দ্য ব্ল্যাক টাইগার: ভারতীয় গুপ্তচরের পাকিস্তানী মেজর হয়ে ওঠা!

444
0

গোয়েন্দাগিরি বা গুপ্তচরবৃত্তি বলতে অধিকাংশ সময়েই এম আই সিক্স, সি আই এ অথবা মোসাদের মতো পশ্চিমা ও আমেরিকান মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের কর্মকান্ড উঠে আসে। তবে এশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়ার গুপ্তচরগণ যে পিছিয়ে আছেন তা কিন্ত নয়। বাংলাদেশের ‘ডিজিএফআই’ কিংবা পাকিস্তানের ‘আইএসআই’ ও ভারতের ‘র’ এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স।

উক্ত সংস্থাগুলোতে রয়েছে অনেক দেশপ্রেমিক। যাদের কথা মিডিয়া কিংবা অন্য কোথাও তেমন একটা উঠে আসে না, হয়তো অন্যান্য দেশনায়কের মতো সেটি উঠে আসার কথাও না। তবে এসব সংস্থায় এমন কিছু সদস্য দেখা যায় যারা কিনা দেশের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে কুন্ঠা বোধ করেন না।

এমন এক গোয়েন্দা ছিলেন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র)-এর রবিন্দ্র কৌশিক। আজকের আয়োজনে আলোচনা হবে এই সাধারণ ভারতীয় নাগরিক কিভাবে দেশের ব্ল্যাক টাইগারে পরিণত হলেন তা নিয়ে।

Research and Analysis Wing - Wikipedia
রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং এর লোগো। Image Source: Wikimedia.commons

রবিন্দ্র কৌশিকের জন্ম রাজস্থানের শ্রীনগরে। অন্যান্য গুপচরদের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে তাদের বেশিরভাগই ছোটবেলা থেকেই গোয়েন্দাগিরি কিংবা দেশের সামরিক বাহিনীতে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করতেন বলেই পরবর্তীতে সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতেন।

তবে রবিন্দ্র কৌশিকের ব্যাপারটা ভিন্ন। অভিনয় করতে ভালোবাসতেন তিনি। এমনকি অনেক থিয়েটার ও ড্রামাতে তার অভিনয়কর্ম দর্শকদের চোখ জুড়িয়েছে। বলা হয় তাকে অনেকে বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা ভিনোদ খান্নার নামেও আখ্যা দিতেন।

পৃথিবীর মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সগুলো সাধারণত মানুষের নানা গুণকে কাজে লাগিয়ে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়। ইসরায়েলের এলি কোহেনের ঘটনাটার কথাই বলা যায়; তার আরব সংস্কৃতি সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্যই মোসাদ তাকে দলে ভিড়িয়েছিল।

Commemorating Ravindra Kaushik: One of India's best spy, who joined the Pak Army, saved thousands in '71 war - IBTimes India
রবিন্দ্র কৌশিক। Image Source: IBTimes India

রবিন্দ্র কৌশিকের ব্যাপারটাও ঠিক তাই। ভারতের ‘র’ কৌশিকের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে পড়ে। আসলে যারা কোন ত্রুটি ছাড়া নাটক করতে পারেন তাদের গোয়েন্দা হওয়াটা আরো সহজ হয়ে পড়ে।

কৌশিকের অসাধারণ অভিনয় দেখে ‘র’ তার সাথে কয়েক দফা সাক্ষাৎ করে। অবশেষে কৌশিক দিল্লিতে ‘র’-এর অফিসারদের সাথে দেখা করে দেশকে সেবা করতে রাজি হয়ে যায়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে,

হঠাৎ এভাবে যে কেউ কি এত
বড় কাজের জন্য রাজি হতে পারে?

Ravindra Kaushik (RAW Agent) Wiki, Age, Wife, Death, Family, Biography & More - WikiBio
অভিনয় করার সময়ে কৌশিক। Image Source: Wikibio.com

আসলে রবিন্দ্র কৌশিকের পরিবার পূর্ব থেকেই সামরিক বাহিনীর সাথে জড়িত। তার বাবা ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাথে যুক্ত ছিলেন। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে কৌশিক কোন কিছু না বুঝেই ‘র’-তে যোগদান করার মত দেন। তবে দিল্লিতে যাওয়ার পর তিনি সম্পূর্ণ অবস্থা বুঝার পরও দেশের জন্য জীবন বাজি রাখতে পিছপা হোননি।

