মামলুক সাম্রাজ্য: ক্রীতদাস থেকে শাসক হয়ে উঠার ইতিহাস

456
0

ক্রীতদাস থেকে এক সময় তারা হয়ে উঠলেন শাসক৷ প্রায় ২৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শাসন করেছেন, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজেদের সালতানাত৷ ধারণা করতে পারেন কাদের নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি? অবশ্য ইতিমধ্যেই শিরোনাম দেখে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছেন। হ্যাঁ, মামলুক সাম্রাজ্য নিয়েই আজকের আলোচনাপর্ব। যে সাম্রাজ্যের লোকেরা ইতিহাসের পাতায় ক্রীতদাস থেকে শাসক হওয়ার মতো অবিস্মরণীয় কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন।

মামলুক কারা? 

মামলুক শব্দের উৎপত্তি আরবি ভাষা থেকে, যার অর্থ ক্রীতদাস৷ শব্দটি দিয়ে মূলত রাজার অধীন অর্থাৎ দাসদের বুঝানো হয়৷ তখন আরবসহ গোটা বিশ্বেই দাসপ্রথার প্রচলন ছিল৷ প্রাচীন মিশরে পরাজিত যুদ্ধবন্দীদেরকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রয় করা হতো, সামর্থ্যবানরা ক্রীতদাস কিনে রাখতেন৷ মামলুকরা ছিলেন সেরকমই ক্রীতদাস৷ তবে অন্যান্য ক্রীতদাসদের চেয়ে মামলুকদের অবস্থান ছিল বেশ উন্নত৷ কেননা, মামলুকদের বেশিরভাগই ছিল তুর্কি বংশোদ্ভুত৷

শত শত বছর ধরে আরবের শাসকরা ককেশাস ও মধ্য এশিয়া থেকে দাস সংগ্রহ করতো৷ তাই একদম সঠিকভাবে মামলুকদের উৎপত্তি নির্ণয় করা বেশ কঠিন৷ যদিও তারা মিশ্র জাতিগোষ্ঠীর লোক তবে তাদের অধিকাংশই তুর্কি (মূলত কিপচাক ও কামেন) অথবা ককেশাস (সার্কাশিয়ান, আর্মেনিয়াম অথবা জর্জিয়ান) বংশোদ্ভুত৷

প্রচুর সংখ্যক মামলুক দাস সংগ্রহের কারন হলো মামলুকরা আরবদের মতো স্বজনপ্রীতি দেখায় না; আবার অন্যদিকে পার্সিয়ানদের মতো ক্ষমতা ও অর্থলোভীও না৷ যোদ্ধা হিসেবে তাদের খ্যাতি ছিল জগৎজোড়া৷ মামলুকরা অশ্বচালনা ও তীরনিক্ষেপে পারদর্শী ছিলেন, যা তাদের মুসলিম মনিবদের নজর এড়ায়নি৷

মামলুকরা অশ্বচালনা ও তীরনিক্ষেপে পারদর্শী ছিলেন। Image Source: weaponsandwarfare.com

তাদেরকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দেয়া হতো এবং সবাইকেই কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হতো৷ নবম শতকের দিকে বাগদাদে আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে আরব আর্মিতে মামলুকদের নেওয়া হতো৷ এই ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেই ফাতেমীয় ও আয়ূবীয় খলিফারাও ক্রীতদাস ক্রয় করে সেনাবাহিনীতে ঢুকাতেন৷ 

আব্বাসীয় খলিফা মুসতাসিম বিল্লাহর সময়ে মামলুকদের তিনি সামরিক ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং আরব ও পারসিকদের বদলে মামলুকদের প্রাধান্য দেন৷ তিনিই প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে মামলুকদের প্রতিষ্ঠা দেন৷ মামলুক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সুলতান নাজিমুদ্দিন আইবেকের নাম অগ্রগণ্য৷ 

খলিফা আল মুসতাসিম-এর শাসনামল শেষ হলে ক্ষমতা চলে যায় তুর্কি মামলুক জেনারেলদের হাতে৷ এর আগে খলিফার শাসনামলেও তারা সামরিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে প্রবল ক্ষমতাশালী ছিলেন৷ তাদের এতই সক্ষমতা ছিল যে তারা যেকোনো সময় খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত বা কতল করার অধিকারও রাখতো৷ 

