আপনি কখনোই একটি পর্বতকে জয় করতে পারবেন না,
আপনি কেবল নিজেকে জয় করতে পারেন।
আমেরিকান পরিচালক জিম হুইটটেকার-এর এই উক্তির মাধ্যমেই বুঝা যায়, পৃথিবী জুড়ে অবস্থিত পর্বতমালার সুবিশাল অস্তিত্ব। আজ তেমনই এক অতিকায় পর্বতমালা নিয়ে আলোচনা হবে, যা আফ্রিকা মহাদেশের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।
মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো পৃথিবীর অন্যতম এক সুন্দর পর্বত। এই পর্বতটি বিষুবরেখার প্রায় মাঝামাঝিতে অবস্থিত। এই পর্বত ঘিরে রয়েছে রোমাঞ্চকর, মনোমুগ্ধকর সব দৃশ্য। স্থানীয় গাছপালা উঁচু-নিচু ঢাল যা পর্বতারোহীদের মনোভাব এবং সাহসিকতাকে চ্যালেঞ্জ জানার জন্য এক অনন্য মনোভাব নিয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে এবং যা সকল দর্শকদের আকর্ষণ করে।
প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক এই কিলিমাঞ্জারোর অতুলনীয় দৃশ্য দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে পর্বতের পাদদেশে ভীড় জমান। এদের মধ্যে অনেক লোক তাদের কিলিমাঞ্জারো ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে ‘জীবন-পরিবর্তনকারী’, ‘অসাধারণ’ এবং ‘অতুলনীয়’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
অবস্থান এবং উচ্চতা
তানজানিয়াতে কেনিয়ার সীমান্তে অবস্থিত এই সুবিশাল এই মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৯,৩৪০ ফুট (বা ৫৮৯৫ মিটার) উপরে অবস্থিত এবং যা সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। এই পর্বতশৃঙ্গের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো গেইট এবং রাস্তা, এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-লন্ডোরোসি গেট; যা পর্বতের উত্তর দিকের রাস্তায় চলাচলের জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি প্রায় পর্বতের ৭৭৪০ ফুট উঁচু পর্যন্ত বিস্তৃত।
এরপরে রয়েছে ম্যাসামে গেট, এটি সাধারণত ব্যবহার করা হয় ম্যাসামে নামের একটি রুট ব্যবহারের জন্য। এই গেইটটি পর্বতের প্রায় ৫৭২০ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রতিবছর প্রায় হাজার হাজার পর্বতারোহী এই মাউন্ট কিলিমাঞ্জারোতে আরোহণের জন্য পাড়ি জমান। আর এইসব পর্বতারোহীদের মারাঙ্গু রুট বা মারাঙ্গু গেট ব্যবহার করে তাদের পর্বতারোহণ শুরু করতে হয়। এই মারাঙ্গু রুট প্রায় ৮৮৬০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
পর্বতারোহীদের কারণে এই রুটটি কিলিমাঞ্জারোর সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং মাঝে মাঝে অনেক পর্বতারোহীদের ভিড়ের কারণে এই রুট অনেক ব্যস্ত থাকে। নালেমুরু গেট যা সাধারণত রোঙ্গাই রুট নামে পরিচিত। এই নালেমুরু রুট কিলিমাঞ্জারো আরোহণের সূচনা কেন্দ্র। রুটটি পর্বতের প্রত্যন্ত উত্তর দিকে অবস্থিত।
এই নালেমুরু রুটটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬৪০০ ফুট বা ১৯৫০ মিটার উঁচু। উম্বুই গেট; এই গেইটটি কিলিমাঞ্জারো রুটের ট্রেইলহেড, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫২৫০ ফুট বা ১৬০০ মিটার উপরে অবস্থিত। তবে পর্বতারোহীদের কিলিমাঞ্জেরোর পুরো ১৯,৩৪০ ফুট আরোহণের প্রয়োজন পড়ে না।
ঐতিহ্যবাহী পর্বতমালার নামকরণ
