
সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত শরৎকাল এবং এ ঋতুর প্রথম দিকে ভালো আবহাওয়া চললেও শেষের দিকে ধূসর এবং কুয়াশাচ্ছন্ন হয়। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শীতকাল যখন আবহাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে থাকে এবং রাতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে যেতে পারে। সাধারণত ডিসেম্বর, জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতে তুষারপাত হয়।
জার্মানির সংস্কৃতি
জার্মানি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে অনেক সমৃদ্ধ কারণ দেশটি কবি ও চিন্তাবিদদের দেশ নামেও পরিচিত ।সামাজিক শৃঙ্খলা ও কাঠামোর প্রতি সম্মান দেখানো, যেকোন কাজ সময়মতো হওয়া,সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য এবং সেখানে বসবাসকারী প্রত্যেকের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য যে নিয়মগুলি রয়েছে তা অনুসরণ করা জার্মান সংস্কৃতির প্রধান একটি দিক।
জার্মান মূলত একটি পৌত্তলিক দেশ ছিল এবং তারপরে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়। এটি প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারের জন্মস্থানও ছিল।প্রায় ৫০ মিলিয়ন জার্মান খ্রিস্টান হিসাবে চিহ্নিত। তবে এখন জার্মানিতে খ্রিস্টান, ক্যাথলিক এবং মুসলমানরা সুখে সহাবস্থান করছে।
জার্মানির পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো “অক্টোবারফেস্ট” বা বিয়ার উৎসব, সুস্বাদু সসেজ, হাইকিং,দুই জার্মানির একত্রিত হওয়ার দিনে ফেডারেল ছুটি, ঐতিহ্যবাহী ‘ওম-পাহ’ লোকসংগীত এবং ক্রিসমাস, ইস্টার সানডে সহ অনেক ঐতিহ্যবাহীছুটির দিন উদযাপন।
এখানে ঐতিহাসিকভাবে খ্রিস্টান দেশ হিসেবে ধর্ম থেকে অনেক সাংস্কৃতিক প্রতীক উদ্ভূত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্রুসিফিক্স ও প্রিটজেলের আকৃতি, মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় চাঁদ ও তারা জার্মানির একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়।
জার্মান সংস্কৃতির অন্যান্য প্রতীকগুলি হল শিল্প, রাজনীতি এবং দর্শনের বিখ্যাত নাম যেমন গোয়েথে, বিথোভেন, ক্লি, কান্ট এবং মার্কস । আধুনিক সংস্কৃতির প্রতীকগুলির মধ্যে রয়েছে জার্মান পতাকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতাকা।
সুশৃঙ্খলতা জার্মান সংস্কৃতির সাথে এমনভাবে জড়িত যার প্রভাব জার্মানদের ব্যবসায়িক জীবনেও ছড়িয়ে পড়েছে। কোন ব্যবসায়ী অন্য ব্যবসায়ীকে শুধু বিস্ময় এবং হাস্যরস নিয়ে স্বাগত জানায় না বরং সব ব্যবসায়িক পরিকল্পনা সতর্কতার সাথে করা হয়। আর ব্যবসায়িক ব্যপারে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে চুক্তি হওয়ার পরে খুব কমই সে সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটে।এছাড়া জার্মানিতে শিল্পের প্রসার ব্যাপক হওয়ায় প্রকৌশলীদের জন্য উচ্চ সম্মান রয়েছে।এ কারণে কোম্পানিগুলি আইনজীবী বা আর্থিক ব্যাকগ্রাউন্ডের চেয়ে প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে থাকে।
জার্মানির ভাষা হলো জার্মান। যা জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ডের অফিসিয়াল ভাষা।তবে জার্মানিতে ইংরেজি, ফ্রিজিয়ান এবং ডাচ (নেদারল্যান্ডিক, ফ্লেমিশ) সহ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাও প্রচলিত আছে ।বিশ্বব্যাপী গোয়েথে ইনস্টিটিউট ৯৮টি দেশে ১৫৯টি শাখায় জার্মান ভাষা ও সংস্কৃতির বিস্তার ঘটাতে সাহায্য করে।