এভাবে ১৩ শতকের দিকে মামলুকরা নিজেদের সালতানাত প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়; যা পরে মিশর ও ভারতেও বিস্তৃত হয়েছিল৷ একসময় যারা কয়েক পুরুষ ধরে এখানকার দাস ছিল তারাই শাসক বনে গেল৷ 

তের শতকের মামলুকদের মানচিত্র। Image Source: worldhistoryencyclopedia.org

এই সালতানাতকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়৷ বাহরি মামলুক ও বুরজি মামলুক৷ বাহরি সুলতানরা প্রথম পর্যায়ে শাসন করেন, তারা ছিলেন তুর্কি মামলুক৷ তাদের শাসনকাল ছিল ১২৫০ থেকে ১৩৮১ সাল পর্যন্ত৷ অন্যদিকে বুরজি সুলতানরা ছিলেন মূলত ককেশীয় মামলুক৷ মামলুক সাম্রাজ্য মূলত সালতানাতের প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ বাহরি শাসকদের যুগে সফলতার উচ্চশিখরে আরোহণ করেছিল৷ 

বাহরি মামলুক 

বাহরি শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ বাহর থেকে যার অর্থ নদী৷ এটি বাহরিদের উৎপত্তিস্থল মিশরের নীল নদের তীরে অবস্থিত দুর্গকে নির্দেশ করে৷ আল জাহির বাইবার্স ছিলেন বাহরি যুগের প্রথম শাসক৷ 

বুরজি মামলুক

মামলুক সম্প্রদায়ের হলেও এদের উৎপত্তি বাহরিদের থেকে ভিন্ন৷ ১৩৮২ থেকে ১৫৮৭ সাল পর্যন্ত মামলুক সালতানাতের দ্বিতীয় যুগে বুরজিরা রাজ্য শাসন করে৷ বুরজি শব্দটি মূলত আরবি শব্দ বুর্জ থেকে এসেছে; যার অর্থ টাওয়ার বা মিনার৷ সাইফ আদ দীন বারকুক ছিলেন বুরজিদের প্রথম শাসক৷ 

বাহরি শাসনামলে মোট ২৪ জন ও বুরজি শাসনামলে মোট ২৩ জন শাসক রাজত্ব করেন৷ মোট ৪৭ জন মামলুক শাসকের মধ্যে রুকন আদ দীন বাইবার্স, সাইফ আদ দীন কুতুজ, সাইফ আদ দীন কালাউন, সাইফ আদ দীন, আল মুসতাসিম বিল্লাহ, নুর উদ দীন আলির নাম উল্লেখযোগ্য৷  

মামলুক সুলতান সাইফ আদ দীনের আবক্ষ ভাষ্কর্য। Image Source: wikiwanda.com

মামলুকদের শিল্প, স্থাপনা ও বাণিজ্য

বাহরি যুগ পুরো মামলুক সাম্রাজ্যের শিল্প ও সাহিত্যকে প্রতিনিধিত্ব করে৷ শিল্প, সাহিত্য, স্থাপনা কিংবা বাণিজ্যে মামলুক সাম্রাজ্যের অভুতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয় বাহরি শাসকদের আমলে৷ পূর্ব পশ্চিমের সিল্ক ও হরেক রকম মশলা বাণিজ্য উন্নতিতে ছিল মামলুক সুলতানদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা৷  

কিছু অন্তর্দ্বন্দ্ব বাদে অসাধারণ সব শৈল্পিক ও স্থাপত্য কর্ম, প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে আয়ুবীয় শাসকদের আমলে ও ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে মিশরে বসবাস করা গুণীদের দ্বারা৷ পূর্ব-পশ্চিম থেকে আসা উদ্বাস্তুরাও ভূমিকা রেখেছিল মামলুকদের শিল্প ও স্থাপত্যের বিকাশে৷ 

মামলুকদের ডেকোরেটিভ আর্ট, বিশেষ করে অ্যানামেলড ও গিল্ডেড গ্লাস, বিভিন্ন ধরনের ধাতব ও কাঠের সামগ্রী, এবং বস্ত্রশিল্প শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয় গোটা ইউরোপে সমাদৃত ছিল৷ ভেনেশিয়ান গ্লাসওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে মামলুকদের ছিল একচেটিয়া প্রভাব৷  

