ক্যালিগুলা: এক উন্মাদ সম্রাটের আখ্যান

412
0

সাধারণ নাগরিকদের প্রতি অদ্ভুত ও কঠোর আচরণের জন্য পরিচিত, কুখ্যাত রোমান সম্রাট ক্যালিগুলার খুব প্রিয় একটি ঘোড়া ছিল। নাম ছিল ইনসিতাতোস। তিনি ঘোড়াটিকে এতই ভালবাসতেন যে, ঘোড়ার জন্য মার্বেল এবং হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি একটি আলাদা ঘর বানিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি, ঘোড়াটিকে তার পরামর্শদাতাদের মধ্যে উচ্চ পদে নিয়োগ করার পরিকল্পনাও করেছিলেন।  

পরিচিতি

পাঁচজন জুলিও-ক্লাউডিয়ান সম্রাটের মধ্যে তৃতীয়, রোমান সম্রাট ক্যালিগুলার জন্ম ১২ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি জের্মানিকোস (২৪ খ্রিষ্টপূর্ব-১৯ খ্রিষ্টাব্দ) এবং অ্যাগরিপিনা দ্য এল্ডার (১৪ খ্রিষ্টপূর্ব-৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) এর সন্তান এবং সম্রাট অগাস্টাস (৬৩ খ্রিষ্টপূর্ব-১৪ খ্রিষ্টাব্দ) এর প্রপৌত্র। তিনি গাইয়াস জুলিয়াস সিজার অগাস্টাস জের্মানিকোস নামে বেশি পরিচিত। ছোটবেলায় তার বাবার সাথে সামরিক অভিযানে ভ্রমণের সময় তাকে ‘ক্যালিগুলা’ ডাকনাম দেওয়া হয়, ল্যাটিন ভাষায় যার অর্থ ‘ছোট বুট’। 

রোমান সম্রাট ক্যালিগুলা Image source: wikipedia.org

বাল্যকাল

ক্যালিগুলার বয়স যখন মাত্র সাত, তখন অ্যান্টিওকে সেবা করার সময় তার বাবা রহস্যজনকভাবে মারা যান। তার মা অ্যাগরিপিনা দ্য এল্ডার, জার্মানিকাসের মৃত্যুর জন্য সম্রাট তিবেরিয়োসকে দায়ী করেছিলেন। তিবেরিয়োস শেষ পর্যন্ত অ্যাগরিপিনাকে বন্দি করে এবং ক্যালিগুলার দুই বড় ভাইকে রোম থেকে নির্বাসিত করে দেয়।

৩১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৩৭ খ্রিষ্টাব্দ অর্থাৎ তিবেরিয়োসের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, ক্যালিগুলা ক্যাপ্রি দ্বীপে তার সাথেই বসবাস করেন। পরবর্তীতে, তিবেরিয়োসের উত্তরাধিকারী হয়ে রোমের সম্রাট হিসেবে প্রিন্সেপ (‘প্রথম নাগরিক’ বা সম্রাট) উপাধি গ্রহণ করে ৩৭ খ্রিষ্টাব্দ-৪১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রোম শাসন করেন।

স্বেচ্ছাচারী শাসনব্যবস্থা

ক্যালিগুলা তার শাসনামলে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় কাজে অত্যধিক ব্যয় করেছিলেন। ক্যালিগুলা বন্দর, থিয়েটার, মন্দির, নির্মাণ এবং বাউলি উপসাগর জুড়ে ২ মাইল দীর্ঘ একটি ভাসমান সেতু নির্মাণ প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করেন। এই ব্যয়ের অর্থ জোগাড় করতে সব ধরনের প্রতারণা এবং বেআইনি পথ অবলম্বন করতে তার কোনও দ্বিধা ছিল না। উচ্চ কর নির্ধারণ, উত্তরাধিকারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা এবং বিশিষ্ট ধনী নাগরিকদের আইনি বাধার সম্মুখীন করা ইত্যাদি ছিল সাধারণ বিষয়। 

তার জীবনীকার সুয়েটোনিয়াসের মতে, ক্যালিগুলা নিজেকে একজন দেবতা মনে করতেন এবং প্রায়ই বলতেন, “মনে রাখবেন, যে কারো সাথে যেকোনো কিছু করার অধিকার আমার আছে।” তিনি সিনেটরদের অপমান করতেন, তাদের তার পিছনে দৌড়াতে বা তার বিনোদনের জন্য লড়াই করতে বাধ্য করতেন। তার পরামর্শদাতারা তার জন্মদিনের ঘোষণা দিতে ভুলে যাওয়ায়, তিনি তাদের পদচ্যুতও করেন। 

