বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রায় ৯ মিলিয়ন মানুষ আজ বেঁচে আছেন শুধুমাত্র ইনসুলিনের জন্য। ইনসুলিন আবিষ্কারের আগে, টাইপ-১ ডায়াবেটিস মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। এমনকি ২০ শতকের শুরুতেও, একমাত্র কঠিন ডায়েট বা অনেকটাই ক্ষুধার্ত রেখে মৃত্যুকে দূরে রাখার চেষ্টা ছাড়া; আর কিছুই করার ছিল না। আজকের আলোচনায় থাকবে ইনসুলিন আবিষ্কারের সেই ধারাবাহিক ইতিহাস।
ইনসুলিনের ধারণা
ইনসুলিন অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত হরমোন, যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ১৮৮৯ সালে জার্মান গবেষক অস্কার মিনকোয়াস্কি এবং জোসেফ ভন মেরিং আবিষ্কার করেন; কুকুর থেকে অগ্ন্যাশয় গ্রন্থি অপসারণ করলে, তাদের মধ্যে ডায়াবেটিসের লক্ষণ দেখা দেয় এবং শীঘ্রই মৃত্যু ঘটে। এখান থেকেই ইনসুলিনের ধারণা তৈরি হয়।
১৯১০ সালে স্যার এডওয়ার্ড অ্যালবার্ট শার্পে-শেফার খুঁজে বের করেন যে, ডায়াবেটিস রোগীদের অগ্ন্যাশয়ে শুধুমাত্র একটি রাসায়নিক পদার্থ অনুপস্থিত ছিল। তিনি এই রাসায়নিক পদার্থের নাম দেন ‘ইনসুলিন,’ যা ল্যাটিন শব্দ ‘ইনসুলা’ থেকে এসেছে।
আবিষ্কারের গল্প
১৯২০ সালে কানাডায়, স্যার ফ্রেডরিক জি. ব্যান্টিং ইনসুলিন তৈরির ভিন্ন আইডিয়া নিয়ে প্রফেসর জন ম্যাক্লিওডের কাছে আসেন। ম্যাক্লিওড, ব্যান্টিংয়ের গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার দক্ষতা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তিনি ব্যান্টিংকে, অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র চার্লস বেস্টের সাথে কাজ করার পরামর্শ দেন। শুরুতে বেস্ট আর ব্যান্টিংয়ের মাঝেও দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তবে, সময়ের সাথে তার পরিবর্তন ঘটে।
১৯২১ সালের পুরো গ্রীষ্ম জুড়ে তারা গবেষণা চালিয়ে যান। ব্যান্টিং তাদের কাজের ফলাফল নিয়ে অনেক আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু, ম্যাক্লিওড কিছু অসঙ্গতি খুঁজে পান। ১৯২১ সালের শেষের দিকে, তাদের এই বিরোধের আরও অবনতি হয়।
প্রথম সাফল্য-মানবদেহে ইনসুলিন প্রয়োগ
১৯২২ সালের জানুয়ারিতে, ১৪ বছরের লিওনার্ড থম্পসনের বাবা তাকে টরন্টো জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসেন। থম্পসন, টাইপ-১ ডায়াবেটিসের জন্য মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে ছিল। ১১ জানুয়ারি, থম্পসনকে ইনসুলিন দেওয়া হয়। কিন্তু, তাতে অবস্থার উন্নতি হয়নি।
দুই সপ্তাহ পরে, ২৩ জানুয়ারি, থম্পসনকে আবার ইনজেকশন দেওয়া হয়। তবে, এবারের ফল ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। থম্পসনের অবস্থার উন্নতি হয়। রক্তে শর্করার মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এবং সাথে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও ছিল না।
তাহলে এই দুই সপ্তাহে কী পরিবর্তন হয়েছিল? উত্তর হলো, ইনসুলিনের এই দ্বিতীয় ব্যাচটি বায়োকেমিস্ট জেমস কলিপ তৈরি করেন। তিনি ইনসুলিন থেকে অ্যালকোহলের মাধ্যমে বিষাক্ত পদার্থ অপসারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
