দিনা সানিচার: বাস্তবের মোগলির গল্প

422
0

প্রকৃতি আর মানুষের সম্পর্কের অবিশ্বাস্য গল্প আছে অনেক। সৃষ্টির শুরু থেকে যে অবিচ্ছেদ্য যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার গতিপথ বদলেছে বহুবার। কিন্তু, প্রকৃতি তার পুরো রহস্য উন্মোচন করেনি কখনো। বরং প্রতিবারই আমাদের অবাক করেছে।

এই পুরনো সম্পর্ক থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই রুডইয়ার্ড কিপলিং রচনা করেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য জাঙ্গাল বুক’। কিন্তু, গল্পের পেছনের সত্য ঘটনা ছিল অপ্রত্যাশিত। বাস্তব জীবনের মোগলি অর্থাৎ দিনা সানিচারের জীবন আড়ালেই রয়ে গিয়েছে। 

দ্য জাঙ্গাল বুক

এটি এক বালকের গল্প। যাকে তার বাবা-মা জঙ্গলে হারিয়ে ফেলে এবং পরবর্তীতে নেকড়েরা তাকে লালনপালন করেন। বালকটির নাম লেখক দিয়েছিলেন মোগলি। পশুদের রাজ্যের নিয়মকানুন শেখানো হয়েছিল মোগলিকে। কিন্তু মোগলি কখনোই শেখেনি কীভাবে অন্য মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। 

কিপলিং-এর এই বিখ্যাত গল্প, পরে ডিজনির বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করা হয়। নিজেকে আবিষ্কার এবং মানব সভ্যতা ও প্রকৃতির মধ্যে সম্প্রীতি সম্পর্কে একটি ইতিবাচক বার্তা দিয়ে এর সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু, বাস্তবতা কল্পনাকেও হার মানায়। খুব কম মানুষই জানেন যে, এটি দুঃখজনক সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। 

‘দ্য জঙ্গল বুক’ এর প্রথম সংস্করণ। Image source: wikimedia.commons

ফেরাল চাইল্ড বা বন্য শিশু

বন্য প্রাণিরা মানব শিশুদের লালনপালন করেছে, ইতিহাসে এরকম ঘটনা আরো ঘটেছে। এই ধরনের শিশুরা ‘ফেরাল চিলড্রেন’ বা ‘বন্য শিশু’ নামে পরিচিত। সানিচার সেই সময়ে পাওয়া একমাত্র বন্য শিশু ছিল না। সেই সময়ে ভারতের বিভিন্ন অংশে আরো চারটি শিশু পাওয়া গিয়েছিল এবং বছরের পর বছর ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে আরো অনেক ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। 

দিনা সানিচার

১৮৬৭ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের বুলন্দ শহর জেলায় আর সব দিনের মতোই শিকারিরা শিকারে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু, সেদিনটি ছিল ভিন্ন। শিকারের এক পর্যায়ে তারা ঘন জঙ্গলের মাঝে, গুহার মুখে একটি ছয় বছরের শিশুকে খুঁজে পায়। তারা ধারণাও করেনি, নেকড়েদের এই গুহায় কোনো জীবিত মানুষের অস্তিত্ব থাকতে পারে। 

কিন্তু শিশুটিকে সেখানে ছেড়ে আসা তারা ঠিক মনে করেনি। তাই তারা ঠিক করে, শিশুটিকে উদ্ধার করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। শিকারিরা গুহার মুখে প্রথমে ধোঁয়ার সৃষ্টি করে সবগুলো নেকড়েকে বের করে আনে। এমনকি শিশুটিকে উদ্ধার করতে একটি নেকড়েকে হত্যাও করতে হয়েছিল। 

এরপর তারা শিশুটিকে আগ্রার কাছে ‘সিকান্দ্রা মিশন অনাথ আশ্রমে’ নিয়ে যায়। সেখানে তার নাম রাখা হয় সানিচার, উর্দুতে এর অর্থ শনিবার। কারণ সেদিনই তাকে পাওয়া গিয়েছিল। ধারণা করা হয়, এই দিনা সানিচার পরবর্তীতে মোগলির চরিত্রের জন্য রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেন। 

দিনা সানিচার। Image source: Wikimedia Commons

অনাথ আশ্রমে দিনা সানিচারের জীবন

এরকম পরিবেশের শিশুদের প্রায়শই শুধু মৌলিক সামাজিক দক্ষতার অভাব হয় না, বরং স্বাভাবিক কাজ যেমন সোজা হয়ে হাঁটতেও সমস্যা হয়। আশ্রমের প্রধান ফাদার এরহার্ড, সানিচারকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সানিচার কথা বলতে পারতো না এবং নিঃসন্দেহে স্বাভাবিক আচরণ করতো না। তবে মাঝে মাঝে যৌক্তিক আচরণ, এমনকি কিছুটা বুদ্ধির প্রদর্শন করতো। 

