পৃথিবীর বিধ্বংসী যত ঘূর্ণিঝড়

590
0

প্রাকৃতিক দূর্যোগের ভেতর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে ভূমিকম্প এবং ঘূর্ণিঝড়। স্থানভেদে একে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সাইক্লোন, চীনে টাইফুন এবং যুক্তরাষ্ট্রে হ্যারিকেন নামে পরিচিত। এই পৃথিবী অনেকবারই এই বিধ্বংসী ঝড়ের কবলে পড়েছে। হয়েছে ব্যাপক প্রাণহানি এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি। সাধারণত সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাগুলো এই ভয়াবহ ঝড়ের কবলে পড়ে এবং পৃথিবী বছরে প্রায় ৮০টি ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা করে। আরব সাগরের তুলনায় ভারত মহাসাগরই ঘূর্ণিঝড় কবলিত হয় বেশি।

ঘূর্ণিঝড় সাধারণত নিম্নচাপের কারণে সৃষ্টি হয়। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা এবং তাণ্ডব সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তা জলীয়বাষ্পে রূপ নিতে থাকে। সমুদ্রের নিম্নচাপের ফলে চর্তুদিকের ভারী বাতাস প্রচণ্ড বেগে অগ্রসর হয়। তখন পৃথিবী অক্ষ বরাবর ঘূর্ণন গতির প্রভাবে উষ্ণ বায়ু পাক খেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। এই সময় বেশি ঘনত্বের জলীয়বাষ্প ও কম তাপমাত্রার বায়ু ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। এর ফলে জলীয়বাষ্পের সুপ্ততাপ কমে সমুদ্রপৃষ্ঠকে আরও উত্তপ্ত করে ফেলে। চাপ ও তাপের এই হঠাৎ তারতম্যের ফলে নিম্নচাপ কেন্দ্রীভূত হয় এবং চারপাশের বায়ু প্রবলবেগে এই কেন্দ্রের দিকে চক্রাকারে ধাবিত হয়। এই অবস্থাকেই ঘূর্ণিঝড় বলে।

ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রস্থলের গোলাকার অঞ্চলকে ‘ঘূর্ণিঝড়ের চোখ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই অঞ্চলের বায়ু তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকে। তবে এর চারদিকে অশান্ত এবং উত্তাল বায়ুপ্রবাহ লক্ষ করা যায়। ঘূর্ণিঝড়ের কোনদিকের বায়ু অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী হবে তা নির্ভর করে এটি কোন দিকে ধাবিত হবে তার উপর। যদি এটি পশ্চিম উপকূলে ধাবিত হয় তবে ডান দিকের বায়ু এবং পূর্ব উপকূলে ধাবিত হলে বাম দিকের বায়ু শক্তিশালী হয়। ঘূর্ণিঝড়ের সময় সমুদ্রপৃষ্ঠের পানি আকস্মিকভাবে ফুলে ফেঁপে উঠলে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। ফলে বহু প্রাণহানি হয়।

ঘূর্ণিঝড়ের চোখ। Image Source: livescience.com

ভোলা সাইক্লোন, বাংলাদেশ, ১৯৭০ 

এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে বহু প্রাণাঘাতী ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছে। এদের মধ্যে ভয়াবহতার দিক থেকে সব থেকে এগিয়ে রাখা যায় ১৯৭০ সালে সংঘটিত ‘ভোলা সাইক্লোন’-কে। এছাড়া মিয়ানমার, চীন, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রও বহু ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করেছে। সেরকম কিছু ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হলো-নার্গিস, নীনা, জেবি, ইরমা। অগণিত মৃত্যু, অবকাঠামো ধ্বংস, মহামারি, দুর্ভিক্ষ কাটিয়ে জনজীবনে স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পেতে বহু সময় এবং অর্থ ব্যয় হয়েছে। সেই সাথে প্রিয়জন হারানোর দুর্দমনীয় যন্ত্রণা তো রয়েছেই!

বঙ্গদেশের সবচেয়ে আলোচিত ঘূর্ণিঝড় ছিল ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বরের ‘ভোলা সাইক্লোন’। এর ভয়াবহতা স্মরণ করে আজও প্রত্যক্ষদর্শীরা শিউরে ওঠে। সেই সময় চরাঞ্চলে রেডিও সহজলভ্য ছিল না। ফলে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত ঘোষণা করা হলেও তা জনসাধারণের কাছে সেভাবে পৌঁছায়নি।

এই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৪০-২০৫ কিলোমিটার। ১০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে হাজার হাজার মানুষ ও গবাদিপশু। প্রায় ৫,০০,০০০ লোকের প্রাণ নেয়। যার মধ্যে জেলেই ছিল ১,০০,০০০। এত বিপুল পরিমাণ প্রাণহানির মাত্রা জানলে এখনও চমকে ওঠে লোকে। তৎকালীন হিসেব অনুযায়ী ৮ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের সম্পদের ক্ষতিসাধন হয়।

