Beloved Husband of Pat
Lest We Forget
উপরের অশ্রুঝরা শব্দগুলো রয়াল অস্ট্রেলিয়ান এয়ারফোর্সের ফ্লাইং অফিসার এন এফ ডি সিম্পসনের জন্য তার প্রিয়তমা স্ত্রী তারই এপিটাফে লিখেছিল। সিম্পসন মারা যায় ১৯৪৩ সালের ২১শে মে। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৪। প্রেয়সীর বাহুতে যে সময় কাটানোর কথা, সেই সময়ে সিম্পসন শায়িত হয়েছে চির অজানার তরে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে, মানব সভ্যতার ইতিহাস দ্বন্দ্ব আর যুদ্ধের ক্ষয়ে পিষ্ট। আর এই যাবৎকালের সবচেয়ে বৃহৎ আর ভয়াবহ আকারের যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা মহাযুদ্ধ শিরোনামে। এই যুদ্ধের খলনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল একনায়ক অ্যাডলফ হিটলার।
ঘটনার সূত্রপাত ১৯৩৯ সালের ২৩শে আগস্ট। সেদিন অ্যাডলফ হিটলারের জার্মানি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের জোসেফ স্তালিনের মধ্যে একটি চুক্তি বিশ্বব্যাপি আলোড়নের ঝড় তুলে। এমনকি, নাৎসি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সেই চুক্তির ফলে ইউরোপের অন্য দেশগুলো বিস্মিত হয়ে যায়। মতাদর্শে দুপক্ষ ছিল পৃথিবীতে বাইপোলার।
এই চুক্তির মূল বিষয় ছিল একে অপরকে আক্রমণ করবে না। এরপরে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জার্মানি ভাগাভাগি করে পোল্যান্ড দখল করে নেয়। মূলত চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব-ইউরোপকে দুই ভাগে বিভক্ত করা। একটি অংশে ছিল জার্মানির প্রভাব, অন্য অংশে তৈরি হয় রাশিয়ার প্রভাব।
জার্মানির সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের চুক্তি ফলে ইউরোপে হিটলারের আধিপত্যবাদী মনোভাব আরো ব্যাপক আকার ধারণ করে। চুক্তির এক সপ্তাহের মাথায় অর্থাৎ ১৯৩৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর অ্যাডলফ হিটলারের জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে। সূচনা হয় মহাযুদ্ধের। এই তাণ্ডবলীলা পুরো পৃথিবীতে আলোড়িত করে তোলে।
সমস্ত পৃথিবী জড়িয়ে যায় অক্ষশক্তি আর মিত্রশক্তির বেড়াজালে। এই যুদ্ধ কেড়ে নেয় অজস্র প্রাণ। পৃথিবীর প্রতিটি আনাচে-কানাচেতে ছড়িয়ে পড়ে মৃত লাশের পাহাড়। এসব স্মৃতিকে একত্রিত করে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গড়ে উঠে কিছু স্মৃতিসৌধ। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থিত ওয়ার সিমেট্রি তেমনই এক নির্দশন নিয়ে জ্বলজ্বল করছে যুদ্ধের স্মৃতির পাহাড় হয়ে।
প্রকৃতপক্ষে, ‘কমনওয়েলথ ওয়ার সিমেট্রি’ যেটি বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি নামে পরিচিত। এটি (সিডব্লিউজিসি) কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশনের সৌধ। চট্টগ্রামের ওয়েল পার্ক রেসিডেন্স থেকে খুব কাছেই ১৯ নং বাদশা মিয়া সড়কের চট্টগ্রামের দামপাড়া এলাকায় এই সৌধ অবস্থিত।
চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হতে প্রায় ২২ কিমি উত্তরে এবং মূল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৮ কিমি দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি। স্থানীয় জনগণের ভাষ্যমতে, এই এলাকাটি পূর্বে বিশাল ধানক্ষেত ছিল। যদিও নগরায়ণের প্রভাবে বর্তমানে বেশ উন্নত এবং শহরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে জায়গাটি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তিম স্মৃতি ধারণ করে আছে এই সৌধটি। সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্প এবং ব্রিটিশ জেনারেল হাসপাতালের কাছেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এটি তৈরি। সূচনালগ্নে এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈন্যদের প্রায় ৪০০টি কবর ছিল।
