বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদান!

6239
0

১৬ই ডিসেম্বর ছিল বাংলাদেশের ৫১তম বিজয় দিবস। এই বিজয় অর্জন করতে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি বাংলাদেশ পেয়েছিল অসংখ্য বিদেশি মিত্রকে। কোনো যুদ্ধই একা লড়া যায় না। যুদ্ধে শত্রু যেমন থাকে তেমনই মিত্রও থাকবে। যখন একটি জাতির স্বাধীনতা ঝুঁকিতে থাকে সেক্ষেত্রে তাদের মিত্রদের আচরণ এবং অবদানও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়। 

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে বিদেশি মিত্রদের ভূমিকা উদারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের এই বিদেশি প্রকৃত বন্ধুরা প্রয়োজনের সময় তাদের অসাধারণ সেবার জন্য স্বীকৃতিও পেয়েছে। 

২০১১ সালে বাংলাদেশ তার ৬৫০ বিদেশি বন্ধু এবং প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা তৈরি করে। এর মাঝে ২১টি দেশের ৩৩৮ জনকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সাত ধাপে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। তারা হলেন: ২২৫ জন ভারতীয়, ২৯ জন আমেরিকান, ১৭ জন পাকিস্তানি, ১৩ জন ব্রিটিশ, ১১ জন রাশিয়ান, ৯ জন নেপালি, ৮ জন জাপানি এবং ২ জন ফরাসি। এই ব্যক্তিদের তিনটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত করা হয়:

  • বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মান
  • বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মান
  • মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু সম্মান 

আনুষ্ঠানিক পুরষ্কারের অনুষ্ঠান অবশ্য ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়নি। ২০১৫ সালের জুনে যখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিজেপি নেতা এবং প্রাক্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর পক্ষে তাঁর সরকারী সফরের সময় এই পুরস্কারটি গ্রহণ করেছিলেন। 

মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগদানকারী বিদেশী বন্ধুদের অবদান

ইন্দিরা গান্ধী

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক দখল প্রত্যাহার করার জন্য সরকারি সহায়তা বর্ধিত করেছিলেন এবং সীমান্ত অতিক্রমকারী প্রায় ১০ মিলিয়ন উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। 

তিনি শরণার্থীদের আশ্রয়ের অনুমতি দিয়ে ভারতের পূর্ব সীমান্ত খুলে দিয়েছিলেন। যখন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করে, রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জেলে বন্দি হোন, তখন ভারত অস্থায়ী সরকার নিষ্পত্তি করতে সহায়তা করে এবং পরোক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।  

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিক সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনী সক্রিয়ভাবে ১৯৭১ সালের অক্টোবরের প্রথম দিক থেকে পাকিস্তানি সীমান্ত চৌকিতে মুক্তিবাহিনীদের (বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের) আক্রমণে সহায়তা করতে শুরু করে।

ইন্দিরা গান্ধী। Image Source: pinterest.com

অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড কেবল সীমান্ত রক্ষার জন্যই নয় বরং পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে দশ মাইল পর্যন্ত আক্রমণাত্মক অভিযান চালানোর নির্দেশ দেয়।

ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের জন্য সমর্থন জোগাড় করতে বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরতা বন্ধ করতে এবং তাদের উপর চাপ দেওয়ার জন্য বিশ্ব নেতাদের আবেদন করেছিলেন।  

নভেম্বরের মাঝামাঝি ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে সামরিক অভিযান আরও বাড়ানোর নির্দেশ দেন। ২১ নভেম্বরের মধ্যে সেই সংঘাত নতুন করে বৃদ্ধি পায়। ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কমান্ড গঠন করে, যাকে মুক্তিবাহিনীও বলা হয়। যার নেতৃত্ব ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিংয়ের অধীনে। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি সংসদে ঘোষণা করেছিলেন যে ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস 

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তাকারী ভিনদেশের এক পরম বন্ধু যিনি ১৯৭১ সালে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমতকে ঘুরিয়ে দিতে সাহায্য করেছিলেন। মাসকারেনহাস করাচির দ্য মর্নিং নিউজের সহকারী সম্পাদক ছিলেন, পাকিস্তানি সংবাদ প্রচারের জন্য সরকার তাকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল। 

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। Image Source: pinterest.com

মুক্তিযুদ্ধের নৃশংসতায় হতভম্ব হয়ে তিনি গণহত্যার ছবি সংগ্রহ করে ১৮ মে লন্ডনে পালিয়ে যান। ১৩ জুন ১৯৭১-এ তিনি লন্ডনের সানডে টাইমসে ‘জেনোসাইড’ শিরোনামে একটি ১৬ কলামের প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে হতবাক হয়ে যায় বিশ্ব। 

