আমাদের পৃথিবীতে আশ্চর্য হওয়ার মতো কত কি যে আছে তার ইয়াত্তা নেই। দেশ-বিদেশের ইতিহাস, অন্য দেশের সংস্কৃতি, মানুষের জীবনযাত্রা এসব কিছুই আরেক দেশের মানুষের কাছে ব্যাপক কৌতূহলের বিষয়। স্বাভাবিকভাবেই এসব নিয়ে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আর এমন আগ্রহের বিষয়বস্তুতে থাকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানান প্রাকৃতিক নিদর্শন।
এমনই একটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিদর্শন হচ্ছে ভিক্টোরিয়া ফলস বা ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত। যা পৃথিবীর অন্যতম সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত হিসেবে পরিচিত। সারাবিশ্বের হাজার হাজার পর্যটক প্রতিবছর ভিড় করে থাকেন এর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। ভিক্টোরিয়া ফলস নিয়ে অনেক ইতিহাস বা গল্প শোনা যায় যা অনেকের কাছেই অজানা। এই অজানা গল্প বা ইতিহাস নিয়েই আজকের আলোচনা।
উৎপত্তি
অত্যন্ত মনোরম এই জলপ্রপাতটি জিম্বাবুয়ের জিম্বাজি নদী থেকে সৃষ্ট। এটি লিভিংস্টোনে অবস্থিত বেশ ছিমছাম একটি অঞ্চলে এর সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীর বেশ কিছু জলপ্রপাত থাকা সত্ত্বেও ভিক্টোরিয়া ফলসকেই সবচেয়ে বৃহৎ জলপ্রপাত হিসেবে বলা হয়ে থাকে।
জিম্বাবুয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি অন্যতম পরিচিত দেশ। সাধারণত জিম্বাবুয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটাই গুছানো। এই দেশের উত্তর পশ্চিমাংশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত জিম্বাজি নদী থেকেই এই জলপ্রপাতের সৃষ্টি।
এই জলপ্রপাতকে দুই দিকে সংযুক্ত করার জন্য একটি ব্রিজ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে যার উপর দিয়ে ট্রেনসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল করতে পারে। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এতটাই যে, প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এখানে আসেন। এছাড়া তুলনামূলক কম খরচও এখানে পর্যটকদের ভিড়ের অন্যতম কারণ।
এই চমৎকার জলপ্রপাতের আশেপাশে জঙ্গল এবং পাহাড় থাকার সুবাদে বাজ পাখিসহ হাতি, সিংহ, চিতা ইত্যাদির বসবাস রয়েছে। ১০৮ মিটার উঁচু এই জলপ্রপাত থেকে দৃষ্টিনন্দন ঝর্ণার সৃষ্টি; যা মনজুড়াবে যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমীর।
ভিক্টোরিয়া ফলসের নামকরণ ও যত অজানা তথ্য
ভিক্টোরিয়া ফলসের উৎপত্তি কিন্তু সাম্প্রতিককালে হয়নি! এই উঁচু অতি সৌন্দর্যে ঘেরা মনোরম জলপ্রপাতটি আজ থেকে প্রায় কয়েকশো বছর আগে আবিষ্কার করেন স্কটিশ ধর্মপ্রচারক ডেভিড লিভিংস্টোন, যার নামেই পরবর্তীতে এই অঞ্চলের নাম লিভিংস্টোন রাখা হয়।
ধারণা করা হয়, ১৮৫৫ সালের ১৬ নভেম্বর প্রথম তিনি এই জলপ্রপাতটি দেখেন। এই জলপ্রপাতের সৌন্দর্যে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। এই অপরূপ জলপ্রপাতটির নাম তিনি ব্রিটেনের রাণি ভিক্টোরিয়ার নামে নামকরণ করেন। তিনি বিশ্বাস করেন এতে ব্রিটেনের রাণির প্রতি সম্মান দেখানো হবে।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই জলপ্রপাতটির আরও একটি নাম রয়েছে! জিম্বাজি নদীর আশেপাশে যাদের বসবাস ছিল তারা একে মসিওটুনিয়া বলেই চিনতো। এটি সোথো ভাষা অর্থাৎ স্থানীয় ভাষা হিসেবেই ব্যবহার করা হতো।
ভিক্টোরিয়া ফলস আবিষ্কারের গল্পটা বেশ পুরনো হলেও অনেক মজার একটি ঘটনা আছে। লিভিংস্টোন ছিলেন একজন ইউরোপীয় ধর্মপ্রচারক। ধর্মের প্রচারের কাজে তিনি পৃথিবীর অনেক দেশেই ভ্রমণ করতেন।
১৮৫৫ সাল নাগাদ তিনি প্রথম আফ্রিকায় আসেন এবং সেখানে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের সময় এই জলপ্রপাতটি আবিষ্কার করেন। যদিও লিভিংস্টোন তার এক লেখায় উল্লেখ করেছিলেন এই জলপ্রপাত তার যাত্রাপথে বেশ বাঁধা দেয়।