স্থাপত্য ও প্রকৌশলের প্রতি জার্মানদের ঝোঁক থাকায় তাদের কাঠ খোদাই শিল্পের শক্তিশালী ঐতিহ্য রয়েছে। এজন্য ক্যাথেড্রাল, দুর্গ এবং পাবলিক বিল্ডিংগুলিতে রোমানেস্ক, গথিক, ক্লাসিস্ট, বারোক, রোকোকোর প্রভাব রয়েছে। ক্লাসিক জার্মান শিল্পের একটি সুপরিচিত উদাহরণ হল ব্র্যান্ডেনবার্গ গেট বা প্রাক্তন শহরের গেট যা এখন বার্লিনের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
জার্মানরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অসাধারণ অবদান রেখেছে। বিখ্যাত জার্মান বা অস্ট্রিয়ান সুরকার যেমন জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ, উলফগ্যাং অ্যামাডেউস মোজার্ট, লুডভিগ ভ্যান বিথোভেন, জোহানেস ব্রাহ্মস, রিচার্ড ওয়াগনার এবং গুস্তাভ মাহলারের ঐতিহ্য আজও বেঁচে আছে।
বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, আন্তর্জাতিক ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা, বাইরেউথ ফেস্টিভ্যাল, বার্লিন থিয়েটারট্রেফেন, রক অ্যাম রিং, এবং রুহর ট্রিনালে জার্মানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থা অনেক উন্নত হওয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থী এদেশে পড়াশুনা করতে পাড়ি জমায়।
জার্মানির অর্থনীতি
জার্মানি হল ইউরোপের সবচেয়ে শিল্পোন্নত দেশ এবং এর অর্থনীতি বেশ বৈচিত্র্যময়। স্বয়ংচালিত শিল্প দেশের বৃহত্তম খাত, তবে জার্মানি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, বৈদ্যুতিক এবং ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম এবং রাসায়নিক পণ্য সহ অন্যান্য বিশেষ খাতগুলিও ধরে রেখেছে।
২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কারণে মন্দার সম্মুখীন হওয়ার পর, উৎপাদন এবং নির্মাণ খাতে ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও ২০২১ সালে দেশটির প্রবৃদ্ধি আনুমানিক ৩.১% বৃদ্ধি পেয়েছে। মাথাপিছু জিডিপি (PPP) USD ৫৪,২৬৩ নিয়ে জার্মানি বিশ্বের ধনী দেশগুলির মধ্যে শীর্ষে রয়েছে।
জার্মানির জিডিপিতে কৃষি খাত মাত্র ০.৭% অবদান রাখে। প্রধান কৃষি পণ্যের মধ্যে রয়েছে দুধ, শুয়োরের মাংস, সুগার বিট, আলু, গম, বার্লি এবং সিরিয়াল। শিল্প খাতের জিডিপির পরিমাণ প্রায় ২৬.৫% এবং দেশের কর্মশক্তির ২৭% এ খাতে নিযুক্ত । বাণিজ্য জার্মানির জিডিপির ৮১% প্রতিনিধিত্ব করে এবং দেশটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক এবং রপ্তানিকারক । দেশটি এখন পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম অটোমোবাইল রপ্তানিকারক (বিশ্বব্যাপী মোট রপ্তানিকৃত গাড়ির ১৯.৩%)।
জার্মানির পরিষেবা খাত দেশের জিডিপিতে ৬৩.৪% অবদান রাখে। বাসস্থান এবং খাদ্য পরিষেবা খাতও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যার মোট টার্নওভার ৯৮ বিলিয়ন ইউরো ।
এতো ধনী দেশ হয়েও জার্মানিতেও বেকারত্ব রয়েছে।২০২১ সালে বেকারত্বের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৩.৭% ৷ আর দেশের জনসংখ্যার প্রায় ১৭.৪% দারিদ্র্য বা সামাজিক বর্জনের ঝুঁকিতে রয়েছে ।তবে দেশটি এ সমস্যা থেকেও বের হওয়ার চেষ্টা করছে।
জার্মানির রাজনীতি
জার্মানির রাজনীতির ভিত্তি হলো ফেডারেল সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচন করা হয় এবং সবার সমান ভোটাধিকার থাকে। সংবিধানকে Grundgesetz বলা হয়। জনগণের অধিকার নির্ধারণের পাশাপাশি এটি রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিসভা, বুন্দেস্তাগ, বুন্দেসরাত এবং আদালতের কাজ বর্ণনা করে।
রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রের প্রধান। ফেডারেল চ্যান্সেলর হল সরকারের এবং আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর প্রধান যাকে বুন্দেস্তাগ বলা হয়। নির্বাহী ক্ষমতা সরকারের উপর ন্যস্ত করা হয়। ফেডারেল আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সরকার এবং পার্লামেন্টের দুটি অংশ বুন্দেস্তাগ এবং বুন্দেসরাতকে দেওয়া হয়েছে। সরকারের মন্ত্রীরা সংসদের সদস্য এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য তাদের সংসদীয় সমর্থনের প্রয়োজন হয়।জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর বা দেশের প্রধান হলেন ওলাফ শলৎজ।
যেহেতু জার্মানি একটি ফেডারেল দেশ, তাই সরকারের অনেক কাজ ১৬টি রাজ্য সম্পন্ন করে। ক্ষমতা জাতীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে ভাগ করা হয়। জাতীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলিকে বাতিল করতে পারে না।
জার্মানির সমাজব্যবস্থা ও অন্যান্য তথ্য
জার্মানিদের জীবনযাত্রা বৈচিত্র্যময় হলেও তারা বিদেশীদের প্রতি কিছুটা রক্ষণশীল। তবে তারা খুব অতিথিপরায়ণ, সৎ এবং বিশ্বস্ত। তারা অতিথিকে সম্মান জানায় এবং তার সাথে উপহার ও কুশলাদি বিনিময় করে।এদেশের নাগরিকরা বিদেশিদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়তে সময় নেয়৷ কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে জনগণ বন্ধুত্বপূর্ণ বা সহযোগিতামূলক নয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জার্মানিতে অনেক বিদেশীর আগমনের ফলে সরকার তাদের সংহত করার জন্য নতুন নীতি গ্রহণ করেছে।তারা ইন্টিগ্রেশন কোর্সের আয়োজন করে যার মধ্যে জার্মান ভাষা শেখানো এবং জার্মান সমাজের সংস্কৃতি, রীতিনীতি এবং ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করানো অন্তর্ভুক্ত ।
জার্মানিদের কাজ, ভ্রমণ এবং তাদের ভাষার প্রতি ভালবাসা অনন্য। মজার ব্যাপার হল সূর্যের প্রতি তাদের দারুণ ভালোবাসা, কারণ জার্মানিতে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন বিরল। সেই কারণে জার্মানিরা রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে বাগানে সূর্যস্নান করে থাকে।
রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি হওয়ায় ঐদিন শপিংমলগুলো খোলা থাকে এবং কেনাকাটা চলে। যদিও সপ্তাহের বাকি দিনগুলিতে মাত্র কয়েকটি দোকান খোলা থাকে এবং তাদের বেশিরভাগই আটটায় বন্ধ হয়ে যায়।
পুরো জার্মানির ৩২% এলাকা জুড়ে বনভূমি থাকায় বন জার্মানদের জন্য একটি পবিত্র স্থান কারণ তারা সেখানে তাদের সন্তানদের সাথে তাদের অবসর সময় কাটাতে পছন্দ করে। নার্সারি এবং স্কুল পর্যায়ে শিশুদের কার্যক্রমেও বন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ।
জার্মানিদের খাবার সমৃদ্ধ ও সুস্বাদু । এখানকার বিখ্যাত খাবারের মধ্যে আছে সবজি ভরা এনটিউইভ স্যুপ, পাস্তা এবং মাংসের স্প্যাটজেল ডিশ, মুল্যাচেন, সসেজ প্রভৃতি।এছাড়াও এদেশ বিভিন্ন ধরণের ডেজার্ট এবং পাই, যেমন অ্যাপল পাই, পিচ ক্রিম পাই, রাস্পবেরি পাই এবং প্রেটজেল কেকের জন্য বিখ্যাত।
জার্মানির সাম্প্রতিককালের অন্যতম একটি সমস্যা হলো এদেশের নারীদের সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া।এটা এদেশের জন্য একটি হুমকি।
https://www.nationsonline.org/oneworld/germany.htm
https://globaledge.msu.edu/countries/germany