বিশ্বের সকল ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে সমুদ্র সৈকত যেন সর্বদাই আলাদা একটা আবেগের নাম। সমুদ্রে গভীর নীল জল-রাশি, সেই সাথে সমুদ্রতট থেকে সূর্যোদয় অথবা সূর্যাস্ত উপভোগ করার স্বর্গীয় সুখ কেবল যারা স্বশরীরে উপভোগ করে তারাই বলতে পারবে। সমুদ্রের নীল জল, সৈকত পাড়ের সবুজ বনানী আর উত্তপ্ত বালির গড়পড়তা এই দৃশ্য ছাড়াও বাহারি রঙের বর্ণচ্ছটা কোথায়, কিভাবে লুকিয়ে আছে তা নিয়েই আজকের আয়োজন।
পিংক স্যান্ড বিচ, বাহামা
অদ্ভুত সুন্দর গোলাপি রঙের বালি দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে পিংক স্যান্ড বিচ। বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর এবং রঙিন সমুদ্র সৈকতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এটি। বাহামার হারবার আইল্যান্ডে গেলে দেখা মেলে গোলাপি রঙের এই বালুকাময় সৈকতের।
উষ্ণ এবং শান্ত জলের এই সমুদ্র সৈকতে প্রতি বছর আসা দর্শনার্থীদের সংখ্যাও একারণে নেহাত কম নয়। প্রায় তিন মাইল প্রসারিত এই সৈকত বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি সমুদ্র সৈকতের মধ্যে একটি হিসাবে নিজের স্থান অর্জন করে নিয়েছে।
সমুদ্র সৈকত গোলাপি রঙের দেখানোর কারণ হচ্ছে ফোরামিনিফেরা নামে পরিচিত এককোষী সামুদ্রিক জীব বা শৈবাল। এই শৈবালগুলো মূলত সামুদ্রিক কোরালের উপর জন্মায়।
সমুদ্রের পানির সাথে মিশে থাকার কারণে পানিগুলোকে যেমন গোলাপি দেখায় তেমনই শৈবালের শেলগুলো সমুদ্রের পানির সাথে মিশে সৈকতের সাদাবালির সাথে মিশে যায়। অসংখ্য গোলাপি শেল, সাদাবালির সাথে মেশার ফলে মনে হয় বালুগুলোই যেন গোলাপি রঙের।
গ্লাস বিচ, হাওয়াই
সমুদ্র সৈকত বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দৃষ্টির অসীম সীমানাজুড়ে নীল পানি আর সমুদ্রতীরের তপ্ত বালু। কিন্তু রঙ-বেরঙের গ্লাসে ভরা সমুদ্র সৈকতের একটি দৃশ্য যদি কল্পনা করা হয় ঠিক কতটা বিস্ময়কর তা মাপা বুঝি অসম্ভব। হাওয়াই দ্বীপের তেমনই একটা সমুদ্র সৈকত হচ্ছে গ্লাস বিচ বা কাচের টুকরোর সমুদ্র সৈকত। তবে অবাক করার মতোন ঘটনা হচ্ছে, এটি প্রাকৃতিকভাবেই গ্লাস দিয়ে সৃষ্ট কোনো সমুদ্র সৈকত নয়।
১৯০৬ সালের দিকে ফোর্ট ব্রাগের বাসিন্দারা তাদের নিত্য ব্যবহার্য বাতিল জিনিসপত্র এই সৈকতে ফেলতে শুরু করে। যার বেশিরভাগ ছিল কাচের তৈরি। ফেলে দেওয়া কাচের টুকরোগুলোই সময়ের আবর্তনে সমুদ্র স্রোতের ঘর্ষণজনিত কারণে খানিকটা মার্বেলের আকার নেয়। যা এখন দর্শনার্থীদের চোখে বিস্ময় হিসেবে ধরা দিয়েছে।
অনেক পর্যটকরা এই গ্লাস বিচ পরিদর্শনে এসে রঙিন গ্লাসের টুকরো শখের বসে সাথে নিয়ে যায়। ফলে দিনকে দিন এই কাচ টুকরোর পরিমাণ কমছে। এখন অবশ্য আইন করে নিষেধ করা হয়েছে যাতে কোনো পর্যটক সাথে করে কাচের টুকরো না নিয়ে যায়।
পুনালুউ ব্ল্যাক স্যান্ড বিচ, হাওয়াই
