প্রাচীন বিশ্বের পাঁচটি পবিত্র স্থান

417
0

আমরা কেন এই পৃথিবীতে এসেছি?
আমাদেরকে কী উদ্দেশ্যে এখানে পাঠানো হয়েছে?
এই পৃথিবীতে আমাদের কাজই বা কী? 

সৃষ্টির শুরু থেকেই এই প্রশ্ন প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি সমাজ নিজেদেরকে করেছে। এই রহস্যের পেছনে ছুটেই মানুষ জীবন মৃত্যু আর মহাবিশ্বকে জানতে আগ্রহী হয়েছে। জীবন-প্রতিটি জীবের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সেরা উপহার। এই জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে লুকিয়ে আছে রহস্য। বস্তুত, জীবনের গূঢ় অর্থই হচ্ছে রহস্য যার সাথে দীর্ঘদিন ধরে সংস্কৃতির লড়াই চলছে।

সৃষ্টিকর্তাকে জানার উদ্দেশ্যে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ তাদের সমগ্র জীবন অতিবাহিত করেছে। কেউ কেউ পবিত্র স্থান, ধর্মীয় উপাসনালয়ে উপাসনা করে। আবার কেউ কেউ প্রকৃতির পূজা করে পবিত্র পাহাড়, বন এবং পাথরের মধ্যে সৃষ্টির রহস্যের সংযোগ খুঁজে। প্রাচীন সভ্যতার লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের পবিত্র আত্মার সাথে যোগাযোগ করার জন্য বিভিন্ন উপাসনালয় নির্মাণ করতো।

ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রার্থনারত মানুষ। Image source: wallpaper flare.com

ইংল্যান্ডের ‘স্টোনহেঞ্জ’ থেকে শুরু করে মেক্সিকোর ‘চিচেন ইতজা পিরামিড, মঙ্গোলিয়ার রহস্যময় ‘ডিয়ার স্টোন’সহ এমন অসংখ্য মানব নির্মিত পবিত্র স্থাপনা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এসব কিছু প্রমাণ করে মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই জীবন, মৃত্যু এবং মহাবিশ্বকে বোঝার চেষ্টা করে আসছে।

পৃথিবীতে এখনো এমন কিছু রহস্যময় জায়গা রয়েছে যার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। আলোচ্য প্রবন্ধটিতে প্রাচীন বিশ্বের পাঁচটি পবিত্র স্থান নিয়ে আলোচনা হবে। যা ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ফেলো, কানাডিয়ান ফটোগ্রাফার ক্রিস রেইনারের সর্বশেষ বই ‘স্যাক্রেড: ইন সার্চ অফ মিনিং’ থেকে নেওয়া হয়েছে। যিনি গত ৪০ বছর ধরে সারাবিশ্বের আধ্যাত্মিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো তালিকাভুক্ত করেছেন৷

হোয়েল বোন অ্যালে, রাশিয়া 

সাইবেরিয়ার বেরিং সাগরের তীরে অবস্থিত ইটিগ্রান নামক একটি ছোট্ট দ্বীপে হোয়েল বোন অ্যালে বা তিমির হাড়ের গলি নামে পরিচিত ৫৫০ মিটারের একটি দীর্ঘ গলি রয়েছে। সমুদ্রের খুব কাছাকাছি নির্মিত এই গলিটিতে তিমির হাড়ের দুটি সমান্তরাল সারি আছে। বৃহদাকার তিমির হাড় মাটিতে খনন করে সারি দুটি তৈরি করা হয়েছে।

চুকোটকার বাসিন্দাদের তৈরি তিমির হাড়ের গলি। Image source: yandex

বিশাল তিমির পাঁজর এবং কশেরুকার হাড় এবং মাথার খুলির সাহায্যে তৈরি এই গলি নির্মাণে ৬০টিরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক তিমির কঙ্কাল লেগেছে বলে ধারণা করা হয়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই আশ্চর্যজনক স্মৃতিস্তম্ভটি আবিষ্কার করেন ১৯৭৭ সালে। যা প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো বলে মনে করা হয়। শিকার করা তিমির অবশিষ্টাংশ থেকে আনুমানিক ১৪-১৬ শতকে চুকোটকার বসিন্দারা এই গলিটি তৈরি করেছিল।

