স্থাপত্যশিল্প শুধুমাত্র মানুষের মেধা আর পরিশ্রমের ফল নয়, তা একইসাথে সময়কে ধরে রাখার কৌশলও বটে। ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যাবে, প্রযুক্তি, উদ্ভাবনী চিন্তা আর জীবনযাত্রা ঘিরে আছে সেই সময়ের বাড়ি, উপাসনালয় থেকে শুরু করে বিনোদনের জায়গা পর্যন্ত। গুহায় বসবাস ছেড়ে মানুষ যখন নিজ উদ্যোগে একটি কাঠামো গড়ার দিকে মন দিল হয়তো সেদিনই স্থাপত্যশিল্পের শুরু।
সময় এবং প্রযুক্তির উন্নতির সাথে বদলেছে স্থাপত্য, নকশা, এবং সুযোগ-সুবিধার প্রকৃতি। বর্তমানে, সৃজনশীলতা প্রকাশের আরেক মাধ্যমও এই স্থাপত্যশিল্প। আর তাই, প্রতিনিয়ত বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, পর্যটন শিল্প ইত্যাদি নানা কারণে অনন্য স্থাপত্যের নিদর্শন দেখা যাচ্ছে।
আসছে ফুটবল বিশ্বকাপ ২০২২। ফুটবলপ্রেমীদের উন্মাদনা বাড়াতে যোগ হয়েছে নান্দনিক ও অসাধারণ কিছু স্টেডিয়াম। আয়োজক দেশগুলোর মাঝে উৎসাহ এবং চেষ্টা ছিল একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। এর মাঝে ফুটবল ভক্তদের কাছে নতুন বিস্ময় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে কাতারের স্টেডিয়াম ৯৭৪।
পরিচিতি
এটি পূর্বে ‘আবু আউদ স্টেডিয়াম’ পরিচিত ছিল। স্টেডিয়াম ৯৭৪ একইসাথে স্থাপত্যশৈলী এবং ইঞ্জিনিয়ারিং জগতের মাস্টারপিসে পরিণত হয়েছে। এটি ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২-এর জন্য বিশেষভাবে তৈরি হয়েছে। কাতার উদ্ভাবনজগতেও নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এর মাধ্যমে। স্টেডিয়ামটি বিমানবন্দরের সবচেয়ে কাছে অবস্থিত। এটি হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং দোহা বন্দর থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। এর ধারণক্ষমতা ৪০,০০০ সিট বলা হচ্ছে।
ভিন্নতা
স্টেডিয়ামটি অন্যদের থেকে ভিন্ন কারণ, এটিই বিশ্বের প্রথম অস্থায়ী স্টেডিয়াম যেটি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ইভেন্টের পরে পুনরায় ব্যবহার করা হবে। টুর্নামেন্টের পর এর শিপিং কন্টেইনার, আসনসহ সবকিছু, স্টেডিয়াম অবকাঠামো নেই এমন দেশগুলোকে উপহার দেওয়া হবে।
স্টেডিয়াম ৯৭৪, নামের পরিবর্তে নম্বর বহনকারী প্রথম স্টেডিয়াম। এর কারণ দুটি-প্রথমত, ৯৭৪ হলো কাতার রাজ্যের আন্তর্জাতিক ডায়ালিং কোড। দ্বিতীয়ত, সংখ্যাটি স্টেডিয়াম নির্মাণে ব্যবহৃত কন্টেইনারের সংখ্যা।
এখন পর্যন্ত ‘ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ অ্যাসোসিয়েশন ফুটবল (ফিফা)’ বা ‘গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে’ অন্য কোন বিশ্বকাপ স্টেডিয়াম এই রেকর্ড করেনি। স্টেডিয়ামের নিকটবর্তী বন্দর এবং দোহার সামুদ্রিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুরো প্রকল্পটি উৎসর্গ করা হয়েছে।
নির্মাণশৈলী