ক্যাস্টর এবং পোলোক্স-এর মন্দির, যা ক্যালিগুলার জন্য নিবেদিত ছিল Image source: wikipedia.org by Dcastor

সম্রাটের উদ্ভট খেয়াল

৩৯ এবং ৪০ সালে তিনি রাইন এবং ইংলিশ চ্যানেলে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু যুদ্ধ করা থেকে বিরত থেকে, সৈন্যদের হেলমেটে সামুদ্রিক প্রাণির শেল বা বহিরাবরণ সংগ্রহ করতে নির্দেশ দেন।

সমুদ্রের সাথে জড়িত আরেকটি উদ্ভট দৃশ্য নেপলস উপসাগরে ঘটে। সেখানে ক্যালিগুলা পুতেওলি থেকে বেয়াই পর্যন্ত উপসাগর জুড়ে একটি তিন মাইল দীর্ঘ অস্থায়ী সেতু নির্মাণের নির্দেশ দেন। বিপুল সংখ্যক বাণিজ্যিক জাহাজ সারিবদ্ধ করে এটি তৈরি করা হয়। তারপর তাদের উপরে একটি বিস্তৃত রাস্তা তৈরি করা হয়। শস্য বহনকারী এতো জাহাজকে এই কাজে ব্যবহার করায় রোমে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ক্যালিগুলা এই ব্রিজের ওপরে রোমান সেনাবাহিনীকে প্যারেড করার পাশাপাশি বিজয়ীবেশে বেশ কিছু দিন কাটিয়েছেন।

তিনি তুচ্ছ অজুহাতে সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করতেন এবং তা থেকে আনন্দ লাভ করতেন। একবার, একটি ষাঁড়ের বলিদানে সভাপতিত্ব করার সময়, পশুর কপালে হাতুড়ি নামাবার পরিবর্তে ক্যালিগুলা ইচ্ছাকৃতভাবে পুরোহিতের সহকারীকে হত্যা করেন।

ষড়যন্ত্রকারীদের পরিচিতি 

প্রথম শতাব্দীর ইহুদি ঐতিহাসিক ফ্ল্যাভিয়োস জোসেফাস ‘দ্য অ্যান্টিকুইটিস অফ দ্য ইহুদি’-তে লিপিবদ্ধ করেছেন যে, ক্যালিগুলা সব দিক থেকে শত্রুতার মুখোমুখি হয়েছিল। ইতিহাসবিদ ক্যাসিয়োস ডিও লিখেছেন, ক্যালিগুলার দরবারে কার্যত সবাই তাকে মৃত চেয়েছিলেন। এমনকি যারা সক্রিয়ভাবে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছিল না, তারাও সম্পত্তি এবং জীবনের অনিশ্চয়তার অবসান ঘটানোর আশায় নীরব সম্মতি দিয়েছিল । 

ক্যালিগুলার জীবন শেষ করার ষড়যন্ত্রে একই সাথে তিনটি ষড়যন্ত্রকারীদল জড়িত ছিল। একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন এমিলিয়াস রেগুলাস, যার সম্পর্কে খুব কম জানা যায়। অন্য একটি দলের নেতৃত্ব দেন আনিউস ভিনিসানুস, যিনি ৩৯ খ্রিষ্টাব্দের একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সাথে যুক্ত ছিলেন।

ক্যাসিয়াস সায়েরিয়া, প্রাইটোরিয়ান গার্ডের সদস্য (সম্রাটের নিকটতম সৈন্য) তৃতীয়টির নেতৃত্ব দেন।  ক্যালিগুলা তাকে জনসাধারণের সামনে অপমান এবং নিষ্ঠুর রসিকতার শিকার করেছিল বলে তার ক্ষোভ ছিল ধারণা করা হয়। তিনি সমর্থনের জন্য বিচারক এবং প্রাইটোরিয়ান গার্ডের একজন উচ্চপদস্থ  কর্মকর্তার শরণাপন্ন হন। 

প্রায়োটোরিয়ান গার্ড Image source: brewminate.com Photo by Eric Huybrechts, The Louvre Museum, Creative Commons

তবে সমর্থন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়ে, একজন বিশ্বস্ত সহকর্মী, কর্নেলিয়াস সাবিনাসের কাছে তার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। এই জুটি সম্রাটের জীবন শেষ করার চক্রান্তের প্রধান খেলোয়াড় হয়ে ওঠে। সুয়েটোনিয়াসের মতে, ২৪শে জানুয়ারি, ৪১ খ্রিষ্টাব্দে দুপুরের পর প্যালাটাইন গেমসে চক্রান্তকারীরা সম্রাটকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।  

