জাদুঘর হলো এমন একটা জায়গা যেখানে দেশের নানা অঞ্চল থেকে কিংবা যেকোনো জায়গা থেকে প্রাপ্ত পুরাতত্বের নিদর্শন থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক অনেক বস্তু সংরক্ষণ করা হয়। সমস্ত দুনিয়াতে জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত কত ইতিহাস বাক্সবন্দী হয়ে আছে তার ইয়াত্তা নেই।
সেদিক থেকে বলতে গেলে পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্যের মিলনস্থান ইউরোপ। কী নেই সেখানে? শিল্প, সাহিত্য, ঐতিহ্য যেন প্রাণ খুঁজে পায় ইউরোপে এসে। প্রতিটি ইতিহাস সমৃদ্ধ আর অমূল্য। ইউরোপের প্রায় প্রতিটি বড়-ছোট সমৃদ্ধ অঞ্চলে আছে জাদুঘর। ইউরোপের সেরা ছয়টি জাদুঘর নিয়েই আজকের নিবন্ধ।
ভ্যান গগ মিউজিয়াম, আমস্টারড্যামস, নেদারল্যান্ডস
১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আমস্টারড্যামের ভ্যান গগ মিউজিয়াম। ডাচদের করা অন্যতম বিখ্যাত জাদুঘরটি যেন ভ্যান গগের প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ। দুটো বিল্ডিং সংযুক্ত করা আছে, আছে ভ্যানগগের আঁকা চিত্রকর্ম। ২০০টি পেইন্টিংস, ৪০০ ড্রয়িং এবং ৭০০ চিঠি আছে পুরানো রিটভেল্ড ভবনে। এর অপর অংশ হলো কুরোকাওয়া, এটা অস্থায়ী প্রদর্শনীর জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এখন পর্যন্ত এই জাদুঘরেই আছে ভ্যান গগের সবচাইতে বেশি পেইন্টিংস-এর কালেকশন। শিল্পীর আঁকা সেলফ পোর্টেট (১৮৮৮), সান ফ্লাওয়ার (১৮৮৯) এর দেখা এখানেই মিলবে। আরো একটা দারুন চিত্রের দেখা মিলবে। Paul Gauguin একজন ভাস্কর এবং চিত্রশিল্পী ,তাঁর একটা অদ্ভুত চিত্র, সেখানে তিনি গগের আঁকা সানফ্লাওয়ার এবং সেলফ পোর্টেট মিলিয়ে চমৎকার একটা ছবি এঁকেছিলেন। খুব সম্ভবত গ্যাগ থেকেই বেশ অনুপ্রানিত হয়েছিলেন এই চিত্রশিল্পী।
অ্যাক্রোপলিস, এথেন্স, গ্রিস
গ্রিসের সবচেয়ে বড় শহর হলো এথেন্স। পৃথিবীর অতি প্রাচীন এই শহরে প্লেটো-এরিস্টটলের পদধূলি পড়েছে। তবে, এই জাদুঘরটি ঠিক সেভাবে সামনে আসেনি। দেবী এথেনার পার্থেনন মন্দির সংলগ্ন এই জাদুঘর ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক জাদুঘরের সম্মান অর্জন করে। অতীত ঐতিহ্য আর ইতিহাস সবার সামনে তুলে ধরার সিদ্বান্ত নেয়া হয়।
বিখ্যাত সুইস-ফ্রান্স আর্কিটেক্ট বার্নার্ড শুমি এই তিন তলা জাদুঘরের ডিজাইন করেন। মজার ব্যাপার হলো, একটি ঐতিহাসিক স্থানের উপর এই জাদুঘর নির্মিত, প্রবেশ করা ও বের হবার সময় অপূর্ব সৌন্দর্য দর্শনার্থীরা উপভোগ করেন। রোম, প্রাচীন এথেনার অনেক নিদর্শন সংরক্ষিত আছে এখানে।
আরো অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। যার মধ্যে আছে মার্বেল পাথরের কিছু নিদর্শন লন্ডন জাদুঘর থেকে ফিরিয়ে আনার অপেক্ষায় আছে গ্রিসের এই জাদুঘরটি।
ভাসা মিউজিয়াম, স্টকহোম, সুইডেন
১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে, ভাসা নামের এক বিশাল জাহাজ যাত্রা শুরু করে। তবে যাত্রা শুরুর কিছু সময়ের মধ্যেই এই বিশালাকার জাহাজ ৬৪ কামান সমেত ডুবে যায়। কাদায় প্রায় ৩৩৩ বছর ডুবে থাকার পর, ১৯৬০-১৯৬১ সালের দিকে উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে বিশালাকার জাদুঘর তৈরি করে জাহাজটি সংরক্ষণ করা হয়।