স্টেডিয়াম ৯৭৪ প্রথম স্টেডিয়াম যা ৯৭৪টি শিপিং কন্টেইনার দিয়ে তৈরি। রঙিন কন্টেইনারগুলো স্টেডিয়ামটিকে ভিন্ন এক রূপ দিয়েছে। একইসাথে, একে টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলেছে। কন্টেইনারগুলো একইসাথে সিঁড়ি এবং রেস্টরুম তৈরির জায়গা হিসাবেও ব্যবহৃত হয়েছে।
তাছাড়া, অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীও কাজের জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে কন্টেইনারগুলো। স্টেডিয়ামটির কাঠামো রিসাইকেলড মডুলার ইস্পাত দিয়ে তৈরি। ফলে নির্মাণে ব্যবহৃত উপাদানগুলোর বর্জ্যের পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি, উন্নত সরঞ্জাম ব্যবহারে পানির ব্যবহার ৪০ শতাংশ কম হয়েছে।
আসনগুলোর আকৃতি এবং পর্যাপ্ত জায়গা থাকায়, বাতাস চলাচল এবং আর্টিফিশিয়াল কুলিং সিস্টেম ব্যবহার সহজ হয়েছে। তাছাড়া, পারস্য উপসাগরের কাছাকাছি হওয়াতে কুলিং সিস্টেমের উপর চাপ কম হয়ে প্রাকৃতিকভাবেই একটি ঠান্ডা ও আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে।
এই স্টেডিয়ামটি স্টেডিয়াম ডিজাইনের জগতে একটি মাইলফলক হিসাবে কাজ করবে। খেলা সম্প্রচারের জন্য স্টেডিয়ামটিতে রয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত থাকার সকল সুবিধা।
স্টেডিয়ামটি থেকে একইসাথে আরব উপসাগরের উপকূলের চমৎকার দৃশ্য এবং দোহার পশ্চিম উপসাগরের গগনচুম্বী অট্টালিকা (skyscrapers) উপভোগেরও সুযোগ রয়েছে। ভক্তরা যাতে কোনো জটিলতা ছাড়াই স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে এবং বের হতে পারে এমন সহজ উপায়ে ডিজাইন করা হয়েছে।
নির্মাতা
স্টেডিয়াম ৯৭৪, মূলত স্প্যানিশ স্টুডিও ফেনউইক ইরিবারেন আর্কিটেক্টস ফার্মের কাজ। সাথে ছিলেন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার শ্লাইচ বার্গারম্যান পার্টনার এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্সি হিলসন মোরান, যারা ডিজাইনের কাজটি করেছেন। স্টেডিয়ামটির কাজ পরিচালনা করেছেন ‘টাইম কাতার’ (Time Qatar)।
‘এইচবিকে কন্ট্রাক্টিং কোম্পানি’ (HBK Contracting Company) ছিল প্রধান প্রকল্প সমন্বয়কারী, এবং মোহাম্মদ আল আতওয়ান ফ্যাসিলিটি ম্যানেজমেন্ট ডিরেকটর। ব্যবহৃত শিপিং কন্টেইনারগুলো বিশ্বের বৃহত্তম কন্টেইনার প্রস্তুতকারক- ‘চায়না ইন্টারন্যাশনাল মেরিন কন্টেইনার’ নতুনভাবে তৈরি করেছে।
নির্মাণের ইতিহাস
স্টেডিয়াম তৈরির পরিকল্পনা শুরু হয় ২০১৫ সালে। স্টেডিয়াম ৯৭৪ কাতার পেট্রোলিয়ামের অন্তর্গত একটি পুরানো শিল্প জমিতে নির্মিত। নির্মাণ শুরু হওয়ার আগে তাই মাটি ও পানির জন্য সাইটটি সম্পূর্ণরূপে দূষণমুক্ত করতে হয়।
২৬ নভেম্বর, ২০১৭ তারিখ ফেনউইক ইরিবারেন আর্কিটেক্টস স্টেডিয়ামটির নকশা উন্মোচন করে। পরের বছরের ২৮ মে ঠিকাদার ঠিক করা হয় কাতারের কোম্পানি এইচবিকে (HBK)। ২০১৭ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে সাইটটির পরিবেশগত অপারেশন শুরু হয়৷
