প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে সবচেয়ে কৌতূহলের এবং রহস্যময় জগত হচ্ছে পানির তলদেশের জগত। স্বাভাবিকভাবেই যা আমরা খুব সহজেই চোখে দেখতে পাই না তা নিয়ে বেশ ভালোই কৌতূহলের জন্ম দেয়। মানুষের এই কৌতূহলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় বিভিন্ন সমুদ্র, নদী। এর নিচে কি আছে তা জানার জন্য সবাই যেন মরিয়া হয়ে থাকে। পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে পানির নিচে। এই অদেখা সৌন্দর্য উপভোগ করতে সবারই কমবেশি পিপাসা থাকে।
উপরের জগত আর পানির নিচের জগতটায় বেশ ভালোই পার্থক্য বিদ্যমান। পানির তলদেশের এই রহস্যে ঘেরা এক জায়গার নাম সিলফ্রা। এটি সিলফ্রা ফিশার নামেও বেশ পরিচিত। সিলফ্রার তলদেশ নিয়ে অনেক অনেক ইতিহাস, গল্প আছে। চলুন জেনে নেয়া যাক সেসব মজার ইতিহাস ও গল্পগুলো।
অবস্থান
এমন যদি হয় আপনি পানির নিচে, আর অনায়াসে স্পর্শ করতে পারছেন দুই দুইটি মহাদেশ, ঠিক কেমন অনুভূতি হবে আপনার? ভাবতেই কেমন রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছে, তাই না?
সিলফ্রা ফিশার এমনই একটি জায়গা যেখানে আপনি স্পর্শ করতে পারবেন দুইটি মহাদেশ যথাক্রমে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপ মহাদেশ। মূলত আইসল্যান্ডের থিংভিল পার্কের একটি লেকে সিলফ্রা ফিশারটি অবস্থিত। মজার ব্যপার হচ্ছে, এই সিলফ্রা ফিশারটি মাত্র ১ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত।
এই সিলফ্রা কিন্তু একদিনে সৃষ্টি হয়নি! এই সৃষ্টির পেছনে এক অদ্ভুত গল্প জড়িয়ে আছে। সিলফ্রা ফিশার মূলত উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের ঘটিত এক ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট এক ফাটল; যা একসময় মনোরম পরিবেশ বা অন্যতম সৌন্দর্যে পরিণত হয়।
তবে সিলফ্রা পরিচিতি লাভ করে এতে ডাইভ করার কারণে। আর একজন সিলফ্রাতে ডাইভ করে তখন অনায়াসে সে একইসাথে দুইটি মহাদেশ স্পর্শ করতে পারে যা অত্যন্ত এডভেঞ্চারের অনুভূতি দেয় এবং একই সাথে এক অনন্য ইতিহাসের সাক্ষী থাকা যায়।
জনপ্রিয়তার কারণ
সিলফ্রা প্রধানত পরিচিতি লাভ করে দুটি কারণে। কারণগুলো জানতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে। উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের মধ্যে যখন ভূমিকম্পের কারণে ফাটল সৃষ্টি হয় সেই ফাটলে মহাদেশের প্লেটগুলো মিলিত হয়।
আশ্চর্যের ব্যপার হচ্ছে, প্রতি বছরই প্রায় ২ সে.মি. করে এই প্লেটগুলো এর নিজ অবস্থান থেকে দূরে সরে যায়। পৃথিবীর একমাত্র স্থান হিসেবে সিলফ্রাকে বিবেচনা করা হয়েছে যেখানে আপনি সরাসরি সাঁতার কাটতে পারবেন।
এছাড়া অন্য একটি কারণ হচ্ছে সিলফ্রা ফিশারের পানি! জানা যায়, এর পানি এতটাই স্বচ্ছ যে, কেউ সাঁতার কাটার সময় তা পানও করতে পারবে। এবং অধিক স্বচ্ছতার কারণে প্রায় ১০০ কি.মি. নিচে এর গভীরতা দৃশ্যমান!