বাহরি শাসক বাইবার্স ও কালাউনের সময়কালে বিভিন্ন স্বায়ত্ত্বশাসিত ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠে৷ যার মধ্যে ছিল মাদ্রাসা, মসজিদ, মিনার মাজার ও হাসপাতাল৷ এছাড়াও বাহরি শাসক আল নাসির মুহাম্মদসহ আরো কয়েকজন অসাধারণ সুলতান তাদের শাসনামলে অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী সমৃদ্ধ কিছু স্থাপনা নির্মান করেন৷  

মামলুকদের নির্মিত স্থাপত্যশৈলী। Image Source: Shutterstock / Bildagentur Zoonar

বুরজি সুলতানরাও তাদের পূর্বসুরী বাহরি সুলতানদের অনুসারী হয়ে শিল্প ও স্থাপত্যে অসামান্য অবদান রেখেছেন৷ যদিও পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মিশর অনেক রকম বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন ঝামেলাতে পড়েছিল৷  

একদিকে দুর্ভিক্ষ, প্লেগ মহামারি আর সেনাবাহিনীর মধ্যে কলহ অন্যদিকে পূর্ব-মধ্য অঞ্চলগুলো এশীয় যোদ্ধা তৈমুরের দ্বারা ধংস হয়ে যাওয়া৷ এর মাঝেও বুরজি শাসকরা শিল্প ও স্থাপত্যে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন৷ মামলুকদের বস্ত্রশিল্প ও কার্পেট আন্তর্জাতিক বাজারে সুনাম অর্জন করেছিল৷ সুলতান বারকুক, ফারাজ, মুয়াদ শেখ ও বার্সবে অনেক স্বায়ত্ত্বশাসিত ও ধর্মীয় স্থাপনা নির্মান করেছেন তাদের শাসনামলে৷  

পূর্ব-মধ্য অঞ্চলগুলোতে বিলাসবহুল সামগ্রী এবং ইরান ও ইউরোপের মধ্যে বস্ত্র বাণিজ্য মামলুকদের অর্থনীতিকে খারাপ সময় কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল৷ সেই সময়ে মিশর থেকে হাজীদের মক্কা-মদিনা সফরের জন্য রুট চালু করা হয়৷ খান-আল-কাদির মতো বড় ওয়্যারহাউজ তৈরী হয় ১৪৪১ সালে৷ 

আলেপ্পোতে তৈরী হয় বিখ্যাত মসজিদ আল-বুঘা আল-উতরুশ, দামেস্কাসে ১৪৬৪ সালে সাবুন, ১৪২১ সালে মাদ্রাসা-ই-জাকমাকিয়া প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মামলুক শাসকরা একদিকে যেমন তাদের স্থাপত্য শিল্প ও শিক্ষাব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করেছেন, অন্যদিকে তাদের নামও ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছে৷  

পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে সুলতান কাইতবে শিল্পে অনেক অবদান রাখেন৷ তার শাসনামলে কায়রোর শহরগুলোতে বাণিজ্যিক ভবন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সেতু তৈরী হয়৷ 

যুদ্ধে আক্রমণরত মামলুকদের চিত্রকর্ম। Image Source: Felicien de Myrbac Rheinfeld

১৫১৭ সালের দিকে মামলুক সাম্রাজ্য অটোমানদের অধীনে চলে যায়৷ এই অটোমানদের বংশধররাই বর্তমানে তুর্কি নামে পরিচিত৷ মামলুকদের শিল্প সাহিত্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অটোমান ও অন্যান্য ইসলামী সালতানাতগুলো শিল্প ও স্থাপত্যকর্মে মনোযোগী হয়৷  

এভাবেই একসময়কার ক্রীতদাস থেকে নিজেদের সালতানাত প্রতিষ্ঠা করা মামলুকদের শাসনামলের পতন হয়৷ অসাধারণ বীরত্ব, যুদ্ধাস্ত্রে দক্ষতার জন্য আজও তারা ইতিহাসের পাতায় হয়ে আছেন স্মরণীয়৷ 

 

Feature Image: bahath.co 
References:

01. Who Were the Mamluks? 
02. The Art of the Mamluk Period. 
03. Mamluk. 
04. Mamluk Dynasty:History & Rulers.