‘র’ মূলত তাকে পাকিস্তানের পাঞ্জাবে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করার জন্যই বাছাই করে। ১৯৭৫ সাল থেকে ৭৭, দুই বছর যাবত রবিন্দ্র কৌশিককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দিল্লিতে প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে তাকে উর্দু ,পাঞ্জাবি, মুসলিম সংস্কৃতির খুঁটিনাটি তো আছেই এমনকি কোরআন শিক্ষাও দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানের অবস্থা একটু সংকটাপন্ন ছিল। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে হার এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রটি কোন ধরণের পদক্ষেপ নিতে পারে সেটি জানা ভারতের জন্য খুব দরকার ছিল।

Indo-Pakistani War of 1971 - Wikipedia
৭১ সালে পাকিস্তানের আত্নসমর্পণের চিত্র। Source: Wikimedia.commons

সে যাই হোক, ২ বছরের প্রশিক্ষণ শেষে সরাসরি কৌশিককে পাকিস্তানে পাঠানো হয়নি। এর পূর্বে ছয় থেকে সাত মাস পরীক্ষণের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে, রবিন্দ্র কৌশিকের পরিবার তার ‘র’-তে যোগদান সম্পর্কে অবগত ছিল না। দেশের সেবা করার জন্য সে পরিবারের কাছে মিথ্যা বলেন এবং জানান যে তিনি দুবাইতে চাকরি করবেন।

অন্যান্য দেশে পরীক্ষণের পর কৌশিককে পাকিস্তান পাঠানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। পাকিস্তানে প্রবেশকালে তার নাম দেওয়া হয় ‘নবি আহমেদ শাকির’। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য এমন নতুন পরিচয় তৈরি করা কোন ব্যাপার না বলা চলে। যে কথা সেই কাজ, পাকিস্তানের আইডি, পাসপোর্ট সব কিছুই কৌশিকের জন্য তৈরি হয়ে যায়।

পাকিস্তানে প্রবেশ করেই তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের এল. এল. বিতে ভর্তি হোন। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবেই কাজ করা ছিল তার লক্ষ্য।

Story of RAW agent, Ravinder Kaushik, who worked as a Pakistan Army Major - Forgotten hero | The Economic Times
যুবক কৌশিক। Image Source: The Economic Times

তবে হঠাৎ একদিন তিনি খবরের কাগজ পড়াকালে দেখেন যে পাকিস্তান মিলিটারিতে সদস্য নিয়োগ হচ্ছে। কৌশিক তথা আহমেদ শাকির সেই চাকরিতে আবেদন করেন এবং পাকিস্তান মিলিটারিতে অডিটর পদে যুক্ত হয়ে পড়েন।

অর্থাৎ ‘র’-এর পরিকল্পনার চেয়ে আরো খুব ভালো অবস্থানে অল্প সময়ে উন্নীত হোন। এরপর তার জীবনে মোড় নেওয়া শুরু করে। মিলিটারিতে ঢুকার পর থেকেই তিনি নানা তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন।

কৌশিকের স্ত্রী আমানত। Image Source: sccopwhoop.com

এরই মাঝে তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হোন এবং পাকিস্তান মিলিটারির একজন সদস্যের মেয়ে ‘আমানত’-কে বিবাহ করেন।

যদিও এই বিবাহ গোয়েন্দাগিরির স্বার্থে নয় বরং কৌশিকের ব্যক্তিগত ইচ্ছাতেই হয়। এছাড়াও, ‘র’ এই বিবাহে কোন আপত্তি জানায়নি।

ক্রমেই ‘র’-এর কাছে কৌশিক পাকিস্তান বাহিনীর তথ্য পাঠাতে থাকেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল পাকিস্তান সরকারের ‘অ্যাটমিক প্ল্যান’। তার এই তথ্য জানানোর জন্য পরবর্তীতে তাকে ‘ব্ল্যাক টাইগার’ উপাধি দেওয়া হয়।

অপরদিকে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেও খুব ভালো কাজ করতে থাকায় তিনি মেজর পদে নিযুক্ত হোন। এতে করে তথ্য পাঠানো আরো সহজ হয়ে পড়ে।

১৯৮১ সালের দিকে কৌশিকের ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়। তার ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য তিনি ভারত ভ্রমণ করেন।

তবে এটা সরাসরি ভ্রমণ ছিল না। দুবাই হয়ে তাকে ভারত যেতে হয়েছিল। নয়তো তার পরিচয় প্রকাশ হয়ে যেতে পারতো। গোয়েন্দা হিসেবে যুক্ত হওয়ার পর এটিই ছিল পরিবারের সাথে তার প্রথম এবং শেষ সাক্ষাৎ।

তাহলে কি পাকিস্তানে ফেরার সময়েই
কৌশিক ধরা পড়ে গিয়েছিল?