দুই মাস পর ম্যাক্লিওড ওয়াশিংটনে, ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ আমেরিকান ফিজিশিয়ানস’ (Association of American Physicians)-এর সভায় ইনসুলিন আবিষ্কারের প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।
জর্জ জিউয়েলজারের ট্র্যাজেডি
১৯০৮ সালে অর্থাৎ কানাডিয়ানদেরও ২০ বছর আগে, জার্মান ডাক্তার জর্জ জিউয়েলজার একইভাবে ইনসুলিনের ধারণা পান। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন, ‘অ্যাকোমাটল।’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে জর্জ জিউয়েলজারের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তিনিও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তবে, তিনি এর সমাধানও জানতেন।
১৯১৪ সালে, তিনি সুইস ফার্মাসিউটিক্যাল ‘হফম্যান লা রোশের’ (Hoffman La Roch) সাহায্য পান। কিন্তু জিউয়েলজার কিছু নতুন এবং গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেন। তার সমাধানের আগেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাথে, ইনসুলিনের উপর জিউয়েলজার গবেষণা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। তার প্রায় এক দশক পর, নোবেল পুরস্কার চলে যায় ব্যান্টিং এবং ম্যাক্লিওডের হাতে।
নোবেল পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক
ব্যান্টিং, ম্যাক্লিওডের সাথে পুরষ্কার ভাগ করতে অসন্তুষ্ট ছিলেন। তার মতে, ইনসুলিন আবিষ্কারে ম্যাক্লিওডের কোনও অবদান নেই। তিনি বেস্টকে জানান, পুরস্কারের প্রাপ্ত অর্থ তিনি বেস্টের সাথে ভাগ করে নিবেন।
তবে, বেস্ট এই বিষয়কে উপেক্ষা করায় ব্যান্টিং বিরক্ত হয়। ১৯৪১ সালে তিনি যুক্তরাজ্যে একটি গোপন যুদ্ধের মিশনে যাওয়ার সময়, বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন। ম্যাক্লিওড ১৯৩৫ সালে মারা যান। ফলে, বেস্ট এবং কলিপ ছিলেন টরন্টোর মূল গবেষণা দলের অবশিষ্ট সদস্য।
এর মাঝে নতুন বিতর্ক তৈরি হচ্ছিল। জানা যায়, ১৯২১ সালে একই সময়ে নিকোলাই পোওলেস্ক নামে একজন রোমানিয়ান বিজ্ঞানী ইউরোপের একটি বৈজ্ঞানিক জার্নালে তার গবেষণার ফল প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার ইহুদি-বিরোধী রাজনীতি এবং রোমানিয়ায় হলোকাস্ট উস্কে দেওয়ায় তার ভূমিকা, তার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
বেস্ট নিশ্চিত ছিলেন তার নামটিই রাখা হবে। তবে এজন্য, আবিষ্কারের সময়টি সঠিক ভাবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে হবে। কলিপের অবদানকে যথাযথ সম্মান বেস্ট দেননি।
তবে, কলিপ পুরো সময়ই নীরব ছিলেন। এমনকি ব্যান্টিং নিজেও কলিপের সাফল্যে খুশি হতে পারেননি।
বাণিজ্যিক উৎপাদন
চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান “এলি লিলি” বৃহৎ পরিসরে ইনসুলিন উৎপাদন শুরু করে। পরবর্তী দশকগুলোতে, নির্মাতারা বিভিন্ন ধরনের ‘ধীর-ক্রিয়াশীল বা স্লো অ্যাক্টিং’ ইনসুলিন তৈরি করে।
১৯৩৬ সালে প্রথম ‘নোভো নোরডিস্ক ফার্মাসিউটিকেলস’ (Novo Nordisk Pharmaceuticals, Inc.) এই ধরনের ইনসুলিন তৈরি করে।
ইনসুলিন অ্যানালগ
