বর্তমান সময়কে বলা হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির স্বর্ণযুগ। যদিও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দুটি বিষয়ই সম্পূর্ণ আলাদা এবং উদ্দেশ্যও ভিন্ন। তবে একটি অপরটির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। বর্তমানকালে জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এসবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
মূলত আঠারো শতকের শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়ন সাধনের পাশাপাশি এর ব্যবহারও দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর ঠিক সেই সময়টি থেকেই বিজ্ঞান নানামুখী আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে প্রযুক্তির উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ও আধুনিকায়নে সর্বাপেক্ষা মূখ্য ভূমিকা রেখেছে। আর পরবর্তীতে সেই ক্রমধারায় আজ প্রযুক্তির বিকাশ ঘটছে দ্রুত গতিতে, একের পর এক ঘটে চলেছে চোখধাঁধানো সব পরিবর্তন, সেই সাথে অগ্রগতি তো আছেই।
মানুষের জীবনধারার মান পরিবর্তনের সাথে সাথে এর পরিবর্তনের হারকে করেছে বিস্ময়কর ত্বরান্বিত। আর এর ফলশ্রুতিতে বর্তমান সময়কার আইটি খাতগুলোতে ব্যাপক অগ্রগতির পাশাপাশি এটিও বুঝতে বাকি নেই যে, আজকের ব্যবহৃত প্রযুক্তির মাঝে আগামীকালের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সীমাবদ্ধ রাখাটা প্রায় অসম্ভব।
আর তাই সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চাইলে অবশ্যই প্রযুক্তিকে নিয়ে ক্রমাগত শিখন প্রক্রিয়ার মাঝেই আমাদের থাকতে হবে। একনজরে দেখে নেয়া যাক ২০২২ সালের উদ্ভাবনী সেরা পাঁচ অলোচিত প্রযুক্তিসমূহকে।
১. কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং
বর্তমান যুগ বহুলাংশেই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভরশীল। এমনকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও দিনকে দিন এর প্রভাব বেড়েই চলছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস থেকে শুরু করে হিসাব-নিকাশ, দাপ্তরিক কার্যাদি, ব্যাংকিং, নিরাপত্তা বিভাগ, স্মার্টফোন টেকনোলজিসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হচ্ছে।
ধরে নেয়া যাক আপনার কাছে একটি কম্পিউটার আছে যেখানে আপনি ব্যবহারের শুরুর দিন থেকেই নিত্য দিনের আবহাওয়ার তথ্যসমূহ রেখে দিয়েছেন। সেই সাথে একটি প্রোগ্রামও তৈরি করে রেখেছেন এই বিষয়ক। এভাবে একটি বছর অতিবাহিত হবার পর আপনার তৈরিকৃত প্রোগ্রামটি থেকে কম্পিউটার মেঘলা দিনের সাথে বৃষ্টির যোগসূত্র নির্ণয় করতে সক্ষম হবে।
আবার কম্পিউটারটিকে যদি কখনো এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন সে উপরোক্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আপনাকে এটাই জানানোর চেষ্টা করবে যে, আকাশ মেঘলা থাকার সাপেক্ষে বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা কতটুকু রয়েছে। আর এখানে কম্পিউটার যে প্রোগ্রামটি ব্যবহার করে আগে থেকেই প্রাপ্ত উপাত্তকে বিচার বিশ্লেষণ করে উত্তরে যে তথ্য দিলো এটাই হচ্ছে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা।