প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, তিমির গলিটি পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে খুব সাবধানে এবং নির্ভুলভাবে তৈরি করা হয়েছিল। অনেকের মতে, এটি প্রাচীন এস্কিমোদের একটি পবিত্র স্থান যেখানে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও ভোজের আয়োজন হতো। তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য এখানে ছুটে আসতেন। এখানে, সমুদ্রের আত্মাদের জন্য প্রার্থনা করা হতো। এখানে পাওয়া জীবাশ্মগুলো প্রমাণ করে যে, একসময় এই জায়গায় একটি বেদী ছিল (পবিত্র স্থান) যেখানে কেবল প্রবীণদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হতো।

তিমির হাড়ের গলি। Image source: siberian times

রেইনার মনে করেন,

এই ধরণের পবিত্র স্থানগুলিতে আত্মার অনুভূতি রয়েছে। এটা হতে পারে পৌরাণিক প্রাণী এবং আত্মার উপাসনা কেন্দ্র।

স্থানীয়দের মতে এটা এমন একটি জায়গা যেখানে কসাইরা মাংস বিক্রির জন্য জড়ো করে রাখতো। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো এই জায়গা নির্মাণের কারণ জানতে পারেনি।

হেগরা, সৌদি আরব

হেগরা/আল-হিজর অথবা মাদাইন সালেহ সৌদি আরবের মদিনা প্রদেশের আল-উলা অঞ্চলে অবস্থিত। এটি ইউনেস্কো ঘোষিত সৌদি আরবের প্রথম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। জর্ডানের পেত্রা থেকে ৫০০ কি. মি. দক্ষিণ-পূর্বে হিজাজের মালভূমিতে অবস্থিত হেগ্রা শহরটির প্রথম সন্ধান পান ফরাসি ও সৌদি প্রত্নতাত্ত্বিকরা।

হেগরা নগরীর কনফারেন্স রুম। Image source: Wikimedia commons

আল-উলা থেকে ২০ কি. মি. উত্তরে অবস্থিত এই শহরটি আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে নাবাতিয়ানরা পাথর খোদাই করে তৈরি করেছিল। এটি ছিল নাবাতিয়ান সভ্যতার দ্বিতীয় রাজধানী; যারা জর্ডানের বিখ্যাত পেত্রা নগরী তৈরি করেছিল। নাবাতিয়ানরা পাথরে খোদাই করা কাজ ও স্মৃতিস্তম্ভের জন্য বিখ্যাত ছিল।

হেগরা নগরীর ধ্বংসাবশেষ। Image source : smithsonian mag. com

হেগরা প্রত্নতাত্ত্বিক শহরটি বিভিন্ন আকার ও উচ্চতায় খোদাইকৃত পাথর ও প্রাসাদের জন্য বিখ্যাত। পাথরগুলো কাটা হতো এখানকার বসবাসকারীদের বসতি ও সমাধি তৈরির জন্য।

হেগরা নগরীর চারটি গোরস্থানে প্রায় ১১১টি সমাধিস্তম্ভ আছে। এগুলো রাজা, রাণী এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের সমাধিস্থল। যেমনটি পেত্রায় দেখা যায়। পেত্রা ও হেগরা একই সভ্যতার অংশ হওয়ায় স্থাপত্যের দিক থেকে এদের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে।

হেগ্রার সবচেয়ে বড় সমাধি। Image source : smithsonian mag.com

রেইনারের মতে—এই জায়গাটি অস্বাভাবিক। কারণ এখানে মরুভূমির মধ্যে এত বিশাল আকারের পাথরগুলোকে সম্পূর্ণ
মসৃণভাবে খোদাই করে সমাধি তৈরি করা হয়েছে। সমাধির ভেতর দরজাও দেওয়া হয়েছে। যাতে করে মৃত্যুর পর দেহগুলিকে এই সুরক্ষিত পাথরের সমাধির ভেতরে রাখা যায়। হতে পারে এখানে মৃতদেহগুলোকে গুপ্তধনসহ কবর দেওয়া হয়েছিল। যদিও এই সম্পর্কিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি এখনো।