আসলে উত্তরটি সেটি নয়। গোয়েন্দা দু’প্রকার হয়ে থাকে। একটি শর্ট টার্ম এবং আরেকটি লং টার্ম। কৌশিক মূলত দ্বিতীয় প্রকারের। কৌশিককে কিছু ডকুমেন্ট হস্তান্তর করার জন্য ভারতের ‘র’ আরেকজনকে পাকিস্তান পাঠাচ্ছিল।

The much Awaited Biopic of India's Biggest Spy –Shaheed RAVINDRA KAUSHIK The Black Tiger Is Finally On The Pro duction Stage - Social News XYZ
রবিন্দ্র কৌশিক। Image Source: Social News XYZ

ইনায়াত মাসিহ ছদ্মবেশধারী সেই ‘র’ এজেন্ট পাকিস্তানে প্রবেশ করার সময় বর্ডারে ধরা পড়ে। পাকিস্তান মিলিটারি ব্যক্তিটিকে রিমান্ডে নেওয়ার পর অনেক অত্যাচারের দরুণ সে সব সত্য বলে ফেলে। পাকিস্তান মিলিটারিতেই যে ভারতীয় এজেন্ট থাকতে পারে সেটি তারা শুনে অবাক হয়ে যায়।

এই প্রেক্ষিতে পাকিস্তান মিলিটারি সিদ্ধান্ত নেয় যে, মাসিহ তার পরিকল্পনা মাফিক কৌশিককে ডকুমেন্ট হস্তান্তর করবে এবং তখনই কৌশিককে গ্রেফতার করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মাসিহ কৌশিকের সাথে জিন্নাহ গার্ডেনে দেখা করার সময় পাকিস্তান সেনারা তাকে ধরে ফেলে।

এরপর দুই বছর ধরে তাকে টর্চার করা হলেও কৌশিক কখনোই ভারতের কোন গোপন তথ্য ফাঁস করেনি। তাকে মৃত্যদন্ডের সিদ্ধান্ত দেওয়া হলেও পরবর্তীতে আমৃত্যু কারাদন্ডের শাস্তি ঘোষণা দেওয়া হয়। জেলে থাকা অবস্থায় তিনি ভারতে চিঠি পাঠাতেন। চিঠিগুলোতে তিনি দেশের প্রতি আক্ষেপ প্রকাশ করেন বলে জানা যায়। কেননা ধরা পড়ার পর ভারত সরকার তাকে নিজেদের গুপ্তচর বলে অস্বীকার করে। যদিও সাধারণত এটিই হয়ে থাকে।

তাকে নিয়ে পূর্বে তেমন আলোচনা না হলেও ২০১২ সালে সালমান খানের ‘এক থা টাইগার’ নামক সিনেমার জন্য একটু হলেও তার নাম মানুষ জেনেছে। কৌশিকের মতো এমন দেশপ্রেমিক গোয়েন্দার সংখ্যা হয়তো গুণে শেষ করা যাবে না যারা প্রতিনিয়ত শঙ্কার মধ্যে থেকে তাদের জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন।

Ek Tha Tiger release pushed to Eid | Bollywood - Hindustan Times
এক থা টাইগারে পোস্টার। Image Source: Hindustan Times

নানা শারীরিক সমস্যার কারণে ভারতের এই ব্ল্যাক টাইগার ২০০১ সালে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন। অনেক গোয়েন্দাই নিজেদের ত্রুটির জন্যই ধরা পড়ে থাকেন। তবে কৌশিকের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। হয়তো আজ সে মিশন শেষে ভারতে অবস্থান করতো। মৃত্যুর পূর্বে কৌশিক বলেছিলেন যে,

ভারতের মতো বড় দেশের জন্য
কোরবানি দেওয়াতে কি এতটুকুই মিলে?

 

Feature Image: Anandabazar Potrika 
References: 

01. ‘The Black Tiger’: True Story of RAW Agent Ravindra Kaushik’s Incredible Life. 
02. Why did kaushik became Shakir? 
03. The Man Behind Ek Tha Tiger: Ravindra Kaushik And The Story Of Real Tiger.