মানুষের চিন্তা করার যে ক্ষমতা বা বিচার বুদ্ধিমত্তা এগুলোকে কৃত্তিম উপায়ে প্রযুক্তি নির্ভর করে যন্ত্রের সাহায্যে বাস্তবায়ন করার যে কৌশল একেই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বলা হয়। অপরদিকে কর্মক্ষেত্রে আমরা মূলত কম্পিউটার ব্যবহার করে থাকি কাজে সহায়তা পাবার আশায়। যেখানে আমরা কিছু প্রোগ্রাম টাইপ করি আর কম্পিউটার ওই প্রোগ্রাম-এর আদলে আমাদের দেয়া কাজটি সম্পন্ন করে দেয়। আর এই প্রোগ্রামিং পদ্ধতিটিকে আমরা বলতে পারি অটোমেশন।
যেটি মানুষের সাহায্যে প্রতিনিয়ত সম্পাদিত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে প্রোগ্রামিং করাটা যেমন কষ্টসাধ্য তেমনই ক্ষেত্রবিশেষে এই সেক্টরে অনেক সময় জনবলও পাওয়া যায় না সময়মতো। আর তাই এই সমস্যার সমাধান হিসেবে ইতিমধ্যেই ডাটাকে বেছে নেয়া হয়েছে। যেখানে মানুষের পরিবর্তে কাজগুলো ডাটাই করে দিবে।
আর মেশিন লার্নিং বলতে বোঝায় কম্পিউটার এর প্রোগ্রামিং শেখানোর কৌশলগুলোকেই। যেখানে ডাটা উল্লেখ করে দেয় কম্পিউটার নিজেকে কিভাবে প্রোগ্রাম করাবে। অর্থাৎ প্রোগ্রামিংকে যদি আমরা অটোমেশন হিসেবে ধরি তবে মেশিন লার্নিং হচ্ছে অটোমেশনের প্রসেসগুলোকে অটোমেট করার পদ্ধতি। আর এই কারণেই বর্তমানে মেশিন লার্নিংকে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার উপসেট হিসেবেও বিবেচনা করা হয় এবং কর্মক্ষেত্রেও এর চাহিদা ব্যাপক।
২. আধুনিক শক্তি সঞ্চয় পদ্ধতি (ইএসএস)
নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসসমূহ যেমন: বায়ুকল ও সৌরশক্তি ক্রমবর্ধমানভাবে বিশ্বের পাওয়ার গ্রিডগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে। যার ফলস্বরূপ বিদ্যুৎ উৎপাদন শিল্পে এর উৎপাদনকারীদের উপযুক্ত দক্ষতার সাথে বিরতিহীনভাবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয় করার জন্য এর ক্রমবর্ধমান গুরুত্বও ব্যাপক। আর নবায়নযোগ্য শক্তির সাথে এই শক্তি সঞ্চয় পদ্ধতি বা ইএসএস সিস্টেম শুরু থেকেই ওতপ্রতভাবে জড়িত।
সম্প্রতি জাপানের মিতসুবিশি কোম্পানি এই ইএসএস পদ্ধতির ব্যবহার শুরু করে এবং তারা এর ব্যবহারের মাধ্যমে কিভাবে শক্তি মজুত করতে হয়, কতক্ষণ এটি সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব এবং সুপার কন্ডাকটিং ম্যাগনেটিক এনার্জি স্টোরেজ, রিচার্জেবল ব্যাটারি ও আল্ট্রাক্যাপাসিটরের স্বল্প মেয়াদি স্টোরেজ চাহিদা মেটাতে কিভাবে কাজ করে তা সফলভাবে বিশ্বে প্রথমবারের মতো উপস্থাপনের দৃষ্টান্ত গড়তে সক্ষম হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যৎতে শিল্পখাতেও এই পদ্ধতিটির ব্যবহার বেশ লাভজনক হবে।
৩. গ্রাফিন লেড এসিড ব্যাটারি
গ্রিড স্থিতিশীলতা সহজতর করার লক্ষ্যে শক্তি সঞ্চয় করা অতীব জরুরি। এটি বৈদ্যুতিক যানবাহনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।যেহেতু ইতিমধ্যেই শক্তি সঞ্চয়-এর গুরুত্ব লোকজন বুঝতে শুরু করেছে এবং এর সংরক্ষণের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বও দেয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি এখন সেল প্রযুক্তির অগ্রগতির বিষয়েও জোর দেয়া হচ্ছে।
শক্তি সঞ্চয়ের যে পদ্ধতি মূলত এর ওপর নির্ভর করেই স্টোরেজ সিস্টেমগুলোর ফর্ম, ড্রাইভিং প্রযুক্তি ও আকারের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তনগুলো ঘটে। বর্তমানে ব্যাটারি রসায়নের বিকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শক্তি মজুত স্থানের সমাধানগুলো এদের জন্য সবচেয়ে কার্জকরী অ্যাপ্লিকেশনগুলোর জন্য বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