এই স্বচ্ছতার কারণ হিসেবে জানা যায়, সিলফ্রার তাপমাত্রা থাকে প্রায়ই ২ সে. থেকে ৪ সে. পর্যন্ত। আরেকটি আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই পানি প্রায় ৩০-১০০ বছর পর্যন্ত পোরাস ভূগর্ভস্থ লাভার সাহায্যে ফিল্টার হতে থাকে। আর এই ভূগর্ভস্থ থেকেই এই স্বচ্ছ পানি প্রবাহিত হয়ে আসে থিংভিলের লেকে যা চমৎকার একটি ধারা হিসেবে অব্যহত আছে।
এখন আসা যাক আসল কথায়! যদি কেউ এই সিলফ্রাতে প্রবেশ করতে চায় তারা প্রথমেই দেখা পাবে ‘টয়লেট বোল’ নামক জায়গার। এই জায়গা দিয়েই ডুবুরীরা সিলফ্রা ফিশারের প্রধান অংশে প্রবেশ করতে পারেন। তবে বর্তমানে এর অস্থিতিশীলতার জন্য আর অনুমতি দেয়া হয় না। তারপরেও এটি সিলফ্রার একটি প্রধান অংশ হিসেবেই গণ্য করা হয়ে থাকে। কেননা এটি সিলফ্রার সাথে সংযুক্ত যা সিলফ্রার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সিলফ্রা মোট পাঁচটি বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম যে অংশে প্রবেশ করা হয় তা বিশাল ক্র্যাক হিসেবে পরিচিত। এই অংশটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০ মিটার এবং এটি সিলফ্রার সবচেয়ে গভীরতম স্থান বলা হয়ে থাকে। সিলফ্রার সবচেয়ে গভীরতম অংশটি ধারণ করে এর ৬২ মিটার অবস্থানে।
জানা যায়, এখানে বেশ কিছু পরিমাণে খালি পাথর থাকার কারণে এটি ঝুঁকিযুক্ত স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত হয় এবং এক সময় একে নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষিত করা হয়। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এতে পতনেরও বেশ ভালোই সম্ভাবনা আছে। ১৯৯৮ সাল নাগাদ আমেরিকার এক দল ডুবুরীদের সাহায্যে এটি ম্যাপের আওতায় আনা গেলেও পরবর্তি কোন ভূমিকম্পে তা পরিবর্তন হয়েছে কিনা জানা যায়নি।
এই চমৎকার সিলফ্রাতে কিন্তু ভয়ংকর গল্পেরও সাক্ষী আছে। মাত্র এক কিলোমিটার অবস্থান নিয়ে অস্তিত্ব থাকলেও বেশকিছু গল্প জুড়ে আছে যা জানলে হয়তো পুরো ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে।
সিলফ্রার দ্বিতীয় অংশ মূলত সিলফ্রা হল নামে পরিচিত। এই অংশ থেকেই ফিশারটি প্রথম প্রসারিত হয় যার গভীরতা প্রায় ১০ মিটার, দৈর্ঘ্য ৫০ মিটার এবং প্রস্থ ৮ মিটার। এই সিলফ্রা হল থেকেই ক্যাথিড্রালের শুরু।
ক্যাথিড্রাল এমন একটি অংশ যেখান থেকে যে কেউ প্রায় ১০০ মিটার পর্যন্ত এর স্বচ্ছতা উপভোগ করতে পারবে। এটি এমন এক স্থান যা পৃথিবীর আর কোন স্থানে এতো দৃশ্যমান লক্ষ্য করা যায়নি।
এই ক্যাথিড্রালের শেষ অংশটিই ভয়ংকর অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। এখানে ডুবুরীরা বেশ সাবধানতা অবলম্বন করে চলে। কেননা এখানকার পানি আপনাকে নিচ থেকে ঠেলে উপরের দিকে তুলতে চাইবে যা বেশ বিপদজনক অবস্থায় পরিবর্তিত হয়। ক্যাথিড্রালের এই অংশের বাম দিকে ঘুরলেই সিলফ্রা ফিশারের শেষ অংশটি খুব সহজেই চোখে পড়বে।