ভোলা সাইক্লোনের তাণ্ডব। Image Source: getbengal.com

নীনা টাইফুন, চীন, ১৯৭৫ 

টাইফুন নীনা ১৯৭৫ সালে আঘাত হানে চীনে। পূর্ব ফিলিপাইন ও দক্ষিণ হেনান প্রদেশের উপর দিয়ে এই ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। ফিলিপাইনে এটি ‘বেবেং’ নামে পরিচিত।

এই ঝড়ের সময় টানা তিনদিন ভারী বর্ষণ হয়। প্রায় ১০৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ভারী বৃষ্টিপাত আর ঝড়ো বাতাসে জনবসতি লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ২ লক্ষ ৩১ হাজার লোকের প্রাণ কেড়ে নেয় এই ভয়াবহ টাইফুন। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ। ১০ লক্ষ লোক গৃহহীন হয়ে পড়ে।

এই ঝড় এতটাই আগ্রাসী ছিল যে ঝড় পরবর্তী দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে আরো একলক্ষ লোকের প্রাণ কেড়ে নেয়। তবে বর্তমানে চীনের উন্নত দূর্যোগ মোকাবিলা ব্যবস্থার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।

টাইফুন নীনার পরবর্তী চিত্র। Image Source: thatsmags.com

সাইক্লোন নার্গিস, মিয়ানমার, ২০০৮ 

২০০৮ সালে ৩ মে মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানা ‘নার্গিস’ ছিল আরেকটি বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়। এটি ময়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যায়। এটি ছিল ক্যাটাগরি চার মাত্রার সাইক্লোন।

বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ২১০ কিলোমিটার। এতে প্রাণহানি হয়েছিল ১ লক্ষ ৪০ হাজার লোকের। গৃহহীন হয়েছিল প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ। নিখোঁজ হয় প্রায় ৫৪,০০০ মানুষ।

সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশ হওয়ায় মিয়ানমার মৎস্য এবং মাৎস্য সম্পদের উপর নির্ভরশীল। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বিপুল পরিমাণ মাৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়।

ঘূর্ণিঝড় নার্গিসের ভয়াবহতা। Image Source: flicker.com

হ্যারিকেন ইরমা, যুক্তরাষ্ট্র, ২০১৭ 

আটলান্টিক বেসিনের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী হ্যারিকেন ইরমা। এটির উৎপত্তি হয় ২০১৭ সালের আগস্টের ৩১ তারিখ এবং শেষ হয় সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ। পূর্ব থেকে পশ্চিমে এটি ৬৫০ মাইল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। আক্রান্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রের ৯টি অঙ্গরাজ্য।

৬ সেপ্টেম্বর এটি ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে আঘাত হানে। হ্যারিকেনের ‘চোখ’ বারবুডা দ্বীপ অতিক্রম করে। ফলে সেখানকার ৯৫% স্থাপনা ধ্বংসযজ্ঞের মুখে পড়ে।

১০ সেপ্টেম্বর ইরমা আঘাত হানে ফ্লোরিডায়। এর গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ৩০০ কিলোমিটার। ফ্লোরিডার বিশাল এলাকা তলিয়ে যায়। প্রাণহানি হয় ২৮ জনের। চার লক্ষ বাড়িতে স্থায়ী বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা যায়।

হ্যারিকেন ইরমার ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি। Image Source: CBS News

টাইফুন জেবি, জাপান, ২০১৮

জাপান এমনিতেই ভূমিকম্প এবং ঘূর্ণিঝড়প্রবণ দেশ। ২০১৮ সালে জাপানের পশ্চিম উপকূলে সংঘটিত হয় দুই যুগের মধ্যে সবচেয়ে বড় টাইফুন জেবি। এর গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ২১৬ কিলোমিটার। এতে প্রাণ হারায় ১০ জন। আহত হয় ৩০০ জন।

পশ্চিমাঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। বন্যা এবং ভূমিধ্বস নামে। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলে ঝড়ো বাতাসের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি এবং বজ্রপাত ও জলোচ্ছ্বাস দেখা দেয়। লোকজনের নিচু এলাকা থেকে সরে পশ্চিম বন্দরে কোবে শহরের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিতে বলা হয়।

টাইফুন জেবির ধ্বংসযজ্ঞ। Image Source: wunderground.com

ঘূর্ণিঝড়কে ঠোকানোর মত প্রযুক্তি পৃথিবীর কাছে নেই। তবে দূর্যোগপূর্ব যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর নানা দেশে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। তাদের সাথে স্বেচ্ছাসেবীরাও সাধ্যমতো শ্রম দিয়ে যাচ্ছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা পূর্বের তুলনায় উন্নত হওয়ায় তাৎক্ষণিক সাড়া দান সম্ভব হচ্ছে। ফলে প্রাণহানির পরিমাণও কমে আসছে। এ থেকেই বোঝা যায় তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে এর ইতিবাচক দিকে কাজে লাগিয়ে চাইলেই এই ভয়াবহ দূর্যোগ মোকাবিলা সম্ভব।

 

Feature Image: dw.com 
Reference:

01. Hurricane Science. 
02. 10 Worst Cyclones in The World.  
03. The Speediest and Deadliest Cyclones in The World.