কিন্তু তা সত্ত্বেও এর অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ধারণা করেন স্বর্গদেব স্বয়ং এই সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে বাধ্য হবেন! এবং শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েক বছর এটি আফ্রিকান উপজাতিদের মধ্যে ধর্মীয় ভিত্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ভিক্টোরিয়া ফলসের উচ্চতা নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম নয়! এর উচ্চতাই বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের আকর্ষণের মূল কারণ হয়ে থাকে। জলপ্রপাতের এত উচ্চতার কারণে এই অঞ্চলের মানুষেরা একসময় কাছে যেতে ভয় পেতো যদিও এই ধারণা অনেকেই ভুল হিসেবে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন এবং বলেন এটিকে তারা পবিত্র স্থান হিসেবে সম্মান করতো বিধায় এর কাছে যেতে ভয় পেতো। এমনকি আফ্রিকান আদিবাসীরা এই জলপ্রপাতকে একসময় দেবতা হিসেবে মেনে থাকতো।
এই জলপ্রপাতের উচ্চতা সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানা যায়। ভিক্টোরিয়া ফলসের উচ্চতা প্রায় ১০৮.৩ মিটার যা নায়াগ্রা ফলকেও ছাড়িয়ে গেছে। আর প্রস্থ প্রায় ১,৭০৩ মিটার। গভীরতা নায়াগ্রার থেকে দ্বিগুণ এবং নিম্ন নদী প্রবাহকালীন সময়ে খরার মুখোমুখি হতে হয়। এই জলপ্রপাতে প্রতি সেকেন্ডে ৩৩০০০ ঘনফুট পানি পতিত হয় যা বিশ্বের সর্বকালীন ইতিহাসে রেকর্ড।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
আফ্রিকার রোমাঞ্চকর এই জলপপাতটির প্রাকৃতিক পরিবেশ চোখের আরামের জন্য যথেষ্ট। সবুজ ঘন অরণ্যে ঘেরা এই জলপ্রপাতের আশেপাশে রয়েছে অসংখ্য নাম না জানা গাছপালা। মেহগনি, আবলুস, বুনো খেজুর গাছ, বিভিন্ন লতাপাতার দেখা পাওয়া যায় ভিক্টোরিয়া ফলস রেইনফরেস্টে।
এই জলপ্রপাতের পানি পড়ার সময় বেশ দূর থেকে শব্দ শোনা যায়। অতি ভয়ঙ্কর এবং রোমাঞ্চকর এই শব্দের জন্য এই জলপ্রপাতের নাম মোজি-ওয়া-তুনিয়া হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যার অর্থ হচ্ছে বজ্রের ধোঁয়া। পানি পড়ার সময় এর বেগ এতটা তীব্র থাকে যে জলকণা একত্রিত হয়ে ধোঁয়ার আবহ সৃষ্টি করে আর সেই কারণেই স্থানীয় ভাষায় একে মোজি-ওয়া-তুনিয়া বলা হয়ে থাকে।
একারণেই স্থানীয় আদিবাসীরা কাছে যেতে চাইতেন না। অনেকেই মনে করতেন এটি তাদের উপাসনালয়ের জায়গা, আর তাই আদিবাসীরা একে পবিত্র জলপ্রপাত বলে মনে করতেন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, আফ্রিকান সরকারও ভিক্টোরিয়া ফলস নাম বদলে এই নামকরণ করেন।
ভিক্টোরিয়া ফলস ব্রিজ
ভিক্টোরিয়া ফলস ব্রিজ মূলত দুই দিকের জাম্বিয়া থেকে জিম্বাবুয়ের সংযোগের কারণে নির্মাণ করা হয়। এই ব্রিজ নির্মাণে যার নাম আগে থাকবে তিনি হচ্ছেন জর্জ এন্ড্রু হবসন (George Andrew Hobson) যিনি এই ব্রিজের ডিজাইন তৈরি করেছেন।
এই ব্রিজ নির্মাণে সময় লেগেছিল প্রায় ১৪ মাস। এই ব্রিজ নির্মাণকালে খরচ হয়েছিল প্রায় ৭৯,৭৭৭ হাজার মার্কিন ডলার। বর্তমানে জিম্বাজি নদীর উপর নির্মাণ করা এই ব্রিজে নিত্যদিনই হাজার হাজার যানবাহনসহ পর্যটকদের ভিড় দেখা যায়। জিম্বাজি নদীর সৌন্দর্য এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে ভিক্টোরিয়া ফলস ব্রিজটি।
তবে চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এই চমৎকার গা শিউরে দেয়া জলপ্রপাতটির অবস্থা দিন দিন বেশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণয়নের ফলে এর জলের পরিমান কমতে শুরু করেছে। জানা যায়, এর এক অংশ এখন মৌসুমগত কারণে খরা থাকলেও সামনে এমন দিনও আসতে পারে এটি প্রায় ৮০ ভাগ অংশই খরার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।
আর এর জন্য বিশ্বের নানা পর্যটক এই ভিক্টোরিয়া ফলস থেকে মুখ সরিয়ে নিবে এমনটাই আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা! কিন্তু তাই বলে কি মানুষের কৌতূহল কমে যাবে? না! এই দুর্গম অঞ্চলে সৃষ্ট জলপ্রপাতটির প্রতি আগ্রহ এবং কৌতূহল সারাজীবনই ভ্রমণ পিয়াসী মানুষদের কাছে তাজা হয়ে থাকবে।
Feature Image: worldpacker.org Reference: 01. Victoria Falls Waterfall Zambia Zimbabwe. 02. The Victoria Falls.