আনাসাজি হ্যান্ড প্রিন্ট, যুক্তরাষ্ট্র

আনাসাজি হ্যান্ড প্রিন্ট হচ্ছে আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে, বিশেষ করে উটাহ, নিউ মেক্সিকো, অ্যারিজোনা এবং কলোরাডো অঙ্গরাজ্যগুলোতে প্রাচীন পাথরের উপর পাওয়া হাতের ছাপ। এই ধরনের হ্যান্ড প্রিন্টসগুলো পেট্রোগ্লিফ নামেও পরিচিত।

গুহার দেওয়ালে আনাসাজি হ্যান্ডপ্রিন্টস। Image source : pinterest.com

পেট্রোগ্লিফগুলো বেশিরভাগই ফ্রিমন্ট এবং আনাসাজি সংস্কৃতির লোকেদের হাতে তৈরি। যার বেশিরভাগ ছিল মানুষের মূর্তি, প্রাণী, শিকারের অস্ত্র এবং হাতের ছাপ। নেটিভ আমেরিকানদের অনেকে এসব জায়গাকে পবিত্র বলে মনে করে। এটাকে তারা তাদের অতীত এবং সংস্কৃতির সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হিসেবে দেখে।

রেইনার বলেন, হ্যান্ড প্রিন্টসগুলো প্রায় ৪০০০ বছরের পুরনো হলেও এখনো দুর্দান্ত অবস্থায় রয়েছে। হাতের ছাপগুলো বহুকাল আগের শক্তিশালী স্বাক্ষর বহন করে চলছে। কল্পনা করুন, একজন প্রাচীন ব্যক্তি লাল দেয়ালে হাত রেখে গেরুয়া রঙ নিলো এরপর পাথরের উপর হাতের ছাপ রাখলো।

আনাসাজি সংস্কৃতির মানুষদের আঁকা পেট্রোগ্লিফ। Image source : pinterest. com

হয়তো একদল শিকারী ছায়ায় বসে ভাবছে, ‘আমরা আমাদের স্বাক্ষর এখানে রাখছি না কেন?’ এই স্বাক্ষর হয়তো প্রমাণ করবে ‘একদিন আমি এখানে ছিলাম’।

ডিয়ার স্টোন, মঙ্গোলিয়া 

মঙ্গোলিয়া একটি অসাধারণ দেশ যাদের রয়েছে একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস। উত্তর মঙ্গোলিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রাচীন অনেক সমাধিস্থল। সাভানা হয়ে গাড়ি চালিয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যায় বিশাল বিশাল পাথরের স্তূপ। রেইনার বলেন—

হতে পারে এসব পাথরের মধ্যে কোনো বিখ্যাত যোদ্ধার সমাধি রয়েছে। হয়তো যোদ্ধার সাথেই সমাহিত অবস্থায় আছে তার তলোয়ার, ধনরত্ন আর সারাজীবন ধরে সংগ্রহ করা ধনসম্পদ।

মঙ্গোলিয়ার রহস্যময় হরিণ পাথর। Image source : Amusing planet.com

‘হরিণ পাথর’ নামে পরিচিত প্রাচীন মেগালিথ, গ্রানাইট দিয়ে তৈরি। সমাধির চারপাশের মনোলিথিক (বড় পাথরের ব্লক) পাথরগুলোতে পৌরাণিক হরিণ খোদাই করা। যা সেই বিখ্যাত যোদ্ধার বর্শা এবং তীর দিয়ে শিকার করা হয়েছে।

উশগিন উভুরে এরকম প্রায় ৩০টি হরিণ পাথর রয়েছে। সেইসাথে পেট্রোগ্লিফ, পাথরের ভাস্কর্য এবং পাথরের সমাধিস্থল রয়েছে। খোইদ তামির উপত্যকায় বোঞ্জ যুগের এরকম আরেকটি স্থান রয়েছে যেখানে ১০০টি হরিণ পাথর রয়েছে।