বিগ আইল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব কাউ উপকূলে অবস্থিত এই পুনালুউ ব্ল্যাক স্যান্ড বিচ। হাওয়াইয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত কালো বালির সৈকতগুলির মধ্যে এটি একটি। অবিশ্বাস্য রকমের কালো বালির এই সমুদ্র সৈকত দেখতে যেন সাদা-কালো ফিল্মের নেগেটিভ।
প্রাকৃতিকভাবে অদ্ভুত এই সৃষ্টির মূলে রয়েছে বেসল্ট। মূলত লাভা গড়িয়ে পরার সময় তা ঠান্ডা হয়ে পরবর্তীতে কালো বালির রূপ নেয়। যা আসলে এক প্রকার আগ্নেয়শিলা। নারিকেল গাছের সারি, বিরল প্রকৃতির সবুজ কচ্ছপ সবকিছুর মিশেল যেন ভ্রমণ পিপাসুদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখে সারাক্ষণ।
হায়াম বিচ, অস্ট্রেলিয়া
পৃথিবীতে সাদা বালির বিচ প্রায়শই খুঁজে পাওয়া গেলেও হায়াম বিচের সাদা বালির মতোন সাদা আর একটিও নেই। এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্যই সৈকতটি গিনেস বুকে নিজের স্থান করে নিয়েছে। সিডনি থেকে প্রায় ২.৫ ঘন্টা ড্রাইভ করে নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে জার্ভিস বে-এর দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত এই সৈকত। সবুজ ঘেরা বন নিমিষেই যে কারো মন ভালো করে দিতে সক্ষম।
তবে বালিগুলি অতিরিক্ত সাদা হওয়ার কারণ, বালিগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম কোয়ার্টজ কণা দ্বারা গঠিত। এতই বেশি সাদা যার কারণে আপনাকে সূর্যের প্রতিফলন থেকে চোখকে রক্ষা করতে সানগ্লাসও পরতে হতে পারে।
রেড স্যান্ড বিচ, কানাডা
পূর্ব কানাডার সামুদ্রিক প্রদেশগুলির মধ্যে একটি প্রিন্স এডওয়ার্ড দ্বীপ। এই সৈকতের বালিতে অত্যধিক পরিমান লোহার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। যখন লোহা অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে, তখন এটি আয়রন অক্সাইড গঠন করে–যা মরিচা নামেও পরিচিত।
যার ফলে লাল বালি পুরো দ্বীপ জুড়ে দেখতে পাওয়া যায় এবং বিশেষ অন্য একটি কারণ হলো দ্বীপটি পাললিক লাল বেলেপাথর থেকে গঠিত। অসম্ভব সুন্দর লাল আভাযুক্ত এই সমুদ্র সৈকতে, স্যাম্পেইন-এর লাল বর্ণ থেকে গোলাপি রঙের বিভিন্ন বর্ণচ্ছটা দেখতে পাওয়া যায়।
ভিক বিচ, আইসল্যান্ড
কাতলা আগ্নেয়গিরির নিকটে দক্ষিণ আইসল্যান্ডের ভিক গ্রামে পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত কালো বালির সৈকতগুলির একটি ভিক বিচ অবস্থিত। পাশেই থাকা উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরির লাভা প্রায়শই নেমে আসার সময় বাতাসের স্পর্শে ঠান্ডা হওয়ার ফলেই কালো বর্ণ ধারণ করে।
কালো রঙ এত সুন্দর হয়ে প্রকৃতিতে স্থান করে নিয়েছে তা একমাত্র এই বিচে আসলেই বোঝা যায়। কালো বালি, সমুদ্রের উদ্দাম জলরাশি আর পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত জায়গাটা যেন ভিন্ন রকমের এক স্বর্গ!