সেই রিপোর্টে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা, ভারতে উদ্বাস্তুদের আশ্রয়, দুর্ভিক্ষে অগণিত মানুষের মৃত্যু, হাজার হাজার নারী ধর্ষণ, শিশু হত্যা—সবই ফুটে উঠেছে। বিবিসি নিউজের মার্ক ড্রামেট তার ২০১১ সালের বিজয় দিবসের নিবন্ধে এটিকে ‘ইতিহাস পরিবর্তনকারী নিবন্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন।  

পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা তুলে ধরে দুটি বই প্রকাশ করেন যার শিরোনাম হলো: ‘দ্য রেপ অফ বাংলাদেশ’ এবং ‘বাংলাদেশ: অ্যা লিগ্যাসি অফ ব্লাড ওয়ার’।  

জে.এফ.আর. জ্যাকব 

লেফটেন্যান্ট জেনারেল জ্যাক ফার্জ রাফায়েল জ্যাকব ওরফে জে.এফ.আর. জ্যাকব ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অফ স্টাফ ছিলেন। জ্যাকব ‘আন্দোলনের যুদ্ধ’ পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলেন যা যুদ্ধ যখন চরমে তখন পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করার জন্য গৃহীত হয়েছিল। এই পরিকল্পনা মাত্র ১৫ দিনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঢাকায় অনুপ্রবেশ সফল করে। 

জে.এফ.আর. জ্যাকব সেই ব্যক্তি যিনি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক ‘আত্মসমর্পণের যন্ত্র’ বহন করেছিলেন এবং প্রতিপক্ষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ.একে. নিয়াজিকে ৩০ মিনিটের মধ্যে শর্ত মেনে নিতে বাধ্য করেছিলেন। 

জেনারেল জ্যাকব। Image Source: pinterest.com

জেনারেল জ্যাকব জেনারেল এ.একে. নিয়াজী এবং ঢাকায় অবস্থানরত তার ২৬,০০০ সৈন্যকে রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক জনসভায় আত্মসমর্পণ করান। 

তাছাড়া তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ক্যাম্প স্থাপন, শরণার্থী শিবির পুনর্গঠন, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও রসদ সরবরাহে ভারতীয় বাহিনীকে অনেক সাহায্য করেন যা বাংলাদেশের কাঙ্খিত বিজয়ে অবদান রাখে। 

উইলিয়াম এ.এস. ওডারল্যান্ড

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ডাচ-অস্ট্রেলিয়ান উইলিয়াম এ.এস. ওডারল্যান্ডকে বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু বলা হয়। তিনিই একমাত্র বিদেশি নাগরিক যিনি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক চতুর্থ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বীর প্রতীকে ভূষিত হোন।     

এ এস ওডারল্যান্ড। Image Source: liberation war archieve

ওডারল্যান্ড ১৯৭০ সালের শেষের দিকে বাটা শু কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে প্রথম ঢাকায় আসেন। তার যোগদানের কয়েক মাসের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং ওডারল্যান্ড নিজেকে যুদ্ধের সৈনিক হিসেবে আবিষ্কার করেন। প্রাথমিকভাবে তিনি একজন গোপন গোয়েন্দা এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন।

কারণ একজন বিদেশী হিসেবে তিনি সেনা সদর দফতরে সহজে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন বলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দখলদার বাহিনীর পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ডের কথা জানাতেন।

গেরিলা কমান্ডো হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার অভিজ্ঞতার সাহায্যে তিনি তখন ২ নম্বর সেক্টরের গেরিলা শাখার সক্রিয় সদস্য হোন। তিনি বাটা জুতার কারখানাসহ টঙ্গীর বিভিন্ন গোপন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।  

এছাড়া, দখলদার বাহিনীর নৃশংসতা ও গণহত্যার ঘটনার ছবি সংগ্রহ করে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে প্রেরণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির মাধ্যমে যুদ্ধের দিনগুলোর নথিভুক্ত করার চমৎকার কাজ করেছেন তিনি। 