সিলফ্রার আরেকটি অংশ হচ্ছে সিলফ্রা ল্যাঙ্গুন। সাধারণত এই অংশে যে কেউ প্রায় ১২০ মিটার পর্যন্ত পানির দৃশ্যমান লক্ষ্য করতে পারবে। এই অংশের পানি বেশ নীল হয় এবং তা পরিবর্তিত হয়ে হালকা ফিরোজা রঙে রূপান্তরিত হয়। এটি উপভোগ করতেই প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক সিলফ্রা ফিশারে আসেন এর সৌন্দর্য পান করতে। এই সিলফ্রা ল্যাঙ্গুন অংশটিই মূলত সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় অংশ হিসেবে নজর কেড়েছে সারা বিশ্বের মানুষদের।
পানির নিচেই যে এক অদ্ভুত জগত থাকে বা থাকতে পারে তা সিলফ্রা না থাকলে হয়ত জানাই হতো না। সিলফ্রার একেকটা অংশই কিন্তু সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর নিচে স্কুবা ডুবুরীরা সৌন্দর্য পানের পাশাপাশি সিলফ্রা নিয়ে নানান তথ্য দিয়ে সাহায্য করে থাকেন। জানা যায় এই সিলফ্রাতে নানান বয়সী স্কুবা ডুবুরীদের দেখা যায় যারা একেক সময় চমৎকার এবং ভয়ঙ্কর উভয়ই খুঁটিনাটি তথ্য দিয়ে এসেছেন।
চমৎকার এই সিলফ্রা ফিশারটি স্বচ্ছ পানির কারণে বেশ বিখ্যাত। এছাড়া এর সৌন্দর্যের কারণে প্রাকৃতিক ও ভূতাত্ত্বিক স্বতন্ত্রতার কারণে ইউনেস্কো থিংভেলিকে ‘ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করে।
এই অত্যন্ত সুন্দর ফিশারটিতে মাঝে মাঝে মাছও দেখা যায়। যদিও তা খুব কম কিন্তু এর গ্রীষ্মকালীন ঋতুর কারণে পাথরে শ্যাওলা জমে থাকার কারণে তখন অন্য এক সৌন্দর্যে রূপান্তরিত হয়ে থাকে। সম্প্রতি এক ফটোগ্রাফার ডক্টর আলেকজান্দ্রার মাস্টার্ড তার ফটোগ্রাফির সাহায্যে সিলফ্রার বেশ কিছু সুন্দর ছবি প্রকাশ পায়।
তিনি সামুদ্রিক অণুজীব বিজ্ঞানী এবং একজন লেখকও। তিনি সিলফ্রার ছবি তুলতে প্রায় ৮০ মিটার নিচে ভ্রমণে বের হয়েছিলেন এবং সাধারণ মানুষের জন্য এবং নিজের শখের নেশায় অসাধারণ কিছু ছবি তুলে আনেন। তার ভাষ্যমতে, তিনি বেশ কিছু নদীর নিচে গিয়েছিলেন কিন্তু সিলফ্রার মতো সুন্দর ফিশারের সন্ধান আগ পাননি বা দেখেননি! আসলে সিলফ্রার পরিষ্কার, স্বচ্ছ ও নীলাভ রঙই তাকে বেশি আকৃষ্ট করেছিলো।
বর্তমানে থিংভেলির এই লেকটি আইনগতভাবে নিয়ন্ত্রিত আছে। ডুবুরীরা চাইলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে সময় কাটাতে পারবেন। এখানে ডুবুরীদের জন্য সকল প্রকার সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা আছে যা খুব সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যায়। মাত্র ৩৫-৪০ মিনিট সময়ে কেউ চাইলেই ঘুরে আসতে পারে এক অভিনব, চমৎকার পানির জগতে যা যে কারোরই এক অন্যতম অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়ক হয়ে থাকবে।
Feature Image: pinterest.com Reference: 01. Silfra. 02. Silfra Snorkeling Review.