তানজানিয়াতে অবস্থিত এই মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো সম্পর্কে অনেক ধাঁধার সমাধান করা গেলেও, এর নামের উৎপত্তি সম্পর্কে ধাঁধার সমাধান এখনো হয়নি। কিলিমাঞ্জারোর নাম সম্পর্কে অনেক ইতিহাসবিদ বলে থাকেন আফ্রিকার চাগ্গা উপজাতির শব্দ থেকে এই নাম উদ্ভূত হয়েছে (যারা সাধারণত তাদের ঐতিহ্যগতভাবে কিলিমাঞ্জারোর পর্বতমালার আশেপাশে বসবাস করে। ধারণা করা হয়, পূর্ব আফ্রিকা জুড়ে সোয়াহিলি ভাষা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়ার আগেও তারা এখানে বসবাস করতো)।
আবার কেউ কেউ বলে থাকেন যে কিলিমাঞ্জারো নামটি চাগ্গা ভাষার কিলেলেমা এবং নাজারে শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ যথাক্রমে ‘অসম্ভব’ এবং ‘পাখি’। অর্থাৎ নামদুটি একসাথে মিলিত হলে তাদের অর্থ হতে পারে ‘পাখির পক্ষেও অসম্ভব’। অর্থাৎ বুঝানো হয়েছে যে এই পর্বতমালা আরোহণ পাখির পক্ষেও অসম্ভব।
জোহানেস রেবম্যান, কিলিমাঞ্জেরোর প্রথম অভিযাত্রীদের একজন অনুমান করেছিলেন যে জারো শব্দের অর্থ হলো ‘কারাভান’ এবং কিলেলেমা শব্দের সাথে একত্রে নেওয়া হলে, অর্থ হবে ‘যারা কাফেলাকে থামায়’। যা, ঐতিহাসিকভাবে কিলিমাঞ্জারোর আফ্রিকান সমভূমি জুড়ে কাফেলাদের জন্য একটি বাধা তৈরি করেছিল।
এছাড়াও, কেউ কেউ লিখেছেন যে চাগ্গা ভাষায় ‘জারো’ অর্থ ‘সাদা’। যা আগ্নেয়গিরির তুষারের মাথার একটি উল্লেখযোগ্য অর্থ হতে পারে এবং যা বিখ্যাত লেখক, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ‘সাদা’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। আবার কেউ কেউ মনে করে থাকেন যে এটি অশুভ আত্মার নামও হতে পারে যেটি পাহাড়ের ঢালে বা পাদদেশে বাস করে। যদিও এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কেও বলতে পারেনা যে, এই ‘কিলিমাঞ্জারো’ নামটি কোথা থেকে এসেছে!
গঠন, আকৃতি এবং ইতিহাস
কিলিমাঞ্জারো শুধু আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত নয়, এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ স্বাধীন পর্বত অর্থাৎ এটি অন্য কোনো পর্বতমালার অংশ নয়। এটি সম্পূর্ণ নিজস্ব স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। মূলত এটি একটি বিলুপ্ত আগ্নেয়গিরির কেন্দ্রস্থল।
ধারণা করা হয় যে, প্রায় ৭৫০ হাজার বছর আগে একটি শক্তিশালী অগ্ন্যুৎপাতের কারণে ভূত্বকে একটি বড় ফাটল ধরেছিল। এর পেছনের শক্তি এতটাই বিশাল ছিল যে এটি মাটি এবং শিলাকে ছুঁড়ে ফেলে এক সুবিশাল পর্বতমালা তৈরি করেছিল, যা কিলিমাঞ্জারো পর্বত তৈরি করে। এটি প্রায় দুই লক্ষ বছর ধরে বিস্ফোরিত হয়ে এসেছিল।
কিলিমাঞ্জারোতে তিনটি আগ্নেয়গিরির কুন্ডলী রয়েছে। এদের নাম যথাক্রমে- মাওয়েঞ্জি, শিরা এবং কিবো। মাওয়েনজি এবং শিরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু কিবো সর্বোচ্চ শিখরে সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে এবং এটি আবার বিস্ফোরিত হতে পারে। সবচেয়ে সাম্প্রতিক অগ্ন্যুৎপাত ছিল প্রায় ২০০ বছর আগে। মাউন্ট কিলিমাঞ্জারোর ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় তথ্যে পূর্ণ।
কিলিমাঞ্জারো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ ১৯ শতকের শেষের দিকে শুরু হয়েছিল, যা ঐতিহাসিকদের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ ছিল। কিলিমাঞ্জারো সম্পর্কে প্রথম উল্লেখযোগ্য তথ্য আলেকজান্দ্রিয়ার টলেমি রেখেছিলেন, যার লেখার মাধ্যমে আমরা আফ্রিকান উপকূলের কাছাকাছি একটি নির্দিষ্ট বড়, তুষার-ঢাকা পর্বতের বর্ণনা জানতে পারি।