সাইমন ড্রিং 

১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানি শাসকরা বিদেশী সাংবাদিকদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করছিল, তখন একমাত্র সাইমন ড্রিং গণহত্যার সাক্ষী হয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হোন। কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রায় ২০০ বিদেশী সাংবাদিককে আটকে রেখেছিল যাতে তারা নৃশংসতার সাক্ষী হতে না পারে। পরে তাদের করাচিতে পাঠানো হয়। তবে যিনি ফিরে গিয়েছিলেন তিনি ছিলেন ২৭ বছর বয়সী ব্রিটিশ রিপোর্টার সাইমন ড্রিং। 

সাইমন ড্রিং। Image Source: liberatin war archieve

যখন সাইমন ড্রিংকে পূর্ব পাকিস্তানের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি কভার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তখন তিনি ‘দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ’ এর রিপোর্টার ছিলেন। তিনি ৬ মার্চ ঢাকায় আসেন এবং রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ প্রত্যক্ষ করেন। 

২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিশ্ব মিডিয়াকে কোনো সংবাদ কভারেজ করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছিল তখন ড্রিং নিজেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ৩২ ঘন্টারও বেশি সময় লুকিয়ে রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। যাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতা সম্পর্কে বিশ্বকে জানাতে পারেন। 

২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়া হলে তিনি সামরিক টহল এড়িয়ে হোটেল ত্যাগ করেন। তিনি শহর ঘুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গণহত্যার আলামত সংগ্রহ করেন। পরে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের একটি ফ্লাইটে উঠতে সক্ষম হোন। অবশেষে তিনি ব্যাংকক পৌঁছান, তখন পর্যন্ত অনেক চেকিং হলেও কোনোভাবে তার নথিপত্রের ক্ষতি হয়নি।  

ড্রিং তার বিখ্যাত প্রতিবেদন ‘ট্যাঙ্কস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ এ লিখেছেন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের নৃশংস গণহত্যার প্রথম বিবরণ যা ৩০ মার্চ ১৯৭১ তারিখে ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল। 

সিডনি এইচ শ্যানবার্গ 

সিডনি এইচ শ্যানবার্গই প্রথম বিদেশী সাংবাদিক যিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার খবর বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এর দক্ষিণ এশিয়ার সংবাদদাতা ছিলেন।  

তিনি সেই অনেক বিদেশী সংবাদকর্মীদের মধ্যে একজন যারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বন্দি ছিলেন। গণহত্যা সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলেন এবং ২৬শে মার্চ সন্ধ্যা ৬:১৫ মিনিটের মধ্যে ঢাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হোন। 

মাঝে শ্যানবার্গ। Image Source: liberation war archieve

তবে এটি তাকে তার দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়নি। তিনি কলকাতা ও নিউইয়র্ক থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের উপর বর্বরতা উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকেন। 

১৯৭১ সালের জুন মাসে শানবার্গ দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর জন্য পূর্ব পাকিস্তানের শহরগুলো থেকে বেশ কয়েকটি প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দাখিল করেন। ফলে ১৯৭১ সালের ৩০ জুন পাকিস্তান তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে।  

স্যার উইলিয়াম মার্ক টুলি

স্যার উইলিয়াম মার্ক টুলি ১৯৭১ সালে বিবিসির ভারতীয় সংবাদদাতা ছিলেন। তিনি বিবিসির প্রাক্তন নয়াদিল্লি ব্যুরো প্রধান ছিলেন। 

মার্ক টুলি। Image Source: liberation war archieve

১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময়, যখন তৎকালীন পাকিস্তানি জান্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমগুলি সরকারী প্রচার চালাত। 

তখন বিবিসি রেডিওতে মার্ক টুলির যুদ্ধের কভারেজ ছিল জনগণের প্রামাণিক তথ্যের প্রধান উৎস।

তিনি বিবিসির জন্য বাংলাদেশের  যুদ্ধের দিনগুলি ব্যাপকভাবে কভার করেছেন এবং কাছাকাছি থেকে সেগুলি নথিভুক্ত করার সুযোগ পেয়েছিলেন।

এডওয়ার্ড কেনেডি

এডওয়ার্ড কেনেডি বা টেড কেনেডি যিনি ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ছোট ভাই।  

এডওয়ার্ড কেনেডি। Image Source: liberation war archieve

সেইসাথে তিনি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালনকারী সিনেটরদের একজন। 

তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পাশে না থেকে তার সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন করেছিলেন।  

বাংলাদেশের যুদ্ধের পরিস্থিতি পরিদর্শনের জন্য কেনেডি ভারতে যান।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করতে না পারায় ভারতের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করার পর তিনি শরণার্থী বিষয়ক সিনেটের বিচার বিভাগীয় কমিটির কাছে একটি কঠিন প্রতিবেদন জারি করেন।  

