আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরেই পর্দা উঠবে ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২। ‘গ্রেটেষ্ট শো অন আর্থ’ নামে পরিচিত ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ এলে যেন বিশ্ববাসীদের মধ্যে উন্মাদনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২ এর আয়োজক দেশ হলো মধ্যেপ্রাচ্যের দেশ কাতার। প্রতি চার বছর পরপর জুন-জুলাইয়ের দিকে গ্রেটেষ্ট শো অন আর্থের পৃথিবীতে মঞ্চ বসে।
কিন্ত এবার এই মঞ্চ বসছে নভেম্বর-ডিসেম্বর দিকে। কেননা কাতারে এইসময় থাকে শীতকাল। যা ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের খেলোয়াড়দের জন্য সুবিধার। ফুটবল বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে ক্রীড়াপ্রেমীদের আগ্রহের কোন শেষ থাকে না। আর কাতার বিশ্বকাপের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আটটি দৃষ্টিনন্দন স্টেডিয়াম। কারণ স্টেডিয়ামগুলোতে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ছোঁয়া। আজকের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় দৃষ্টিনন্দন ৮টি স্টেডিয়াম।
লুসাইল স্টেডিয়াম
লুসাইল স্টেডিয়াম লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়াম নামেও পরিচিত এবং এটি একটি নব-নির্মিত স্টেডিয়াম। লুসাইল স্টেডিয়াম কাতারের রাজধানী দোহা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং দ্য পার্ল থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে নতুন লুসাইল শহরে অবস্থিত। এই স্টেডিয়ামের নকশা মূলত সভ্যতার উত্থানের সময় সমস্ত আরব এবং ইসলামিক বিশ্বজুড়ে পাওয়া শিল্পকর্ম দ্বারা অুনপ্রাণিত হয়ে বাটি-আকৃতির মতো করে নকশা করা হয়।
স্টেডিয়ামের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের দিকে। কাজ শেষ হতে প্রায় চার বছর সময় লাগে। লুসাইল স্টেডিয়াম-এর দর্শক ধারণক্ষমতা হলো ৮০,০০০। এটি কাতার বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম। ২০২২ বিশ্বের ফাইনাল ম্যাচ এই স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্বকাপের শেষে স্টেডিয়ামের বড় অংশগুলো ভেঙে ফেলা হবে। এই ছোট মাঠটি দোকান, অবকাশ এবং খেলাধূলার সুবিধাসহ কমিউনিটির একটি অংশ হয়ে যাবে।
আল বায়াত স্টেডিয়াম
আল বায়াত স্টেডিয়াম আল খোর স্টেডিয়াম নামেও পরিচিত। এই স্টেডিয়াম ছোট শহর আল খোর শহরের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। রাজধানী দোহা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে আল বায়াত স্টেডিয়াম অবস্থিত। ২০১৫ সালের দিকে স্টেডিয়ামের মূল কাজ শুরু হয়েছিল। আল বায়াত স্টেডিয়ামের নকশা একটি বেদুইন তাবুর অভ্যন্তর দিকটাকে প্রতিফলিত করে। যা রঙিন লাল, সাদা এবং কালো। এই স্টেডিয়ামের ছাদটি প্রায় ২০ মিনিটের মধ্যে খোলা ও বন্ধ করা যায়।
আল বায়াত স্টেডিয়ামের মোট ধারণক্ষমতা হলো ৬০,০০০ আসন। এই স্টেডিয়াম তিনটি স্তরে বিভক্ত। বিশ্বকাপের পর শীর্ষ স্তরটি সরিয়ে ফেলা হবে। এতে ধারণক্ষমতা ৩২,০০০ আসন কমে যাবে। বিশ্বের উদ্বোধনী দিনে মোট ৩ ম্যাচ এই স্টেডিয়ামে হবে। স্বাগতিক কাতার তৃতীয় ম্যাচ খেলবে আল বায়াত স্টেডিয়ামে।
আল জানুব স্টেডিয়াম
আল জানুব স্টেডিয়াম আগে আল ওয়াকরাই স্টেডিয়াম নামে পরিচিত ছিল। স্টেডিয়ামটি সেন্ট্রাল সোক এবং আল ওয়াকরাই উপকূল থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। ২০১৬ সালের দিকে স্টেডিয়াম-এর মূল কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালের দিকে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন সমস্যার কারণে ২০১৯ সালে এর কাজ শেষ হয়।
আল জানুব স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৯ সালের ১৬ মে আল-দুহাইল এবং আল-সাদ এর মধ্যে একটি ম্যাচ হয়। আল জানুব স্টেডিয়াম ডিজাইন করেছেন প্রখ্যাত স্থপতি জাহা হাদিদ। এর নকশা ঐতিহ্যবাহী মুক্তা যা মূলত মাছ ধরার হুল সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে করা হয়। আল জানুব স্টেডিয়ামের মোট ধারণক্ষমতা ৪০,০০০ আসন। বিশ্বকাপের পর ২০,০০০ আসনের একটি স্তর সরিয়ে ফেলা হবে।
আহমেদ বিন আলী স্টেডিয়াম
আহমেদ বিন আলী স্টেডিয়াম আল রাইয়ান স্টেডিয়াম নামেও পরিচিত। এই স্টেডিয়াম দোহা শহরের পূর্ব প্রান্তে আল রাইয়ানের উপকন্ঠে অবস্থিত। বিশ্বকাপের জন্য মূলত স্টেডিয়ামটি সম্প্রসারণ ও সংস্কার করার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, সম্পূর্ণ নতুন স্টেডিয়াম তৈরি করা হয়। ২০১৪ সালে শেষ ম্যাচ হয় এরপর স্টেডিয়ামের কাজ শুরু হয়।
২০১৫ সালে চূড়ান্ত নকশা পেশ করা হয় এবং ২০১৬ সালের শেষের দিকে মূল ভিত্তির কাজ শুরু হয়। আহমেদ বিন আলী স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২০ সালে ১৮ ডিসেম্বর আল-সাদ এবং আল-আরাবির মধ্যে আমির কাপের ফাইনাল ম্যাচ খেলা হয়। বিশ্বকাপের জন্য স্টেডিয়ামের মোট ধারণক্ষমতা ৪০,০০০ আসন। বিশ্বকাপ শেষে এর অর্ধেকের বেশি সরিয়ে ফেলা হবে। তখন ধারণক্ষমতা হবে প্রায় ২১,০০০ আসন।
খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম
১৯৭৬ সাল থেকে কাতারের জাতীয় স্টেডিয়াম হলো খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম। এটি কাতারের রাজধানী দোহাতে অবস্থিত। প্রথমদিকে এই স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা ছিল ২০,০০০ আসন। তবে ২০০৬ সালে এশিয়ান গেমসের সময় ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে ৪০,০০০ আসন করা হয়। মাঝে মাঝে এখানে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
বিশ্বকাপ উপলক্ষে স্টেডিয়াম নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। স্টেডিয়ামের প্রায় ৭০% জুড়ে রয়েছে একটি বৃহৎ মেমব্রেন ছাদ। খলিফা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের মোট ধারণক্ষমতা ৪০,০০০ আসন। এখানে গ্রুপ পর্বের ৫টি ম্যাচ সহ আরো ২টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে।
এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম
এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম কাতার ফাউন্ডেশন স্টেডিয়াম নামেও পরিচিত। এই স্টেডিয়াম এডুকেশন সিটি কমপ্লেক্সে নামক স্থানে অবস্থিত। যেখানে দেশি-বিদেশি মানুষের আনাগোনা থাকে। সাথে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। মূলত বাইরাইন থেকে ৫১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম। ২০১৪ সালের দিকে গ্রাউন্ড তৈরির কাজ শুরু হয়। মূল ভিত্তি প্রস্তরের কাজ শুরু হয় ২০২৬ সালের শেষের দিকে। স্টেডিয়ামের কাজ শেষ হয় ২০২০ সালের দিকে।
প্রথম ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর। এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম দেখলে মনে হয় মরুভূমির মধ্যে একটি হীরা প্রতিফলিত হচ্ছে। এমন মোটিফ থেকেই এটার ডিজাইন করা হয়েছে। স্টেডিয়ামের মোট ধারণক্ষমতা ৪০,০০০ আসন। বিশ্বকাপ শেষে আসন সংখ্যা কমিয়ে ২০,০০০ করা হবে। বিশ্বকাপের মোট ৭টি ম্যাচ এই স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে। তাছাড়া এর আগে বার্য়ান মিউনিখ এবং টাইগ্রেস ইউএএনএল (১-০) এর মধ্যে ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
স্টেডিয়াম ৯৭৪
স্টেডিয়াম ৯৭৪ হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেের কাছে দোহার পূর্বে উপসাগরের তীরে অবস্থিত। কাতারের জাতীয় জাদুঘর থেকে দুই কিলোমিটারের পথ মাত্র। আগে এই স্টেডিয়াম রাস আবু আউদ স্টেডিয়াম নামে পরিচিত ছিল। স্টেডিয়ামের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের দিকে এবং তিন বছর পর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সিরিয়ার মধ্যেকার আরব কাপ (২-১) গ্রুপ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।
স্টেডিয়াম ৯৭৪ শিপিং কনটেইনাসহ মডুলার ব্লক দিয়ে করা হয়েছে। মূলত বিশ্বকাপের পর, এটি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলা হবে এবং কনটেইনারগুলো পুনরায় ব্যবহার করা হবে। কাতারের আন্তর্জাতিক কলিং কোড হলো ৯৭৪। সেইসাথে ডিজাইনের কাজে ৯৭৪টি শিপিং কনটেইনার ব্যবহার করা হয়েছে বলে এই স্টেডিয়ামের নাম ৯৭৪। স্টেডিয়ামের মোট ধারণক্ষমতা হলো ৪০,০০০ আসন। বিশ্বকাপের মোট ছয়টি ম্যাচ এই স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে।
আল থুমামা স্টেডিয়াম
কাতার, ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ ২০২২ নতুন নির্মিত স্টেডিয়ামগুলোর একটি হলো আল থুমামা স্টেডিয়াম। রাজধানী দোহার দক্ষিণে অবস্থিত এই স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামের নির্মান কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের দিকে এবং শেষ হতে প্রায় চার বছর সময় লেগেছিল। স্টেডিয়ামের বৃত্তাকার নকশা গাহফিয়া থেকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী বোনা টুপি যা সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যে পুরুষরা পরিধান করে।
আল থুমামা স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর আল-সাদ এবং আল-রাইয়ান (১-১) এর মধ্যে ৪৯তম আমির কাপের ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। এই স্টেডিয়ামের মোট ধারণক্ষমতা ৪০,০০০ আসন। তাছাড়া বিশ্বকাপে মোট ৭টি ম্যাচ এখানে অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্বকাপ শেষে উপরের স্তর সরিয়ে ধারণক্ষমতা ২০,০০০ আসন করা হবে। ফুটবলপ্রেমীরা কাতারের এই আটটি দৃষ্টিনন্দন স্টেডিয়ামে বসে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ ২০২২ উপভোগ করবে।
Feature Image: news.cgtn.com References: 1. Fifa-world-cup-2022-stadiums-Qatar 2. All Stadiums of Qatar World Cup