তবে বর্তমান সূত্রমতে, এখানে ৭৩১টি কবর বিদ্যমান যেখানে ১৭টিরও বেশি সৌধ অজানা ব্যক্তির। এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত বিদেশী সৈন্যদের প্রায় ২০টি কবর রয়েছে৷ যার মধ্যে একজন ডাচ এবং উনিশজন জাপানিজ রয়েছে।
এছাড়া এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিতে চট্টগ্রাম-বোম্বের একটি স্মারক বিদ্যামান। যেটি ভারত-বাংলাদেশের নিরুঙ্কুশ ভ্রাতৃত্ববোধের স্মৃতি প্রদর্শন করে। ইন্ডিয়ান রয়্যাল নেভি ও ইন্ডিয়ান মার্চেন্ট নেভির প্রায় ৬ হাজার ৫০০ সদস্যের স্মরণে ‘চিটাগং/বোম্বে ১৯৩৯-১৯৪৫ ওয়ার মেমোরিয়ালস’ নামের দুটি রেজিস্টারের অন্য কপিটি ভারতের মুম্বাইয়ে অবস্থিত। যেটি ইন্ডিয়ান সিম্যান হোমে সুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।
আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন দেশ হতে সশস্ত্র বাহিনীর ৭৫৫ জন নিহত সদস্য চট্রগ্রামের এই সমাধিক্ষেত্রে শায়িত আছেন। সৈনিকদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাজ্যের ৩৭৮ জন, কানাডার ২৫ জন, অস্ট্রেলিয়ার ৯ জন, নিউজিল্যান্ডের ২ জন, অবিভক্ত ভারতের ২১৪ জন, পূর্ব আফ্রিকার ১১ জন, পশ্চিম আফ্রিকার ৯০ জন, মিয়ানমারের ২ জন, নেদারল্যান্ডসের ১ জন, জাপানের ১৯ জন এবং ৪ জন বেসামরিক।
সিমেট্রিটির সম্পূর্ণ দায়িত্ব কমনওয়েলথ গ্রেভ কমিশনের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ ফোর্সের প্রায় ১৭ লাখ নিহত সদস্যের স্মৃতি ধরে আছে এই স্থান। বাংলাদেশের মধ্যে চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা আর কুমিল্লাতে সিডব্লিউজিসির তত্ত্বাবধানে সৌধ দুটি রয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয় সিডব্লিউজিসির তত্ত্বাবধানে ১৫০টি দেশে প্রায় ২৩ হাজার স্থানে সমাধি ও স্মৃতিসৌধ রয়েছে। এই কমিশনটি নিহত প্রতিটি সদস্যের অনলাইন ভিত্তিক তথ্য সংরক্ষণ করে।
স্যার ফেবিয়ান ওয়্যার নামে ব্রিটিশ রেড ক্রসের এক কর্মকর্তার নিরলস প্রচেষ্টার ফলন এই কমিশন। বাংলাদেশে তিনটি সমাধি যথাক্রমে কুমিল্লার ময়নামতি, চট্টগ্রামের দামপাড়া ও নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে অবস্থিত। ব্রিটিশ রাজ পরিবার ২০১৭ সালে এসে নিজেদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনও রেখে যায় স্মৃতিফলকে।
বাদশা মিয়া রোডের ঠিক ফিনলে গেস্ট হাউজের প্রাচীর ঘেঁষে সিমেট্রির অবস্থান। ৩-৪ মিনিট হেঁটে গ্রিলঘেরা সবুজ চত্বর অতিক্রম করে সমাধিস্থলের মূল গেইট। প্রবেশ পথের পাশে রয়েছে দিক-নির্দেশনা সম্মিলিত বোর্ড। যাতে পরিষ্কার করে করণীয় ও বর্জনীয় কার্যাবলির তালিকা দেয়া আছে।
সবাইকে প্রতিক্ষণে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় সমাধিক্ষেত্রের পবিত্রতা রক্ষা করতে। সবার জন্য উম্মুক্ত সৌধটি সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা এবং দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য খোলা থাকে।
এখানে চন্দ্রঘোনা, চিরিঙ্গা, দোহাজারী, কক্সবাজার, যশোর, খুলনা, ঢাকা এমনকি আসাম থেকেও সমাধি স্থানান্তরিত হয়। ইউনিট আর পদবির ব্যবধান ঘুচিয়ে একই আকার ও আকৃতির সমাধিফলকে খোদাই রয়েছে প্রত্যেকের নাম, রেজিমেন্ট আর দেশের নাম।
কিছু ফলকে শোভা পাচ্ছে প্রেয়সীর ভালবাসার শব্দ অথবা পরিবারের করুণ হাহাকার। এছাড়াও, কিছু কিছু সমাধিফলকে নিহত সদস্যের পরিবারের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে পবিত্র কোরআনের আয়াত, বাইবেল থেকে নেয়া বাণী অথবা কবিতার পঙিক্তমালা সংযুক্ত করা হয়েছে।
