ইতালি নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে অদ্ভুত সৌন্দর্যের দেশ। যেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্যান্য দেশ থেকে একেবারেই ভিন্ন। ইতালিতে এক চমকপ্রদ শহরের নাম মাতেরা। যাকে কেন্দ্র করে সারাবিশ্বের ভ্রমণপ্রেমী মানুষদের কৌতূহলের কমতি নেই। মাতেরা হচ্ছে ইতালির বেশ পুরানো একটি শহর।
মাতেরাতে আশেপাশে তাকালেই দেখা যায় পাথরের সমাহার। সাধারণত ইতালি ভ্রমণপ্রিয়দের পছন্দের তালিকায় সবার উপরে থাকে। এই দেশে যেমন সমুদ্রের বিশাল সমাহার তেমনই পাহাড়, বিভিন্ন সবুজ বনরাশির সবকিছুই অন্যান্য দেশের পর্যটকদের কাছে টানে।
প্রাচীন সভ্যতার এক অনন্য ইতিহাস ইতালির এই পাথরের শহর মাতেরা। মাতেরাকে কেন পাথরের শহর বলা হয় এবং এর পেছনে জানা-অজানা গল্পগুলোই নিয়েই আজকের আলোচনা।
মাতেরা শহরের ইতিহাস
মাতেরা শহরকে জানতে হলে প্রথমেই জানতে হবে ইতালিকে নিয়ে। এই দেশে ছড়িয়ে আছে এমন কিছু সভ্যতার আদি নিদর্শন যা পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। লোকমুখে শোনা যায়, ইতালির পুরনো সভ্যতা এতোটাই প্রাচীন যে হাজার হাজার বছর পুরানো বিখ্যাত সভ্যতাকেও হার মানাতে বাধ্য!
ইতালিতে এমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশ কিছু শহরের মধ্যে মাতেরা হলো এমন এক শহর যাকে জাদুর শহর বলেও গণ্য করা হয়। এই শহরটি ইতালির দক্ষিণে অবস্থিত। জানা যায়, ইতালির বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানের মধ্যে এটি অন্যতম।
এই শহরটি মূলত সাসি ডি মাতেরা নামেই বেশি পরিচিত। ইতালিয়ান ভাষায় সাসি অর্থ হচ্ছে পাথর আর সাদি ডি মাতেরার অর্থ দাঁড়ায় মাতেরার পাথর। স্যাসি ডি মাতেরা বেশ প্রাচীন একটি শহর, এই শহরটি অসংখ্য পাহাড় নিয়ে গঠিত। মাতেরাকে গুহার শহরও বলা হয়ে থাকে। ইউরোপিয়ানদের কাছে এটি জাদুর শহর বলেই বেশি পরিচিত।
মাতেরার বেশ প্রাচীন ও চমৎকার কিছু ইতিহাস পুরনো দালানের মতো ইটের মাঝে চেপে আছে। প্রাচীন মাতেরা সাধারণত দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি অংশ স্যাসো বারিস্যানো। আরেকটি অংশ স্যাসো ক্যাভোসো নামে আখ্যায়িত। এই দুটির সংযোগস্থলেই মাতেরা শহরটি সগর্বে তার পরিচিতি লাভ করে অবস্থান করে আছে।
নানান ঘটনার পরিক্রমায় এক সময় এই শহরটি ইতালি থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যার কারণে অনেকেই এই শহরটিকে ভুলতে বসেন। অনেকে হয়ত একে স্রেফ এক পরিত্যেক্ত শহর বলেই জানতো। আর এইসব কারণে এখানে মানুষের বসবাস বেশ কমে গিয়ে জনশূন্য হয়ে যেতে শুরু করে। মানুষের আনাগোনা কম থাকার কারণে ভ্রমণপিয়াসীরা একে এড়িয়ে চলতো বলেই জানা যায়।
কিন্তু উনিশ শতকের শুরুর দিকে কিছু অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী পুনরায় মাতেরার দিকে ঝুঁকতে থাকে এবং এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে শুরু করে। এক সময় তারা দেখতে পান এই শহরের একেবারে উঁচুতে প্রায় ষোল হাজার মানুষের বসবাস রয়েছে যা ভ্রমণকারীদের বেশ অবাকই করেছিল। এই নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনযাপন কেটে যেত মাতেরা শহরের পাথরের গুহার মতো ঘরে যা আজও স্মৃতির হাতছানি দিতে জীবন্ত হয়ে ইতিহাসের পাতায় দাঁড়িয়ে আছে।
তবে এই গুহার মান দিনদিন থাকার অযোগ্য এবং এদের অভাবের তাড়নায় এমন এক অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায় যে ইতালিতে একে লজ্জার হিসেবে দেখা হতো। আর তৎকালীন সরকার এর নাগরিকদের অন্যত্র চলে যাওয়ার আদেশ করেন। চমৎকার এই শহর এক সময় আদতে পরিবর্তিত হয় ভূতুড়ে শহর হিসেবে। নেই কোন জনমানব, নেই আগের মতো উল্লাস! কেমন যেন মৃত হয়ে উঠছিল এই মাতেরা।