বর্তমানে প্রায় সকল নতুন শক্তি সঞ্চয় প্রকল্পেই ব্যাটারি স্টোরেজ ব্যবহার করা হচ্ছে। এদিকে ব্যাটারির সঞ্চয়ের বাজারটির দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং ব্যাটারি প্রযুক্তি এবং এর পুননর্বীকরণযোগ্য শক্তির যে খরচ তার ক্রমাগত পতনের কারণে বিকশিত হয়েছে।
আর সেই সাথে দীর্ঘস্থায়ী গ্রিড ব্যাটারির যে প্রযুক্তিটি রয়েছে বেশ কিছুদিন ধরেই বাজারে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ধারণা করা হচ্ছে ভবিষ্যতে এটি আরও বাড়বে।
৪. দেহের প্রোটিন ভাঁজকরণ প্রক্রিয়ায় কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার
কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা জীব বিজ্ঞানের একটি বড় চ্যালেঞ্জের সমাধান বের করা সম্ভব হয়েছে।অ্যাসিনো এসিডের চেইনগুলো থেকে এদের প্রোটিনগুলো কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে 3D আকারে ভাঁজ করে, যা জীবনচক্রের বিভিন্ন কাজগুলো সম্পাদন করে তার ভবিষ্যদ্ধাণী করা হয়েছে।
কাঠামোগত ভাবে জীববিজ্ঞানের জন্য এই প্রযুক্তির ব্যবহার একটি বিশাল আবিষ্কার ও বটে।এটি জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় রহস্য গুলোর একটি, যেটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে অনেকাংশেই সমাধান করা সম্ভব হয়েছে বলেই দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা।
৫. পিওএস বা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে অংশীদারিত্বের প্রমাণ পদ্ধতি
পিওএস বা প্রুফ অফ স্টেকসহ ক্রিপ্টোকারেন্সির মালিকরা এর স্টেক করানোর কয়েনের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে ব্লকের লেনদেনসমূহ যাচাই বাছাই করে থাকেন। এদিকে প্রুফ অফ স্টেককে তৈরি করা হয়েছে মূলত প্রুফ অফ ওয়ার্কের বিকল্প হিসেবে। নতুন একটি ব্লকচেইনকে বৈধতা দিতে এবং এর পাশাপাশি ব্লক চেইনসমূহের মাঝে যোগসূত্র স্থাপনেও এর মূখ্য ভূমিকা রয়েছে।
এই প্রক্রিয়ায় একটি সুনির্দিষ্ট ঐক্যমতে পৌঁছানোর মাধ্যমে একটি বিতরণ করা ডাটাবেসের মাধ্যে এন্ট্রি যাচাই করা ও ডাটাবেসকে সুরক্ষিত রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। আর ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রে এই ডাটাবেসকেই বলা হয় ব্লকচেইন। বর্তমান সময়ে পিওএস বা প্রুফ অফ স্টেক ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটিতে নেটওয়ার্ক-এর আক্রমণের সম্ভাবনা কম এবং এটি কম ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এখানে এমনভাবে ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া গঠন করা হয়েছে যা আক্রমণকে বাধা দেয়।
এখানে ব্লগ ক্রিয়েটরদের বলা হয় ভ্যালিডেটর, আর সৃষ্টিকারীদের বলা হয় খনি শ্রমিক। স্টেকের প্রমাণে একটি বৈধতা হতে অংশগ্রহণকারীর কাছে অবশ্যই খনি শ্রমিক হবার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি ও সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে হবে। আর প্রুফ অফ স্টেকের মূল লক্ষ্য হলো এখানে যেহেতু আর্থিক মূল্য সংক্রান্ত বিষয়াবলি জড়িত তাই স্বভাবতই এখানটায় লোকেদের একটি সুবিধা লাভের উপায় খুঁজতে সর্বদা সহায়তা করা হয়।
Feature Image: builtin.com References: 01. http://greycampus.com. 02. http://forbes.com. 03.http://weforum.org.