কারাকোরাম হাইওয়ে: বিপদ আর রোমাঞ্চের মেলবন্ধন যে জায়গা

453
0

জীবনকে বৈচিত্র্যময় করতে, সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত উপহার অতি মূল্যবান জীবনের দিনগুলোকে চরম মাত্রায় উপভোগ করতে কালে কালে মানুষ কত কিছুই না করেছে। কত দুঃসাহসী অভিযানে নিজেকে শরিক করেছে জীবন-মৃত্যুর সীমারেখায়। তেমনই একটি স্থান ‘কারাকোরাম হাইওয়ে’ যা বিশ্বের অন্যতম বিপদজনক, ঝুঁকিপূর্ণ হাইওয়ে। পাহাড়ের কোল ঘেষে, আঁকাবাকা এই মহাসড়ক যেকোনো দুর্বল হৃদয়ের ব্যক্তির কাছে যেন সাক্ষাত মৃত্যুপুরী! 

পিচ্ছিল রাস্তা এবং তুষারপাতের ঝুঁকি ছাড়াও, ভূমিধ্বস এবং যখন তখন পাথর পড়ার হুমকি কারাকোরামকে করেছে আরো বিপজ্জনক। তুষারপাতে রাস্তা বন্ধ হওয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য দুর্ঘটনা মহাসড়কের একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার বলে শুধুমাত্র সবচেয়ে দক্ষ চালকরাই নিরাপদে রাস্তাটি ব্যবহার করতে পারেন। 

নাম, পরিচিতি এবং অবস্থান

কারাকোরাম হাইওয়ে জনসাধারণের কাছে কেকেএইচ (KKH) নামে পরিচিত হলেও, পাকিস্তানের মধ্যে—আনুষ্ঠানিকভাবে এন-৩৫ (N-35) নামে; এবং চীনের মধ্যে, আনুষ্ঠানিকভাবে চীন জাতীয় মহাসড়ক থ্রিওয়ানফোর (314) (G314) হিসাবে পরিচিত। এশিয়ান হাইওয়ে এএইচফোর (AH4) এরও একটি অংশ এই মহাসড়ক। 

কারাকোরাম হাইওয়ে বা কেকেএইচ বিশ্বের সর্বোচ্চ পাকা আন্তর্জাতিক সড়ক হিসেবে পরিচিত। ১.৩০০ কিলোমিটার এই হাইওয়ের. ৮৮৭ কিলোমিটার পাকিস্তানের এবং. ৪১৩ কি.মি. চীনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। ৪৬৯৩ মিটার (১৫,৩৯৭ ফুট) উচ্চতায় কারাকোরাম পর্বতমালা খুঞ্জেরাব পাসের মাধ্যমে চীন ও পাকিস্তানকে সংযুক্ত করেছে এই মহাসড়ক। মূলত অস্বাভাবিক উচ্চাতায় এই অবস্থানই কারাকোরামকে করেছে অন্যান্য মহাসড়ক থেকে একদম আলাদা। 

দুর্গম পাহাড়ের বুকে কারাকোরাম হাইওয়ে। Image Source: aalmiakhbar.com

এছাড়া চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলকে পাকিস্তানের গিলগিট-বালতিস্তান এবং খাইবার পাখতুনখোয়া অঞ্চলের সাথে সংযুক্ত করেছে। যা একটি জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ স্পট হিসেবে সারাবিশ্বে ভ্রমণপিয়াসী সকলের কাছে পরিচিত। কারাকোরামের অতি উচ্চতা এবং কঠিন পরিস্থিতিতে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল বলে, এটিকে অনেকে ‘বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য’ হিসাবে মানার পক্ষপাতিত্ব করেন। 