ষষ্ঠ শতাব্দির দিকে আরব ব্যবসায়ীরা পূর্ব আফ্রিকান উপকূলে এসেছিলেন এবং মূল ভূখণ্ডের অন্বেষণ করেছিলেন, এবং তারা তাদের ভ্রমণ কেন্দ্রগুলোর একটিতে কিলিমাঞ্জারোর উপস্থিতি লক্ষ্য করেছিলেন। কিলিমাঞ্জারো সম্পর্কে পরবর্তী লিখিত রেকর্ডটি পাওয়া যায় প্রায় এক সহস্রাব্দের পরে, যখন পর্তুগিজরা কেনিয়ার (মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো কেনিয়ার সীমান্তে অবস্থিত) মোম্বাসা এবং উপকূল বরাবর আরও কয়েকটি দুর্গে একটি দৃঢ় অবস্থান অর্জন করেছিল।
কিলিমাঞ্জারোর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
১৯১২ সাল থেকে কিলিমাঞ্জেরোর বরফখণ্ড প্রায় ৮২ শতাংশ পানিতে পরিণত হয়েছে৷ বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন যে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে হিমবাহগুলি সম্পূর্ণরূপে গলে যেতে পারে৷ এর পেছনে বিজ্ঞানীরা দায়ী করছেন বন উজাড় এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে। উক্ত সমস্যা মোকাবেলায় ২০০৮ সালে পর্বতমালার গোড়ার চারপাশে প্রায় ৫০ লক্ষ গাছ লাগানো হয়েছিল।
সফলভাবে কিলিমাঞ্জারো আরোহণ করা সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি হলেন ৮৯ বছর বয়সী আমেরিকান মহিলা অ্যান লরিমোর। তিনি ২০১৯ সালে ডক্টর ফ্রেড ডিস্টেলহর্স্টের কাছ থেকে বিশ্ব রেকর্ডটি নিজের করে নিয়েছিলেন, যার বয়স ছিল ৮৮ বছর যখন তিনি পর্বতারোহণ করেছিলেন।
কিলিমাঞ্জারো আরোহণকারী সবচেয়ে কম বয়সী ব্যক্তি হলেন আমেরিকান কোলটান ট্যানার, তিনি ২০০৮ সালে ছয় বছর বয়সে কিলিমাঞ্জেরো আহোরণ করেছেন। সবচেয়ে কম বয়সী মেয়েটি হলেন অ্যাশলিন ম্যান্ড্রিক, যিনিও এই কীর্তিটি সম্পন্ন করার সময় ছয় বছর বয়সী ছিলেন।
প্রতিবছর প্রায় হাজার হাজার পর্বতারোহী কিলিমাঞ্জারোতে আসেন পর্বতারোহণ করার জন্য।যদিও তার অর্ধেক পর্বতারোহীই পর্বতে উঠতে ব্যর্থ হন।
কিলিমাঞ্জেরোর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ
বর্তমানে কিলিমাঞ্জেরোর আগ্নেয়গিরিটি অভ্যন্তরে সুপ্ত বলে মনে করা হয়। পাহাড়ের চূড়ায় হিমবাহে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গিয়েছে বরফেরখন্ডের পরিমাণ ৮০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে। ২০০২ সালে, ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির বরফের কোর প্যালিওক্লিম্যাটোলজিস্টের নেতৃত্বে একটি ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বতটির উপরে বরফখন্ডগুলো ২০১৫ এবং ২০২০ এর মধ্যে গলে যাবে।
২০০৭ সালে, ইনসব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানীদের একটি দল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে মালভূমির বরফখন্ড ২০৪০ সালের মধ্যে গলে যাবে, তবে স্থানীয় অনুকূল আবহাওয়ার কারণে পাহাড়ের ঢালের কিছু বরফ দীর্ঘদিন অক্ষত অবস্থায় থাকবে। বরফের পরিমাণ এর রেকর্ডগুলির একটি তুলনা একটি অবস্থার জানান দেয় যে আজকের পরিস্থিতি প্রায় ১১ হাজার বছর আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে।
Feature Image: pinterest.com Reference: 01. Kilimanjaro. 02. 12 interesting kilimanjaro facts. 03. Kilimanjaro.