যদিও নিক্সন প্রশাসন তার অবস্থান বজায় রেখেছিল, তবুও কেনেডি অবিচল ছিলেন। যার ফলে পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধ করার জন্য একটি বিল মঞ্জুর করা হয়েছিল।  

অ্যালেন গিন্সবার্গ

আমেরিকান কবি আরউইন অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ রচনা করেছিলেন যা মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাসের হৃদয় বিদারক আবেগী যাত্রাকে চিত্রিত করেছিল। 

সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ একটি ১৫২ লাইনের দীর্ঘ কবিতা যা গণ-দুর্দশার বীভৎস চিত্রায়ণ। এখানে ‘সেপ্টেম্বর’ মাসটি মূলত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের একটি রূপক সময় এবং ‘যশোর রোড’ উদ্বাস্তুদের কঠিন সংগ্রামের একটি অদম্য উত্তরণ।  

অ্যালেন গিন্সবার্গ। Image Source: liberation war archieve

গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বাংলাদেশের যশোর ও ভারতের কলকাতার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করার পর কবিতাটি লিখেছিলেন। তিনি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ২০ নভেম্বর ১৯৭১ সালে নিউইয়র্কের সেন্ট জর্জ চার্চে কবিতাটি আবৃত্তি করেন। 

কবিতাটির গভীরতা দেখে তার বন্ধু পপ মিউজিশিয়ান বব ডিলান এটিকে একটি গানে পরিণত করেছিলেন। এরপর তিনি এটি একটি কনসার্টে পরিবেশন করেন যা বাংলাদেশী শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য তহবিল সংগ্রহে সাহায্য করেছিল। পরে গায়িকা মৌসুমী ভৌমিকও বাংলায় এই কবিতাটি পরিবেশন করেন। 

জর্জ হ্যারিসন এমবিই 

জর্জ হ্যারিসন, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিখ্যাত নাম, একজন ইংরেজ গায়ক, গীতিকার, সঙ্গীত এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক যিনি বিটলসের প্রধান গিটারিস্ট এবং মাঝে মাঝে প্রধান কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট প্রাক্তন বিটলস গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসন এবং ভারতীয় সেতার বাদক রবি শঙ্কর ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ শিরোনামে একজোড়া বেনিফিট কনসার্টের আয়োজন করেন। 

জর্জ হ্যারিসন। Image Source: pintereste.com

পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ত্রাণ সহায়তার জন্য নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠানটি দুপুর ২:৩০ এবং ৮:০০ টায় অনুষ্ঠিত হয়। 

কনসার্টে প্রায় চল্লিশ হাজার লোক অংশগ্রহণ করেছিল এবং বাংলাদেশের ত্রাণের জন্য ২,৫০,০০০ মার্কিন ডলারের কাছাকাছি তহবিল সংগ্রহ করে। হ্যারিসন তার ‘বাংলাদেশ’ গানের জন্য বাংলাদেশীদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়েছিলেন। 

আন্দ্রে ম্যালরাক্স 

আন্দ্রে ম্যালরাক্স বাংলাদেশের অন্যতম প্রিয় বন্ধু যিনি মুক্তিবাহিনীর সাথে শারীরিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ফ্রান্সের অবস্থান গঠনে ম্যালরাক্সের ভূমিকা ছিল। ১৯৭১ সালের জুলাইতে ভারতের অহিংস আন্দোলনের নায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ বাংলাদেশে যুদ্ধকালীন বর্বরতা সম্পর্কে বিশ্ব সম্প্রদায়কে জানাতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের জন্য আন্দ্রে ম্যালরাক্সের সাথে যোগাযোগ করেন। 

আন্দ্রে ম্যালারক্স। Image Source: pinterest.com

বাংলাদেশের ঔপন্যাসিক, লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানও মালরাক্সকে ‘বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধ পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাংলাদেশে নিরীহ মানুষদের গণহত্যা বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানে তার  অফিস ব্যবহার করার সাথে সাথে ম্যালরাক্স রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনকে একটি চিঠিও লিখেছিলেন। 

এছাড়াও ম্যালরাক্স তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিপীড়িত জনগণের জন্য লড়াই করতে একটি আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের ২৩-২৪ এপ্রিলে সফরের সময় বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করেন।

 

Feature Image: Photography by Raghu Ray
References: 

01. Bangladesh to honor 226 Indians for their role in the 1971 liberation war. 
02. Foreign friends 197103. Role of USA soviet union and china in liberation 1971