মাটি সংক্রান্ত কাজ জুলাই ২০১৯ এর মধ্যে শেষ হয়ে যায়। এর মাঝেই শিপিং কন্টেইনারগুলোর প্রথম ব্যাচ এসে পৌঁছায়। মূল কাজ শুরু হয় ১ নভেম্বর, ২০১৯ সালে। মার্চ মাসে মাঠের মূল কাঠামো সম্পূর্ণ হয়। এক মাস পরে, টার্ফ স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০ নভেম্বর, ২০২১-এ ভার্চুয়াল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্টেডিয়ামের নাম স্টেডিয়াম ৯৭৪-এ পরিবর্তন করা হয়।
ম্যাচ
স্টেডিয়াম ৯৭৪ তার প্রথম ম্যাচটি ৩০ নভেম্বর, ২০২১-এ আয়োজন করেছিল। সেটি ছিল ফিফা আরব কাপের উদ্বোধনী দিনে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সিরিয়ার ম্যাচ। ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপের মেক্সিকো এবং পোল্যান্ডের ২২ নভেম্বরের ম্যাচ দিয়ে এর বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হবে।
যাত্রাপথ
স্টেডিয়াম ৯৭৪-এ মেট্রোর মাধ্যমে সহজেই যাওয়া যাবে। দোহা মেট্রো গোল্ড লাইন ৮০০ মিটার দূরে থাকায় গাড়ি বা শাটল বাসের মাধ্যমে সেখানে যাওয়া সহজ।
স্বীকৃতি
সুপ্রিম কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল হাসান আল থাওয়াদি স্টেডিয়াম ৯৭৪ এর সাফল্য নিয়ে বলেছেন,
আমরা এই উদ্ভাবনী ভেন্যুটিকে ভবিষ্যতের মেগা-ইভেন্ট হোস্টদের জন্য গেম-চেঞ্জার হিসাবে বিবেচনা করি। এটি আমাদের বিশ্বকাপে শক্তিশালী উত্তরাধিকারের আরেকটি উদাহরণ।
স্টেডিয়াম ৯৭৪ ‘গ্লোবাল সাসটেইনেবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট সিস্টেম (GSAS)’ থেকে ডিজাইন এবং নির্মাণে ফাইভ স্টার রেটিংসহ একটি সাসটেইনেবিলিটি সার্টিফিকেট পেয়েছে। পাশাপাশি ‘গালফ বা উপসাগরীয় গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (GORD)’ থেকে নির্মাণ ব্যবস্থাপনায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়েছে।
স্টেডিয়াম ৯৭৪ শুধু তার নির্মাণশৈলী আর ভিন্নতার জন্যই নয়, পরিবেশবান্ধব ডিজাইনেরও এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এটি প্রমাণ করে যে, পরিবেশের ক্ষতি না করেও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সম্ভব। রিসাইকেল বা নবায়নযোগ্য কাজের জন্য ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে স্টেডিয়াম ৯৭৪।
Featured Image: gajreport.com References: 01. Stadium-974-Innovative-Architecture-and-Sustainability-and-Creativity-Symbol. 02. Stadium-974-a-Pioneer-in-Development-and-Mega-Events. 03. This-Fifa-World-Cup-Stadium-Was-Built-Using-974-Shipping-Containers. 04. Stadium974. 05. Stadium-974-a-Symbol-of-Innovation-and-Sustainability. 06. Stadium-974-in-Qatar-is-a-Masterpiece-to-Behold.