হত্যা পরিকল্পনা 

প্রাথমিকভাবে আক্রমণটি খেলার প্রথম দিনের জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে জটিলতা এবং সিদ্ধান্তহীনতা তারিখটিকে খেলার চূড়ান্ত দিনে নিয়ে যায়। এদিকে আসন্ন বিপদের বিভিন্ন পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছিল। অ্যান্টিয়ামের ফরচুনার মন্দিরের ওরাকল বা দৈববাণী ক্যালিগুলাকে, সায়েরিয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য সতর্ক করেছিল। গণিতবিদ এবং জ্যোতিষী সুলা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, সম্রাটের একটি ভয়ংকর মৃত্যু হবে।  

খেলার শেষ দিনে প্যালাটাইন হিলে গেমের জন্য নির্মিত থিয়েটারের চারপাশে দর্শক জড়ো হতে শুরু করে। সেখানে ক্যালিগুলার একটি পারফরম্যান্সে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। ক্যালিগুলা অবশেষে থিয়েটারে এসে পৌঁছান। তিনি অগাস্টাসের উদ্দ্যেশে বলি দিয়ে দিনের উৎসবের সূচনা করেন। সায়েরিয়া, ক্যালিগুলার নিকটে এবং তার ষড়যন্ত্রকারীরা ভবনের ভেতরে এবং বাইরে অবস্থান করে।

প্যালাটাইন হিল Image source: wikipedia.org by Lil Herodotus

পরের দিন মধ্যাহ্নের কিছু পরে ক্যালিগুলা স্নান এবং মধ্যাহ্নভোজ করে উত্সবে ফিরে যাওয়ার জন্য থিয়েটার ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু যাত্রাপথে তিনি একটি দুর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার স্বাভাবিক সুরক্ষিত পথের পরিবর্তে একটি অন্ধকার, সরু, নির্জন পথ বেছে নেন। 

সেখানেই সায়েরিয়া ক্যালিগুলাকে তার তলোয়ার দিয়ে আঘাত করেন। ক্যালিগুলা পালানোর চেষ্টা করলে, সাবিনাস আরেকটি তলোয়ারের আঘাতে তাকে মাটিতে ফেলে দেয়। সুয়েটোনিয়াসের মতে, ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে ত্রিশ বার ছুরিকাঘাত করে। এমনকি, তিনি মারা যাওয়ার পরও আক্রমণ চালিয়ে যায়। বৈধ উত্তরসূরির কোনো সম্ভাবনা এড়াতে ক্যালিগুলার স্ত্রী এবং কন্যাকেও হত্যা করা হয়। মৃত্যুর পর, তার অনেক মূর্তি ধ্বংস বা বিকৃত করা হয়েছিল। মাত্র বিয়াল্লিশটি আবক্ষ মূর্তি এবং দুটি পূর্ণ প্রতিকৃতি মূর্তি আজও বিদ্যমান।

শিল্পীর চোখে ক্যালিগুলার হত্যা দৃশ্য Image source: wikipedia.org

রোমান সাম্রাজ্যের পরিণতি

হত্যার পর, স্যাটার্নিনাস এবং সেকেন্ডাসের নেতৃত্বে সিনেট রাজধানীতে বৈঠক করে। তারা এর নেতৃস্থানীয় সিনেটরদের মধ্য থেকে একজন নতুন সম্রাট নির্বাচন করতে চেয়েছিল। অনেকে অগাস্টাসের সময়ের প্রজাতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনী তাদের কৌশলে পরাস্ত করায় তাদের উচ্চাভিলাষী সিদ্ধান্তগুলো নষ্ট হয়ে যায়। 

ক্যালিগুলার চাচা ক্লডিয়াসকে, প্রাইটোরিয়ান গার্ডসম্যানদের একটি ইউনিট লুকিয়ে রেখেছিল। নিজেদের সুবিধা এবং সাম্রাজ্যিক শাসন বজায় রাখতে তারা এই ভীত সিনেটরকে সম্রাট ঘোষণা করার জন্য তাদের শিবিরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। 

সম্রাট ক্যালিগুলার অনেক উদ্ভট কাজের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। যদিও, পণ্ডিতরা এখনও বিতর্ক করছেন যে ক্যালিগুলার এইসব কাজের পেছনে কারণ হল, তিনি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ছিলেন। অনেকে বলেন, ইতিহাসবিদরা তার সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করেছেন। তবে সত্য যেটাই হোক না কেন, তা আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত ক্যালিগুলা ইতিহাসে নিষ্ঠুর এবং উন্মাদ এক সম্রাট হিসাবেই পরিচিত থাকবেন। 

Feature Photo: walksinsiderome.com

References:
1. About-Conservation/Caligula
2. Roman-Emperor-Believed-God-Assassinated
3. Ancient-History/Caligula
4. Caligula-the-Embodiment-of-Cruelty