অসংখ্য হরিণ পাথর Image source : Amusing planet.com

এছাড়া আরখাঙ্গাই প্রদেশের ‘জার্গাল্যান্টিন আম’ এলাকাটি ‘হরিণ পাথর উপত্যকা’ নামে পরিচিত। মঙ্গোলিয়ানরা এসব হরিণ পাথরগুলোকে অত্যন্ত পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।

আংকর ভাট, কম্বোডিয়া

আংকর ভাট হলো কম্বোডিয়ার একটি মন্দির চত্বর যা বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় সৌধ। এটি কম্বোডিয়ার সিয়েম রিপ প্রদেশের ৪০০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। ১২ শতকের প্রথম দিকে খেমার রাজাদের দ্বারা এই মন্দিরটি নির্মিত হয়। ১৪৩১ সালে থাইল্যান্ডের ‘আয়ুত্থায়া’ বৌদ্ধরা খেমার রাজ্য দখলে নিলে আংকর ভাট পরিত্যাক্ত হয়। পরবর্তীতে ১৮৬০ সালে ফরাসী প্রত্নতত্ববিদ হেনরী মুহত পুনরায় আবিস্কার করেন আংকরকে।

এটি মূলত একটি হিন্দু মন্দির ছিল, কিন্তু কালক্রমে এটি একটি বৌদ্ধ মন্দিরে রূপান্তরিত হয়। এই কারণে এটিকে ‘হিন্দু-বৌদ্ধ’ মন্দির হিসাবেও বর্ণনা করা হয়। মন্দিরটি বর্তমানে কম্বোডিয়ার জাতীয় প্রতীক ও পবিত্র স্থান। ১৯৯২ সালে ইউনেস্কো মন্দিরটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষনা করে। এটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানগুলোরও মধ্যে একটি।

আংকর ভাট মন্দির চত্ত্বর। image source : wanderly.com

সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসিনী, স্থানীয় কম্বোডিয়ানসহ প্রতিদিন অসংখ্য পরিদর্শনকারী এখানে প্রার্থনা এবং নৈবেদ্য করতে আসে। এছাড়া পর্যটকরা প্রায় প্রতিদিন সকালেই মন্দিরের গায়ে সূর্যের আলো দেখতে জড়ো হয়। এটি তাদের জন্য একটি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা৷

আংকর ভাটে প্রবেশের চারটি বিশাল পথ রয়েছে। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব এবং পশ্চিম। যা দর্শনার্থীদের একেবারে মন্দিরের কেন্দ্রে নিয়ে যায়। কেন্দ্রস্থলে ররয়েছে পাঁচটি স্তম্ভ বা টাওয়ার। চার দিকে চারটি এবং কেন্দ্রে একটি। কেন্দ্রস্থলের স্তম্ভের উচ্চতা ৬৫ মিটার। রেইনারের মতে এটি একটি শক্তিশালী জায়গা যেখানে একই সাথে পবিত্রতা এবং রহস্যের অনুভূতি হয়।

আংকর ভাট মন্দিরের কেন্দ্রীয় স্তম্ভ। Image source : flickr.com

আংকর ভাট চত্বরে ৭০টির ও বেশি মন্দির এবং ১০০০টি বিল্ডিং রয়েছে। মন্দিরটি পাথরের তৈরি। এখানে অসংখ্য বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের মূর্তি রয়েছে। দেওয়ালের চারপাশ ঘিরে, ভেতরে বাইরে রয়েছে পাথরে খোদাই করা দেব-দেবী, সমকালীন রাজা, যুদ্ধ এবং সমাজ জীবনের চিত্র।

এছাড়াও রয়েছে রামায়ন, মহাভারত কাহিনির চিত্র ও অনান্য হিন্দু পৌরাণিক উপাখ্যান। অনেকের মতে আংকর ভাট পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্মীয় স্থাপনা।

Feature Image: bbc.com 
References: 

01. Five Ancient Sacred Sites Around The Globe. 
02. Whale Bone Alley. 
03. Angkor Wat.  
04. The Tombs of Hegra.