ইনসুলিন অ্যানালগ হিউমেন ইনসুলিনের একটি পরিবর্তিত রূপ, যা শরীরে ইনসুলিনের স্বাভাবিক কাজকে অনুকরণ করে। এতে ডোজ নেওয়া সহজ হয় এবং হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যাওয়ার ঝুঁকি কমে।
এটি প্রথম ১৯৯৬ সালে অনুমোদন পায়। র্যাপিড-অ্যাক্টিং, সর্ট-অ্যাক্টিং, ইন্টারমিডিয়েট-অ্যাক্টিং এবং লং-অ্যাক্টিং নামে বিভিন্ন ধরনের ইনসুলিন অ্যানালগ পাওয়া যায়।
হিউমেন ইনসুলিন
১৯৭৮ সালে, ই. কোলাই (E.coli) ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে প্রথম জেনেটিকালি ইঞ্জিনিয়ারড, সিন্থেটিক ‘হিউমেন’ ইনসুলিন তৈরি করা হয়। এলি লিলি ১৯৮২ সালে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে হিউম্যান ইনসুলিন ‘হুমুলিন’ বিক্রি করতে শুরু করেন।
ইনসুলিন প্রয়োগ পদ্ধতি
সিরিঞ্জ
ইনসুলিন প্রয়োগের মূল পদ্ধতি ছিল একটি পুনঃব্যবহারযোগ্য গ্লাস বা ধাতব সিরিঞ্জ। প্রতিবার ব্যবহারের পর এগুলো গরম পানিতে জীবাণুমুক্ত করতে হতো। ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি, বাণিজ্যিকভাবে ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ তৈরি করা হয়। এটি এখনও ইনসুলিন ব্যবহারের সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি।
ইনসুলিন পেন
ইনসুলিনের সহজ ও নির্ভুল ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য, ১৯৮৫ সালে প্রথম ‘নোভো নরডিস্ক’ ইনসুলিন পেন তৈরি করে। এটি ছোট, নিরাপদ এবং সহজে বহনযোগ্য। ফলে, সব বয়সের জন্য এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
ইনসুলিন পাম্প
ইনসুলিন পাম্প ত্বকে প্রবেশ করানো একটি ছোট, নমনীয় টিউব। যার মাধ্যমে র্যাপিড-অ্যাক্টিং ইনসুলিন ব্যবহার করা হয়। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইনসুলিন পাম্প পাওয়া যায়। তবে, ২০০০ সালের দিকে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
ইনসুলিন পাম্প, ইনসুলিন থেরাপির একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন ছিল। এটি পরবর্তীতে ‘স্বয়ংক্রিয় ইনসুলিন ডেলিভারি (এআইডি) সিস্টেম’-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠে।
ইনহেলড ইনসুলিন
সর্বশেষ সংযোজন হিসাবে এসেছে ইনহেলার। এটি সবচেয়ে নিরাপদ, কারণ এর ব্যবহারে কোনো সিরিঞ্জ প্রয়োজন হয় না। বর্তমানে দুই ধরনের র্যাপিড-অ্যাক্টিং ইনহেলড ইনসুলিন রয়েছে-২০০৬ সালের ‘এক্সুবেরা’ (Exubera) এবং ২০১৪ সালের ‘আফ্রেজা’ (Afrezza)। তবে, এটি সাধারণত কম ব্যবহার হয়।
ইনসুলিনের ভবিষ্যৎ
গবেষকরা ইনসুলিন এবং ইনসুলিন ডেলিভারি সিস্টেমে পরিবর্তন এবং উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। যার মধ্যে রয়েছে: দীর্ঘস্থায়ী ইনসুলিন যা কয়েক দিন থেকে এক সপ্তাহ স্থায়ী হয়। ‘স্মার্ট’ ইনসুলিন, এআইডি সিস্টেমের সর্বশেষ ইনসুলিন এবং সিজিএম প্রযুক্তি (CGM)। একইসাথে, ইনসুলিন সরবরাহের নিরাপদ পদ্ধতিগুলো নিয়েও গবেষণা চলছে।
Featured Photo: Wikimedia Commons References: 01. History of the Wonderful Thing We Call Insulin. 02. Discovery of Insulin History. 03. The Discovery of Insulin a Story of Monstrous Egos and Toxic Rivalries.