জাহাজটির চারপাশে না ঘুরে বেড়ালে এর বিশালতা যেমন বুঝা যাবে না, ঠিক একইভাবে ভাসার চারদিকের পরিবেশ এবং আর্দ্রতা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যাতে ভাসা জাহাজটি নষ্ট না হয়ে যায়। এই জাহাজে থেকে পাওইয়া অনেক মূল্যবান ভাস্কর্য, দ্রব্য বৈজ্ঞানিক উপায়ে রাখা হয়েছে। ভাসা নিয়ে তৈরি একটি মুভিতে এই জাহাজের সমস্ত ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
পিকাসো মিউজিয়াম, স্পেন, বার্সেলোনা
পাবলো পিকাসোকে নতুন করে চেনানোর কিছু নেই, তার জন্য বিশ্বে ৮টি আলাদা আলাদা জাদুঘর রয়েছে। তবে সমস্ত জাদুঘরের মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত এই জাদুঘরটি। ৬০০০ বই, ৪০০০ এর বেশি পেইন্টিংস, ড্রয়িং এবং চিত্রকলা সংরক্ষিত আছে এখানে। এর অধিকাংশ বস্তুই পিকাসো নিজেই দান করেছে।
১৯১৭ সালের আগ পর্যন্ত তার জীবনের সমস্ত কর্ম মোটামুটি ৩ ভাগে সাজানো হয়েছে, এখানে সংরক্ষিত বই থেকে পিকাসোর জীবন সম্পর্কে বেশ বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। যারা পিকাসোকে নিয়ে গবেষণা করতে চায়, তাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ হচ্ছে এই জাদুঘর। উইমেন উইথ বনেটসহ সেরা ৩৯টির মতো বিখ্যাত পেইন্টিংস সংরক্ষিত আছে এই মিউজিয়ামে।
ভ্যাটিক্যান মিউজিয়াম, ভ্যাটিক্যান সিটি
ইতালির মতো সমৃদ্ধ শহর খুব কমই আছে। আর সেই ইতালিতেই আছে আস্ত এক দেশ ভ্যাটিকান সিটি। সেই ভ্যাটিকান জাদুঘরে আছে প্রায় ৭০,০০০ চিত্রকর্মসহ অনেক কিছু সংরক্ষিত আছে। ২০,০০০ এর মতো নিদর্শন প্রায় প্রতিদিন প্রদর্শিত হয়। ২৪টি গ্যালারি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত আছে। পিনাকোটেকা ভ্যাটিকানা, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, কারাভাজ্জিওসহ গ্রিক এবং রোমান ভাস্কর্যসহ আছে ভ্যাটিকান এর ঐতিহাসিক চিত্রকর্ম আছে।
১৬ শতকের পর থেকে আজ পর্যন্ত নিয়োগ পাওয়া সমস্ত পোপ-এর ভাস্কর্য রয়েছে। আরো কত নাম জানা, না জানা ইতিহাস নিজের বুকে ধরে রেখেছে এই বিশালাকার জাদুঘরটি। ১৮৩২ সালে তৈরি করা হয় স্পাইরাল স্টেয়ারকেস, গ্যালারি অফ ম্যাপস, গ্যালারি অফ স্ট্যাচুস, পোপদের মূর্তি অন্যতম সেরা দর্শনীয় বস্তুর মধ্যে রয়েছে।
স্কানসেন ওপেন এয়ার মিউজিয়াম, স্টকহোম, সুইডেন
খোলা আকাশের নীচে জাদুঘর? ওপেন এয়ার মিউজিয়াম বা খোলা আকাশের নীচে জাদুঘর এর অর্থ হলো সংগ্রহীত শিল্পকর্ম, ইতিহাস বা ঐতিহ্য সমস্ত কিছু চার দেয়ালের বাইরে এনে প্রদর্শন করা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ খোলা আকাশের নিচে এই জাদুঘর ১৮৯১ সালে স্থাপিত হয়।
আরটার হাজেলিয়াস নামে এক লোকসাহিত্যিক এটি তৈরি করেন। এটি তৈরির মূল উদ্দ্যেশ্য ছিল শিল্পায়নের আগে দেশ-জাতির মূল-সংস্কৃতিকে তুলে ধরা। জুগার্ডেন দ্বীপের প্রায় ১৫০টি , ঐতিহ্যবাহী কিছু বাড়ি নিয়ে এই জাদুঘর তৈরি করেন তিনি। অধিকাংশ বাসিন্দারা এলাকায় অন্য অঞ্চল থেকে এসেছিলেন বলে শোনা যায়। এখানে আছে বাগান, পশুর খামার, নোরডিক চিড়িয়াখানা।
এখানে কর্মরত কর্মীরা নির্ধারিত কিছু পোশাক পরিধান করেন। সরাসরি দর্শনার্থীরা মাখন কিংবা পনির তৈরি দেখতে পায়, কাচ তৈরি কিংবা ক্রাফটের কাজ কীভাবে করা হয় সব চোখের সামনে দেখা যায়।
Feature Image: pinterest.com References: 01. Best Museum in Europe. 02. Best Museums in Europe.