রেইনবো বিচ, অস্ট্রেলিয়া
পেনিনসুলার গোড়ায় অবস্থিত একটি ছোট্ট শহর ব্রিসবেন থেকে সানশাইন কোস্টের উত্তরে তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিলেই দেখা মেলে প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম এই সমুদ্র সৈকতটির। যার বালিতে দেখা মেলা ৭৪ রকমের রঙের মেলা! মূলত আয়রন অক্সাইড এর সাথে বালি আর জলের গোপন এক মিশ্রনের বিক্রিয়ার ফলেই এই রঙ-এর সৃষ্টি। ধারণা করা হয়, এই পরিবর্তন শুরু হয়েছে, মানব ইতিহাসের শেষ বরফযুগের পর থেকে।
এই সৈকত নিয়ে রয়েছে প্রাচীন উপকথা। পেনিনসুলার লোকেরা বিশ্বাস করতো, একবার রেইনবো স্পিরিট আর সুন্দরী এক রমণীর মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তবে হেরে যায় রেইনবো স্পিরিট। তারই ফলশ্রুতিতে বিশাল এই সমুদ্র সৈকতের পর্বতগাত্রে লুটিয়ে পড়ে রেইনবো স্পিরিট। সেই থেকেই রংধনুর সাত রঙ ঐশ্বর্য্যমন্ডিত করে এই বেলাভূমিকে। অদ্ভুত সুন্দর উজ্জ্বল রঙগুলির দেখা পাওয়া যায় ভাটার সময়। দক্ষিণে সমুদ্র সৈকত বরাবর সার্ফ ক্লাব থেকে কমপক্ষে এক-চতুর্থ মাইল ধরে চোখে পড়ে এই রঙের খেলা।
মুরিওয়াই ব্ল্যাক স্যান্ড বিচ, নিউজিল্যান্ড
আগ্নেয়গিরির কালো বালির ফলে সৃষ্ট এই অত্যাশ্চর্য প্রসারিত অংশটি অকল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত ঝকঝকে কালো বালি সাথে নির্মল বাতাসে পরিপূর্ণ সৈকতটি ৩৭ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। এর অদ্ভুত সুন্দর রঙ টাইটানিয়াম, লোহা এবং অন্যান্য আগ্নেয় পদার্থের একটি সংখ্যক মিশ্রণের ফলে সৃষ্ট হয়েছে।
সমুদ্র সৈকত সার্ফিং, মাছ ধরা এবং পাখি দেখার জন্য বেশ জনপ্রিয় এই সমুদ্র সৈকত। এছাড়া আশেপাশের দ্বীপগুলি নীল পেঙ্গুইন এবং পশম সীলের আবাসস্থল প্রাকৃতিক বৈচিত্র বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণে।
রামলা বে বিচ, মাল্টা
রামলা বে বিচ অবস্থিত মাল্টার গোজো দ্বীপে। কমলা বালির জন্য বিখ্যাত এই সমুদ্র সৈকত গোজোর অন্যান্য সৈকতের পাশাপাশি সমগ্র জাতিকে থেকে আলাদা করে তুলেছে সবার থেকে।
স্থানীয়দের কাছে ‘রামলা ইল-হামরা’ সৈকত নামেও পরিচিত। যার অর্থ রেড স্যান্ডি বিচ, রক্তিমাভাব এই কমলা আভা সত্যিই প্রাণবন্ত করে যেকোনো মানব হৃদয়কে। শুধুমাত্র ব্যতিক্রমী রং নয়, ঐতিহাসিক গুরুত্বও রয়েছে যথেষ্ট এই দ্বীপের।
কাইহালুলু বিচ, হাওয়াই
গুহা গাত্রের অদ্ভুত সুন্দর লাল, নীল জলরাশি আর পাহাড়ের কালো আগ্নেয় শিলা তিন রঙের এই মিশেল প্রকৃতিতে পাওয়া বেশ দুষ্কর। বিরল এই শোভা দেখা মিলবে হাওয়াই দ্বীপের কাইহালুলু বিচে। অর্ধচন্দ্রাকার আকৃতির এই পর্বত গুহা, প্রকৃতির নিয়মেই নিজ অবস্থানে অটল। অথচ দেখলেই মনে হবে যেন এখনই ভেঙ্গে পড়বে উপরের দিকে উঠে যাওয়া পর্বতের শৃঙ্গগুলো।
শহুরে ব্যস্ততা থেকে বহু দূরে, নিয়নবাতিতে পেছনে ফেলে প্রকৃতির এই শোভা যেনো জীবনবোধকে নিমিষেই পালটে দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
Feature Image: Author References: 01. Most Colorful Beaches for your world travel bucket list. 02. 17 of the worlds most incredibly colorful beaches. 03. The most colourful beaches in the world.