‘Known Unto God’ এপিটাফে লিখা এই বাক্যটি দেখে মন উদাস হয়ে যায় ক্ষণিকে। বিশ্ববিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক রুডইয়ার্ড কিপলিং Rudyard Kipling এই ইম্পেরিয়াল ওয়ার গ্রেভস কমিশনের (Imperial War Graves Commission-IWGC) এ কর্মরত থাকাকালীন এই লাইনটি এপিটাফ এর জন্য নির্বাচন করেছিল। যা বিশ্বযুদ্ধে নিহত অজ্ঞাতনামা এই সৈনিকদের এপিটাফে লিখার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।
ভেতরের দর্শন
চারপাশে বড় বড় গাছে ঘেরা সবুজে আবৃত এই সমাধিস্থল। রয়েছে বিশাল শতবর্ষী বৃক্ষ। সমাধিস্থলের শেষে রয়েছে প্রার্থণাঘর। প্রবেশপথ থেকে শেষের প্রার্থণাঘর পর্যন্ত দুদিকে সারি সারি সমাধিফলকে ৫২৪ সৈনিক, ১৯৮ বৈমানিক আর ১৩ জন নাবিকের শেষ চিহ্ন রয়েছে।
প্রবেশ পথের ঠিক ডানে ছোট একটি কক্ষে সংরক্ষিত রেজিস্টার ঘর অবস্থিত। তাতে ১৯৩৯-৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সাগরে মৃত্যুবরণ করা নাবিক ও লস্করদের নাম রয়েছে। ৬৫০০ জাহাজের নাবিক ও সীম্যান-দের স্মৃতি ধরে রেখেছে রেজিস্টার ঘরটি। খুব করুণ শোনালেও সত্যি যে, যারা এই পৃথিবীর মাটিতে সমাধিও পায়নি।
সিমেট্রির ঠিক মাঝ বরাবর রয়েছে অষ্টভুজ আকৃতির কমনওয়েলথ যুদ্ধের স্মৃতিসৌধ ‘ক্রস অফ স্যাক্রিফাইস’। যা মূলত ব্রোঞ্জের লংসওয়ার্ড ব্লেড ডাউন করে তৈরি। ইম্পেরিয়াল ওয়ার গ্রেভস কমিশনের (Imperial War Graves Commission – IWGC) জন্য এটি স্যার রেজিনাল্ড ব্লমফিল্ড ১৯১৮ সালে এটি নির্মাণ করেন। বিশ্বজুড়ে ৪০টির বেশি কমনওয়েলথ ওয়ার সিমেট্রি স্মৃতিসৌধ হিসাবে এটি রয়েছে।
প্রবেশের সময়
দর্শনার্থীদের গ্রীষ্মকালে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত। তবে শীতের মৌসুমে এই সময়সূচির কিছুটা পরিবর্তন ঘটে থাকে। বর্তমানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ভেতরে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
সমাধিক্ষেত্রে পরিবেশ নীরব থাকা কাম্য। এছাড়া ডি এস এল আর আর মডেল ফটোশুট এবং বসে আড্ডা দেয়া নিষেধ। তবে ডকুমেন্টারির জন্য বিশেষ অনুমতি নিয়ে করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই মনকে স্থির করে শুধু নিহতদের শ্রদ্ধা জানাতে আগ্রহী হলেই কারো যাওয়া উচিত সিডব্লিউজিসির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই সমাধিক্ষেত্রে।
হলুদ সূর্যালোকে মৃদু দ্বীপ্তি ছড়ায় ওপাশে বিশাল বটবৃক্ষ আর হরিদ্রা কার্পেটে জড়ানো সিমেট্রির উপরে ভেসে বেড়ায় পাঁজা পাঁজা মেঘের কুণ্ডলী। শোকের বুক চিরে বিশ্বযুদ্ধের প্রথম আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দ বর্জনির্ঘোষের মতো বিস্ফোরিত হয় এখনও সিমেট্রির প্রতিটি কণাতে। আর শত শত দর্শনার্থীদের শ্রদ্ধায় আর স্মৃতিতে এভাবেই ভরে উঠে সমাধির প্রাঙ্গন।
Feature Image: Labonyo Shahida 01. Chittagong War Cemetery. 02. Chittagong War Cemetery, Chattogram. 03. Remembrance at Commonwealth War Cemetery. 04. Chittagong Commonwealth War Cemetery.
বিশেষ করে স্টার্টিং আর শেষ প্যারাগ্রাফ এই দুটি জায়গার লেখা মনে দাগ দিয়ে আছে।
ইতিহাস জানাকে নতুন ভাবে জানতে ইচ্ছা করলে এমন লেখা পড়তে ভালো লাগে।
মানব সভ্যতার ধ্বংসের সাথে ভালোবাসার স্পর্শ।
চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি আমার খুব পছন্দের জায়গা। অনেকবার গিয়েছি। কবরগুলোতে উক্তিগুলো পড়তাম। আর পরিবেশটা এত প্রশান্তির। লেখাটাও তেমন প্রশান্তিময় হয়েছে। খুব খুব ভাল লাগলো।চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি আমার খুব পছন্দের জায়গা। অনেকবার গিয়েছি। কবরগুলোতে উক্তিগুলো পড়তাম। আর পরিবেশটা এত প্রশান্তির। লেখাটাও তেমন প্রশান্তিময় হয়েছে। খুব খুব ভাল লাগলো।