তবে মৃত শহর বলে কিন্তু খুব বেশিদিন এটি টিকে থাকেনি! ধীরে ধীরে এর সংস্কারের কাজ চালু হলে তা আগের রূপ ধারণ করে এবং সারা বিশ্বে এটি এতই নাম করে যে ২০১৯ সালে মাতেরা শহরকে ইউরোপীয় সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
সরকার এর নাগরিকদের সরিয়ে ফেললেও এক সময় এর আগের আমেজ ফিরতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই পর্যটকরা এই শহর নিয়ে বেশ গুঞ্জনের আভাস দিচ্ছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার এই শহরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করলে তাতে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েন তারা।
কিন্তু এক সময় জয় হয় সেই পর্যটকদের। তারা এই শহরকে নিয়ে এতটাই আশাবাদী ছিলেন যে কার্লো লেভির নেতৃত্বে প্রবল প্রচেষ্টায় এই শহর পুনরায় প্রাণ ফিরে পায়। কার্লো লেভি ছিলেন মূলত একজন ইতালিয়ান লেখক এবং শিল্পী। এই কার্লো লেভি ছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার নেশা ছিল লেখায়, শিল্পে এবং রাজনীতিতে।
তৎকালীন সময়ের স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদের বিরোধী ছিলেন বলে ইতালির সরকার তাকে বয়কট করে নির্বাসনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। জানা যায়, ১৯৩৫ সালের দিকে ইতালির এক শহর লুসানিয়াতে তাকে পাঠানো হয় শাস্তিস্বরূপ! এবং সেখানেই কার্লো লেভি তার নির্বাসিত জীবন-যাপন করতে থাকেন।
লেভির এই দীর্ঘদিনের নির্বাসিত জীবনে এই শহর বেশ পছন্দের এবং নিজের খুব কাছের একটি ব্যাপার হয়ে জন্মায়। এখানকার আদিবাসীরা লেভিকে বেশ ভালোবাসতেন এবং এদের আন্তরিকতায় তাদেরকে আপন মানুষের তালিকায় যুক্ত করে নেন লেভি। সেই সময় সেখানকার বাসিন্দাদের ছিল প্রচণ্ড অভাব-অনটন। এসব কিছু লেভি তার নিজ চোখে পরখ করেছিলেন। তাদের দুঃখকষ্টগুলো লেভির মনে বেশ বড় রকমের আঘাত দেয়।
এক সময় তার নির্বাসিত জীবন শেষ হলে ইতালিতে ফিরে যান লেভি। আর পুনরায় সরকারের শাস্তিস্বরূপ জেলে পুরতে হয় তাকে। জেলে থাকা অবস্থায় লেভি লেখালিখি চালিয়ে যান। জানা যায়, জেলে বসেই তিনি রচনা করেন তার লেখা ক্রিস্তো সি অ্যা ফেরমোতি অ্যা এবোলি নামক বিখ্যাত বইটি। ইতালিয়ান এই বইয়ের নাম দাঁড়ায় ক্রাইস্ট স্টপড অ্যাট ইবোলি।
লেভি তার বইতে উল্লেখ করেন এই গুহাগুলোর আকৃতি, আয়তন, এর বানানোর উপকরণ। সাধারণত এই গুহাগুলো শক্ত মাটির বা পাথরের হয়ে থাকে। এতে নির্দ্বিধায় ২-৩ জন মানুষসহ নিজেদের কুকুর-বিড়ালও থাকতে পারে। এই সকল গুহায় পানি পানের জন্য বা ব্যবহারের জন্য চৌবাচ্চা তৈরি করা হতো যাতে পুরো একটি পরিবারের পানি সংরক্ষন করে রাখা যেতো!
বর্তমানে এই পাথরের শহরের প্রাচীন গুহাগুলো চমৎকার হোটেল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় প্রথম সারিতে যুক্ত হয়েছে এই মাতেরা শহরের গুহা বা হোটেলগুলো।
পৃথিবীর বিভিন্ন আদি নিদর্শন হিসেবে এই শহর অন্যান্য প্রাচীন শহরগুলো থেকে অন্যতম। ১৯৯৩ সালে এই মাতেরা শহরকে ইউনেস্কো ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ এর মর্যাদা দেয়। প্রায় নয় হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসে ঘেরা এই ইতালিয়ান শহরটি বর্তমানে বেশ বিখ্যাত হয়ে পুনরায় ইতিহাস সৃষ্টি করবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
তবে যে প্রতিকূলতা ছাড়িয়ে মাতেরা আজ এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে পর্যটকসহ সারা বিশ্বের মানুষের দাবী এর যত্ন না নিলে এর অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ধ্বংস হয়ে যাবে।
Feature Image: pinterest.com Reference: 01. Matera basilicata italy european capital of culture. 02. Timeless matera italy.