পেছনের ইতিহাস

চীনে কারাকোরাম হাইওয়ে, ‘বন্ধুত্বের মহাসড়ক’ বা ‘ফ্রেন্ডশিপ হাইওয়ে’ নামে পরিচিত। পাকিস্তান এবং চীন সরকার দ্বারা নির্মিত এই মহাসড়কের নির্মান কাজ ১৯৫৯ সালে শুরু হয়েছিল এবং ১৯৭৯ সালে সম্পন্ন হয়। প্রাচীন সিল্ক রোডের সাথেও যুক্ত থাকা এই সড়ক জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় ১৯৮৬ সাল থেকে। 

অতি ঝুঁকিপূর্ণ এই হাইওয়ে নির্মাণ কাজে প্রাণ হারিয়েছে চীন ও পাকিস্তানের বহু শ্রমিক। যাদের মধ্যে প্রায় ৮১০ জন পাকিস্তানি এবং প্রায় ২০০ জন চীনা শ্রমিক। উল্লেখিত এই শ্রমিকদের বেশিরভাগই প্রাণ হারিয়েছে ভূমিধ্বস এবং জলপ্রপাতের কারণে। নির্মাণের সময় মারা যাওয়া চীনা শ্রমিকদের গিলগিটের চীনা কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। 

বিপজ্জনক কারাকোরাম হাইওয়ে। Image Source: pinterest.com

দর্শকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুর কারণ

‘দ্য গার্ডিয়ান’ এর জরিপ মতে কারাকোরাম হাইওয়ে পাকিস্তানের তৃতীয় সেরা পর্যটন স্পট হিসেবে স্থান পেয়েছে এর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে। রাস্তাটি পর্বতারোহী এবং সাইক্লিস্টদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকার কারণ সড়কটি দিয়ে সহজেই এলাকার অনেক উঁচু উঁচু পাহাড়, হিমবাহ এবং হ্রদে প্রবেশ করা যায়। 

সরু পর্বতগাত্রে নির্মিত এই মহাসড়ককে আরো ভয়ংকর করে তুলেছে এর সম্পূর্ণ উন্মুক্ত এক পাশ। একদিকে বিপদজনক বাঁক আর অন্যদিকে সংকুচিত রাস্তা অতি দক্ষ চালকের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পরার জন্য যথেষ্ট। তবে অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীরা বেশ উপভোগ করে কারাকোরাম হাইওয়ের এই ভয়ংকর রূপটি। তাই তো দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ছুটে আসেন যেন জীবনকে বাজি ধরতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের কাছে! 

শুধুমাত্র কারাকোরামের এই ভয়ংকর রূপ উপভোগ করতেই দর্শনার্থীরা আসেন না, এছাড়াও পাকিস্তান-শাসিত ভূ-স্বর্গ খ্যাত কাশ্মীরের গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চলে পর্বতারোহণের জন্য কারাকোরাম মহাসড়কটি ব্যবহার করতে পছন্দ করেন অনেকেই। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ভ্রমণ পিপাসুদের সংখ্যা যেনো বেড়ে গেছে বহুগুণে।  

বিপদ যেখানে হাতছানি দিয়ে ডাকে। Image Source: steemitimages.com

যেসকল শহরগুলোতে যাওয়া যায় এই মহাসড়ক দিয়ে

চীন আর পাকিস্তানের মেলবন্ধনের এই সেতু দিয়ে উভয় দেশেরই বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শহরে যাতায়াত করা যায়। যেমন, কোহিস্তান, চিলাস, গিলগিট, পারি বাংলা, ড্যানিওর, নগর, আলিয়াবাদ, গুলমিত, পাসু, সোস্ট, তাশকুরগান টাউন, ঘিজার, উপল, কাশগর। 

পাকিস্তানের গিলগিট-বালতিস্তান প্রশাসন এবং চীনের জিনজিয়াং প্রশাসন তাদের স্থায়ী বাসিন্দাদের সীমান্ত পাস ইস্যু করার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই পাসটি শুধু এক বছরের মেয়াদ থাকে এবং শুধুমাত্র খুঞ্জেরাব পাস দিয়ে ভ্রমণের জন্য ব্যবহার করা হয়। 

সবসময়ই কি উন্মুক্ত থাকে কারাকোরাম হাইওয়ে? 