সানিচার নেকড়ের মতো শব্দ করতো, হামাগুড়ি দিয়ে চারদিকে হেঁটে বেড়াতো, কাঁচা মাংস খেতো এবং পশুর মতো হাড় কামড়ে দাঁত তীক্ষ্ণ করতো। এতিমখানার লোকজন তার সাথে ধৈর্য ধরে কাজ করার চেষ্টা করেছিল। তারা সানিচারকে সাংকেতিক ভাষা শেখানোর চেষ্টা করেছিল। পাশাপাশি, নির্দিষ্ট বস্তুর দিকে ইঙ্গিত করে নাম শেখানোর চেষ্টা করেছিল। 

দিনা সানিচার হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে বেড়াতেন। Image source: thoughtnova.com

কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। মনে হতে পারে, কুকুররাও সময়ের সাথে এটি শিখে যায়। কিন্তু কুকুর গৃহপালিত এবং হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের আচরণ দেখে শিখেছে। অপরদিকে, নেকড়ে বন্য প্রাণি এবং এসব শিখতে অক্ষম। 

তাই, সানিচারকে যেকোনো ধরনের ভাষা বলতে বা বুঝতে শেখানো অসম্ভব ছিল। তাছাড়া গবেষণা দেখায় যে, মানুষের একটি ভাষা শেখার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। যেটা ৫ বছর বয়সের পর কমতে শুরু করে। 

সানিচার তার সারা জীবন এতিমখানায় কাটায় এবং সামান্য উন্নতি দেখায়। সানিচার দাঁড়াতে, হাঁটতে, ঠিকমতো পোশাকও পরতে শিখে গিয়েছিল একসময়। এক পর্যায়ে প্লেট থেকে খাওয়াও শুরু করে। কিন্তু খাওয়ার আগে সবসময় খাবার শুঁকতো, যেমনটা নেকড়ে করে থাকে।   

সানিচার অন্য একটি বন্য শিশুর সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করেছিল। তারা প্রায়ই একসাথে খেলতো এবং সানিচার তাকে কাপ ধরে তা থেকে পান করতে শেখাতো। এটা স্পষ্ট যে, দিনা সানিচার মানুষের আশেপাশে যতটা স্বাভাবিক ছিল, তার চেয়ে অন্য বন্য শিশুদের কাছাকাছি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে ছিল। কিন্তু, সে কখনোই কথা বলতে বা যোগাযোগ করতে শিখতে পারেনি। 

শেষ পরিণতি 

সানিচার তার জীবদ্দশায় শুধু একটি অভ্যাস শিখেছিল। আর তা হলো ধূমপান। এক পর্যায়ে চেইন স্মোকারে পরিণত হোন। অনুমান করা হয় যে, ৩৪ বছর বয়সে ১৮৯৫ সালে তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মানব আচরণ এবং পশু প্রবৃত্তির মধ্যকার ব্যবধানটি দিনা সানিচারের পক্ষে কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি কখনো। তার গল্পের সমাপ্তি ডিজনি মুভির মতো হয়নি। 

কিছু কথা 

দিনা সানিচার ছিল একজন সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তিত্ব। নেকড়েদের মাঝে বেড়ে উঠেছিল এবং তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ গঠনমূলক বছরগুলো জঙ্গলে কাটিয়েছিল। যদিও শিকারিরা তাকে একটি অনাথ আশ্রমে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সে কখনোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি।  

দ্য জাঙ্গাল বুক মুভির পোস্টার। Image Source: wikimedia.commons

সানিচারকে জঙ্গল থেকে বের করা হলেও, জঙ্গল তার ভেতর থেকে বের হয়নি। দিনা সানিচারের গল্প আমাদের দেখায় যে সভ্যতা সহজাত কিছু নয়, এটি শিখতে হয়। তার গল্প আমাদের শেখায় যে, সবচেয়ে হিংস্র প্রাণিরাও হয়তো মানুষের কাছাকাছি আসতে পারে। তবুও, দিনা সানিচারের গল্প আমাদের মনে প্রশ্ন তৈরি করে। মানুষ হওয়ার আসল অর্থ কী? কেন এই শিশুরা এমন হয়ে উঠল? এটা কি মানব প্রকৃতির অন্তর্নিহিত কিছু না কি নতুন কোনো রহস্য? 

দিনা সানিচারই কি মোগলি চরিত্রের প্রেরণা না কি এ বিষয়েও সন্দেহ রয়েছে। কিপলিং বিভিন্ন স্থান থেকেই প্রভাবিত হয়েছেন বলা চলে। তবে, দিনা সানিচারের জীবন যতটা রহস্যে আবৃত ছিল, তার চেয়ে বেশি দুর্ভাগ্যজনক ছিল। প্রশ্ন থেকেই যায়, কিন্তু উত্তর পাওয়া যায় না। প্রকৃতির রহস্য জানার চেষ্টা হয়তো সবসময় করা ঠিক নয়। 

 

Featured Image: wikimedia.commons 
References:

01. Dina-Sanichar. 
02. Real-Life-Mowgli-Dina-Sanichar. 
03. Life-of-Dina-Sanichar. 
04. Dina-Sanichar-Story.