রাস্তাটি সারা বছর খোলা থাকলেও, ভারী তুষারপাতের কারনে খঞ্জেরাব পাস শুধুমাত্র ১ মে থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্য সময় ভাগে খোলা থাকে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪.৬৯৩ মিটার উচ্চতায় হওয়ার কারনে তীব্র তুষারপাতের প্রভাবে দীর্ঘকাল সড়ক অবরোধের মতন ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। 

এছাড়াও জুলাই এবং আগস্টের আশেপাশে বর্ষাকালে ভারী বৃষ্টির কারণে মাঝে মাঝে ভূমিধ্বস হয়, যার ফলে কয়েক ঘন্টা বা তার বেশি সময় ধরে রাস্তা বন্ধ থাকতে পারে। চুলের কাঁটার মতোই সরু আর বাঁকানো এই রাস্তা দক্ষ চালকদের ও উচিত অতি সচেতনতার গাড়ি চালানো। এবং আগে থেকেই আবহাওয়ার দিকে নজর দেওয়া। 

কারাকোরাম হাইওয়ে। Image Source: indiandefencereview.com

পাহাড়ের গায়ে খোদায় করা প্রাচীন শিল্প এবং পেট্রোগ্লিফস 

শুধুমাত্র দু:সাহসী অভিযান পরিচালন করার সুযোগই পর্যটকদের কারাকোরাম তার কাছে ডাকে না। এর ঐতিহাসিক গুরুত্বও আছে সমানতালে। কারাকোরাম হাইওয়ে জুড়ে ৫০,০০০টিরও বেশি রক আর্ট এবং পেট্রোগ্লিফ রয়েছে যা হুনজা এবং শাটিয়ালের মধ্যে দশটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে লক্ষ্য করা যায়। খোদাইগুলি সাধারণত সৈন্য, তখনকার দিনের বনিকেরা এবং তীর্থযাত্রীদের দ্বারা করা হয়েছিল। 

শুধু তাই নয়, স্থানীয় বাসিন্দারাও তাদের প্রয়োজনে বা স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য এই শিল্পের চর্চা করেছিল। ফলে প্রাচীনকালের মানুষ এবং তাদের জীবন-যাপন নিয়েও বিভিন্ন রকমের নতুন ধারনার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেছে এই সব শিল্পকর্ম। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ১০০০ এর মধ্যকার এসব চিত্রকর্মে নানা ধরনের প্রানী, মানুষ, হিংস্র পশুর সাথে মানুষের লড়াই এসব ও চিহ্নিত আছে।

এমন অনেক প্রাণীর চিত্র আছে যারা আকারে শিকারীদের চেয়েও অনেক বড়। পাহাড়ের বুকে খোদাই করা, বা পাথরের উপর খোদাই করার জন্য যা এতকাল পরেও উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। যা কারাকোরামের সৌন্দর্যকে পর্যটকদের কাছে আরো বেশি আকর্ষনীয় করে তোলে। 

পাহাড়ের গাঁয়ে পেট্রাগ্রেফ। Image Source: destinationpakistanguide.com

পাকিস্তান, চীনের মেলবন্ধনকারী এই সেতু নিজের ভয়ংকর সুন্দর রূপ নিয়ে যেন সবাইকে ডাকতে থাকে, গড়পড়তা জীবনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অন্য একটি রোমাঞ্চ প্রিয় অন্য এক স্বত্ত্বাকে। তাই তো বাঁধ ভাঙ্গা উল্লাস নিয়ে প্রকৃতির কোলঘেষে নির্মিত কারাকোরাম হাইওয়েকে নিঃসন্দেহে জীবনে একবার হলেও পরিদর্শন করা উচিত।

 

Feature Image: pinterest.com 
References: 

01. karakoram highway pakistan. 
02. The worlds most dangerous road which has killed over 1000 people is also a tourist attraction. 
03. karakoram highway the eighth wonder of the world